নারীকে সম্বোধন: স্যার-ম্যাডাম, মিস-মিসেস সমাচার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছি পুরুষ শিক্ষককে ‘স্যার’ আর নারী শিক্ষক হলে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করতে হবে। আবার কাউকে সম্মান করে কথা বলার সময় শিক্ষক না হলেও পুরুষ হলে ‘স্যার’ আর নারী হলে ‘ম্যাডাম’ লিখতে বা বলতে হয়। এভাবেই সারা জীবন চর্চা করে এসেছি। কখনো কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হইনি। সাম্প্রতিক কালে কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম, সে সম্পর্কে না লিখে পারছি না।

বাংলাদেশে কোনো কারণে ই–মেইলে কাস্টমার সার্ভিস নিতে গেলে আমাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হয়। আমার নামটা এমন যে এই নামে নারী যেমন আছে, পুরুষও তেমনি আছে। তাই যাদের কাছ থেকে একবার সার্ভিস নিচ্ছি, তাদের সংশোধন করে দিই না। ধরে নিই, বুঝতে না পেরে ডাকছে। কিন্তু যাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করতে হচ্ছে, তারা স্যার বলে সম্বোধন করলে আমি সংশোধন করে দিই যে আমাকে স্যার ডাকতে হবে না, নাম ধরে সম্বোধন করলেই আমি খুশি হব। কিন্তু এরপরও দেখি ‘স্যার’ লেখা হয়। এমনও হয়েছে,, কোনো একটা জায়গায় আইডি ভেরিফিকেশনের জন্য আইডি কার্ড দিতে হচ্ছে। সেখানে আমার ছবি আছে, যা দেখে সহজে বোঝা যাবে যে আমি পুরুষ না। কিন্তু এরপরও ভ্রুক্ষেপ নেই। সেই একই সম্বোধন—‘স্যার’। পুরুষেরাও স্যার ডাকছে, আবার দেখা যাচ্ছে, কোনো নারী কাস্টমার সার্ভিস দিতে নিলে আমাকে স্যার ডাকছে।

এমন যদি হতো এটা কেবল একটা প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে, তাহলে একটা কথা ছিল। একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আমি এ আচরণ পেয়েছি। এমনও হয়েছে, একটা কারণে দেশে কোনো একটা প্রতিষ্ঠানে ফোন দিয়ে কথা বলেছি। যার সঙ্গে কথা বললাম, তিনি একটু পরে ই–মেইল দেওয়ার সময় আমাকে সেই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছেন। তখন আমার হঠাৎ মনে হলো, এটা কি এমন হতে পারে যে বাংলাদেশে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে? না হলে আমাকে কেন একাধিক জায়গা থেকে ‘স্যার’ ডাকা হচ্ছে? কিন্তু যদি নারী-পুরুষনির্বিশেষে ‘স্যার’ ডাকতেই হয়, সেটা কি খুব অদ্ভুত নিয়ম না?

আমি আমার দেশে চাকরিজীবী বন্ধুবান্ধবের বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। প্রথমে তারা বলল, এ রকম কোনো নিয়ম তারা শোনেনি। কিন্তু আমি বিষয়টা নিয়ে আরও ভালোভাবে জিজ্ঞাসা করায় বলল, ‘ও হ্যাঁ, বাংলাদেশের সরকারি অফিসগুলোয় দেখেছি, সবাইকে স্যার ডাকতে বলা হয়। যেমন, ওসি নারী হলেও তাঁকে ‘ওসি স্যার’ বলতে হবে।’ কিন্তু আমি যত দূর জানি, বাংলাদেশের সরকারি অফিসে নারীদের ‘ম্যাডাম’ ডাকা নিষেধ (কারণ, একটু পরেই বলছি)। কিন্তু তাই বলে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার কোনো যুক্তি আমি দেখছি না। বন্ধু আমার সঙ্গে দুষ্টামি করল কি না, বুঝলাম না।

আরেকজন বন্ধু বলল, আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরাই বেশি কাস্টমার সার্ভিস নেয়। দাপ্তরিক কাজকর্ম বেশির ভাগ সময় পুরুষেরাই করে। তাই ই–মেইল কিংবা মেসেজের টেমপ্লেটে ‘স্যার’ লেখা থাকে। কাস্টমার সার্ভিস এজেন্ট সেটাই কপি-পেস্ট করে দেয়। আর বাকিরা তা অনেকটা মেনে নিয়েছে। কোনো নারী সেভাবে আপত্তি করে না।

আমি অবশ্য একাধিকবার আপত্তি করেছিলাম। একবার বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক মোবাইল ফোন কোম্পানিতে লিখিত মাধ্যমে কাস্টমার সার্ভিস নিতে গিয়ে বারবার নিষেধ করার পরেও আমাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছিল। তখন আমি একটা পর্যায়ে এসে লিখেছি, ‘আপনার যদি নারী গ্রাহককে সেবা দিতে বেশি অসুবিধা থাকে, তাহলে আমাকে এমন একজন এজেন্টের কাছে ট্রান্সফার করুন, যিনি নারীদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।’

তাহলে কি ‘ম্যাডাম’ ব্যবহার করব?

আমার প্রবাসজীবনের শুরুর দিকে একবার একজন ভদ্রমহিলা অধ্যাপককে ‘ম্যাডাম’ বলে ডেকেছিলাম। তিনি আমাকে খুব স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন, ‘খুব খুশি হব যদি তুমি আমাকে “ম্যাডাম” না ডেকে “Dr./Professor Last Name” হিসেবে সম্বোধন করো।’ আমি এতেও অবাক হয়েছিলাম, আমি তো তাঁকে সম্মান করে নারীদের জন্য নির্ধারিত স্যালুটেশন ব্যবহার করছি।

‘ম্যাডাম’ বলতে অসুবিধা কী?

পরে আমি ইংরেজি অভিধানে ‘ম্যাডাম’ খুঁজে এর নানা ব্যবহার দেখলাম। এর মধ্যে একজন সম্ভ্রান্ত নারীকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি ‘ম্যাডাম’ শব্দটির আরেকটি অর্থ হচ্ছে, ‘A woman who manages a brothel’। অর্থাৎ পতিতালয় দেখাশোনার দায়িত্বে যে নারী থাকেন, তাঁকে ম্যাডাম বলে।

অভিধানের এই ব্যাখ্যা দেখার পর আমি আর কোনো দিন কাউকে ‘ম্যাডাম/ম্যাম’ সম্বোধন করিনি।

আর কানাডায় দেখি, ব্রিটিশ রাজপরিবারের নামে নাগরিকেরা শপথ গ্রহণ করলেও ব্রিটিশ শিষ্টাচার তারা বহু আগেই ত্যাগ করেছে। এর মধ্যে এসব ‘স্যার-ম্যাডাম’ সম্বোধন ত্যাগ অন্যতম। একবার ক্লাসে দেখি এক ছেলে আমাদের প্রফেসরকে ‘স্যার’ বলে ডাকছে। প্রফেসরও দেখি উত্তর দেওয়ার সময় ছেলেটিকে ‘স্যার’ ডাকছেন। প্রথমে ভাবলাম, মনে হয় সম্মান করে কাজটি করছেন। কিন্তু পরে বুঝলাম, না, আসলে তিনি নিরুৎসাহিত করার জন্য কাজটি করছেন। বিলাতি সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য দেখে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে সম্বোধন করত (এখনো করে কি না আমার জানা নেই। ব্রিটিশ শিষ্টাচার বিষয়ে নানা আলোচনা অনলাইনে একটু খুঁজলেই দেখতে পাব আমরা)। তবে যুগের পর যুগ ব্রিটিশ শাসনামলে থাকার ফল হচ্ছে এই ‘স্যার-ম্যাডাম’ সম্বোধন।

এবার মিস-মিসেস প্রসঙ্গ

যখন অবিবাহিত ছিলাম, তখন বিভিন্ন দাপ্তরিক কাগজে বাংলাদেশে দেখতাম, আমার নামের আগে ‘Mrs.’ লিখেছে। পরে সেটি সংশোধন করতে হতো। আসলে মেয়েদের বয়স আন্দাজ করে সেখানে চট করে ধরেই নেওয়া হয়, এই মানুষটি হয়তো বিবাহিত, তাই তাকে মিসেস হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। আমাদের বাংলাদেশের সমাজে পুরুষ মানুষকে সম্বোধনের জন্য তার বৈবাহিক অবস্থা ঠিক তেমন গুরুত্বপূর্ণ না, যতটা একজন নারীর বৈবাহিক অবস্থা খুব (!) গুরুত্বপূর্ণ। আবার অন্য একাধিক দাপ্তরিক কাজে নারী-পুরুষনির্বিশেষে বৈবাহিক অবস্থা জিজ্ঞাসা করা হয় বাংলাদেশে, যা কিনা আমি কানাডায় দেখি না। কানাডায় একমাত্র সরকার ছাড়া আর কারও কাছে আমি আমার বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে জানাতে বাধ্য না। কিন্তু তাই বলে কানাডায় সরকারি চিঠিতে আমাকে বিবাহিত জেনে মিসেস বলে সম্বোধন করা হয় না। লিঙ্গনিরপেক্ষ সম্বোধন করতে চাইলে ‘Dear First Name’ বলে, আর কোনো ভদ্রমহিলাকে সম্বোধন করতে চাইলে তাঁকে ‘Ms. Last Name’ বলে। যেহেতু কানাডায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সামাজিক অবস্থান অন্য যেকোনো মানুষের মতোই, আর আমরা যেহেতু জানি না যে কে কোনো লিঙ্গের, তাই একটা মানুষকে সম্মানের সঙ্গে নাম ধরে ডাকলে অসুবিধার কিছু দেখি না।

তাই কানাডায় আমাকে কেউ ই–মেইল বা চিঠি দিলে ‘Dear Rifat’, ‘Dear Ms. Zahan’, ‘Dear Rifat Zahan’ এভাবে সম্বোধন করে। আবার ফোনে কথা বলতে নিলে সরাসরি ‘Rifat’ বলে ডাকে। মানুষের নিজের নাম বারবার শুনতে আপত্তি থাকার তো কথাই না, বরং খুশি হওয়ার কথা। তাই যেকোনো বয়সী, যেকোনো পেশার মানুষ আমাকে আমার নাম ধরে ডাকলে আমি এতে খুশিই হই। আর বাঙালি কেউ আমাকে ‘আপু, আপা, দিদি’—এভাবে ডাকলেও খুশি হই।

পরিশেষে

এই লেখায় বাংলাদেশ-কানাডার যে তুলনা দিলাম, তাতে বাংলাদেশের দুর্নাম আর কানাডার সুনাম করিনি। বাংলাদেশে জেন্ডার গ্যাপ এখনো অনেক বেশি। কানাডায়ও নারীর অধিকার নিয়ে নানা রকম সামাজিক সচেতনতা সব সময়ই হচ্ছে (যেমন, কানাডা কখনো কোনো নারী প্রধানমন্ত্রী পায়নি)। আমি যেহেতু এই দুটি দেশে থাকার সুযোগ পেয়েছি, তাই তুলনামূলক অভিজ্ঞতাগুলো এই দুই দেশ ঘিরেই। আর ভালো উদাহরণ যেকোনো দেশ থেকেই দেওয়া যায়।

অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কথা জানি না যে তারা নারীদের কীভাবে সম্মান করে, তবে কানাডায় আমি নারী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান পেয়েছি। কখনো আমার এটা মনে হয়নি যে ‘নারী দেখে আমি ঠিক এই জায়গায় গ্রহণযোগ্য না।’ একজন পুরুষ যেভাবে দাপ্তরিক কাজে সম্মানিত হন, আমিও ঠিক সেভাবেই সম্মানিত হই।

বাংলাদেশের সমাজে নারীকে শুধু জাতীয় সংসদে দেখেই আমরা খানিকটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। কিন্তু সিস্টেমের আনাচকানাচে নারীকে দেখতে অস্বস্তি বলেই তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন কিংবা তার বৈবাহিক অবস্থা বিচার করে তাকে ‘মিসেস’ বলে সম্বোধন করা হয়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। তবে আমি খুব আশাবাদী যে পরিস্থিতি সব সময় এ রকম থাকবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব বৈষম্য দূর হবে, স্রষ্টার কাছে এ-ই আমার চাওয়া।

*লেখক: রিফাত জাহান, পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচুয়ান, সাস্কাটুন, সাস্কাচুয়ান, কানাডা