নামের বিড়ম্বনা

সম্প্রতি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র বিভাগের নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়, বর্তমানে প্রচলিত জাতীয় পরিচয়পত্রের থেকে কিছু তথ্য পরিবর্তন করে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নকশা চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জানা গেছে, ওই নকশায় বিবাহিত নারীর নামের পাশে স্বামীর নাম থাকবে না। পুরুষ ও নারী সবার স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রেই থাকবে বাবা ও মায়ের নাম। নির্বাচন কমিশনের মতে, নাগরিকের ভোগান্তি কমানোর জন্যই স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে স্বামীর নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ বিবাহবিচ্ছেদ হলে অনেক নারীই নতুন জীবন শুরু করেন। তখন তাদের এ নিয়ে পড়তে হয় বিপাকে। আর এই সমস্যাটা ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু হওয়া থেকেই। বিবাহ বিচ্ছেদের পর তা সংশোধন করতে গেলে তাদের পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। এ ব্যাপারে হয়তো বিতর্ক হবে। কিন্তু এটা ভালো একটি উদ্যোগ।
কিন্তু নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র সংশ্লিষ্ট বিভাগের হয়তো এখনো আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়নি। সেটা হলো আমাদের বিরাট নাম রাখার ও লেখার পদ্ধতি। লম্বা চওড়া তিন চারটি নাম রাখা আমাদের দীর্ঘদিনের রীতি। আমরা যারা প্রবাসে আছি শুধুই তারাই জানি এ কারণে আমাদের কতটা ঝামেলা পোহাতে হয়। আমাদের অভিভাবকেরা নাম রাখার ক্ষেত্রে যদি একটু সচেতন হন তাহলে পরবর্তী প্রজন্মকে আর এই ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হবে না। এখন যেহেতু জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক সে ক্ষেত্রে সরকার চাইলে পদক্ষেপ নিতে পারে। তাহলে আমাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নাম নিয়ে আর এত সমস্যায় পড়তে হবে না।
বহির্বিশ্বে কোথাও নাম লেখার ক্ষেত্রে, এমনকি বাংলাদেশ পাসপোর্টের বেলায়ও নামের তিনটি অংশ থাকে। নামের এই তিনটি অংশ মূলত তিনটি পরিচয় বহন করে।
প্রথম অংশ (1st Name) : Given Name/প্রদত্ত নাম/নিজের নাম (এটাই হলো মূল নাম। সেটা যত বড় বা ছোট হোক)।
দ্বিতীয় অংশ (2nd Name) : এখানে মূলত বাবার নাম/আর বিবাহিত নারী চাইলে পরিবর্তন করে স্বামীর নাম দিতে পারেন।

তৃতীয় অংশ (Surname) : বংশগত নাম/এখানে বংশ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা পরিবারের নাম (যেমন শিকদার, চৌধুরী, সৈয়দ, বেপারি ইত্যাদি)। আর বিবাহিত নারী চাইলে পরিবর্তন করে স্বামীর বংশের নাম দিতে পারেন।
এ ছাড়া আমাদের দেশে আরেকটি ব্যাপার প্রচলন আছে। সেটা হলো কেউ যদি সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত থাকেন সেই পেশার নাম যেমন ডাক্তার, অধ্যাপক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, মাওলানা, মুফতি, হাফেজ, কারি ছাড়াও হাজি, আলহাজ ইত্যাদি নামের প্রথমে ব্যবহার করার। আর পেশাটা যদি একটু নিচু হয় তাহলে কিন্তু কেউ সেটা নামের আগে উল্লেখ করেন না। এরপর থাকে তিনটা-চারটা অংশ সংবলিত নিজের মূল নাম। তারপরে বংশের নাম। সর্বশেষ থাকে ডাক নাম। ঠিক একইভাবে বাবার নামেও থাকে তিনটা-চারটা অংশ। কেউ কেউ আবার এই দীর্ঘ নামকে আরও বেশি দীর্ঘায়িত করতে বিক্রমপুরী, ফরিদপুরী, বাবুনগরী ইত্যাদি নিজের এলাকা বা অঞ্চলের নাম যুক্ত করতেও কার্পণ্যবোধ করেন না। নামের এই বিশালতা যেন এক চলমান ট্রেন। একের পর এক বগি আসতেই থাকে। এই এতগুলি নামের ভিড়ে কোনটি যে মূল নাম তা বিদেশিদের খুঁজে পেতে সত্যিই হিমশিম খেতে হয়।
উদাহরণ হিসেবে আমার পরিচিত এক বন্ধুর নাম উল্লেখ করছি। তার নাম আবু জাফর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আবদুল কাদের চৌধুরী। তাহলে তার নামের তিনটি অংশ হবে নিম্নরূপ।
প্রথম অংশ : আবু জাফর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
দ্বিতীয় অংশ : মোহাম্মদ আবদুল কাদের।
তৃতীয় অংশ : চৌধুরী।
তাহলে তার পুরো নাম হলো আবু জাফর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম মোহাম্মদ আবদুল কাদের চৌধুরী। এটাতো গেল নামের আকৃতিগত সমস্যা। ধরে নিলাম সে তার নামকে এত বড় করবে না, শুধু আবু জাফর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ব্যবহার করবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশিরা ধরে নেবেন তার নাম আবু জাফর, বাবার নাম মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও বংশের নাম চৌধুরী। তাই বাধ্য হয়েই তাকে ওই পুরো নামই লিখতে হবে। কেননা এখানে বাবার নাম লেখার জন্য আলাদা অপশন নাই। এ ছাড়া প্রতি এক শ জন পুরুষ বাংলাদেশির মধ্যে আশি জনের নামের নামের প্রথম অংশ থাকে মোহাম্মদ। আর নারীদের মোসাম্মৎ বা মোছা.। তাই বিদেশিরা ভাবে বাংলাদেশিরা হয়তো রসুলকে (সাঃ) এত বেশি ভালোবাসে যে, এরা এই নাম ছাড়া অন্য কোনো নামই ভাবতে পারে না। কিন্তু তারা জানেন না, আমাদের অজ্ঞতাজনিত কারণেই আমরা প্রত্যেকের নামের আগে মোহাম্মদ ব্যবহার করে আসছি। আসলে এটা আমাদের মূল নামের অংশ নয়। আমাদের বদ্ধমূল ধারণা নামের আগে মোহাম্মদ না থাকলে সেটা মুসলমান নাম হতেই পারে না। আমরা রসুলকে (সাঃ) ভালোবেসে অবশ্যই সন্তানের নাম মোহাম্মদ রাখতে পারি। কিন্তু নামের প্রথম অংশে মোহাম্মদ না থাকলে সেটা মুসলমান নাম হবে না এটা ভাবা ভুল। আর সেই মোহাম্মদের বানান ও ব্যবহার একেকজন একেকভাবে করে যাচ্ছেন নির্বিকারে। আর যখন এই মোহাম্মদকে সংক্ষিপ্ত করে এম বা এমডি লেখার কারণে পড়তে হয় উটকো আরেক ঝামেলায়।

বাংলাদেশ ছাড়া নামের সংক্ষিপ্ত রূপ পৃথিবীর আর কোনো দেশে ব্যবহার হয় বলে আমার জানা নেই। দেশীয় ক্ষেত্রে নাম যত বড়ই হোক না কেন তা সংক্ষেপে লেখা যায়। যেমন আবু জাফর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। পাসপোর্ট বা সার্টিফিকেটে সে তার নাম সংক্ষেপ করে লিখেছে এ জে এম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। এখন বহির্বিশ্বে যেহেতু সংক্ষেপে নাম লেখার সুযোগ নেই সেহেতু তাকে বাধ্য হয়ে আবু জাফর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরীই লিখতে হবে। ধরুন এই নাম নিয়ে কেউ দেশের বাইরে ভালো কোনো কাজের জন্য আবেদন করেছেন। আবেদন ফরমে তার নাম আছে আবু জাফর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী আর তার আইডি প্রুফ অর্থাৎ পাসপোর্টে নাম আছে এ জে এম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। যদি সিলেকশন বোর্ড এই সব আবেদন ম্যানুয়ালি চেক বা গভীরভাবে খেয়াল না করে তাহলে এ ধরনের নামযুক্ত আবেদন প্রথমেই বাদ পড়ে যায়। এমনকি যাদের নামের প্রথমাংশে মোহাম্মদের পরিবর্তে এম, এমডি বা মোহা. থাকে তাদেরও একই সমস্যায় পড়তে হয় বারবার।
নামের শুরুতে মোহাম্মদ যুক্ত করার হাজার বছরের পুরোনো ভ্রান্ত ধারণাটাকে দূর করতে আলেম সমাজই পারেন প্রধান ভূমিকা রাখতে। কেননা আমাদের মুসলমান পরিবারে যখন কোনো নবজাতকের নামকরণ করা হয় তখন বাবা-মা প্রদত্ত নাম দোয়া মাহফিলের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়। তারা তখনই পারেন আমাদের এই অজ্ঞতাজনিত ভুল থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে।
এই সমস্যা সমাধানে কোনো দিন জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা হবে কিনা জানি না। তবে এইটুকুই জানি আমরাই পারি নাম রাখার ক্ষেত্রে একটু সচেতনতা অবলম্বন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দিতে।