নাট্যানুষ্ঠানে এপার বাংলার সম্মান

একরাশ ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় মঞ্চ। দুই নাটকের বেলাতেই একই কথা প্রযোজ্য। নাট্যানুষ্ঠানে এপার বাংলার আমরা ছিলাম সেদিনের প্রাণের অতিথি।
আধুনিক সমাজ ও এর মূল্যবোধ নিয়ে ভেবেছেন নাট্যকার। পারস্পরিক সম্পর্ক কিংবা আবেগ এখানে গুরুত্ব পায় না। কেবলমাত্র সুবিধা গ্রহণের দিকে ধাবিত হয় মানুষ। কেনারাম বেচারাম সেই কথাই বলে।
আরেক নাটক আবার নরক গুলজার। সুবিধাবাদিতা, শেষে লালসার জন্য কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, এতে সেটাই দেখানো হয়েছে।

দুই নাটকেরই লেখক রানা মুখার্জি। নির্দেশনা ও পরিচালনায়ও তার নিজের। ওপার বাংলারই আয়োজন। মূলত ভারতীয় বাঙালি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির কর্মসূচির এই প্রযোজনা। ইন্ডিয়া সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার এ উপলক্ষে সেদিন ছিল প্রাণবন্ত। পুরান অনুসারে ত্রিমূর্তি হচ্ছে জন্ম পালন ও বিনাশের রূপ। ব্রহ্মা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। বিষ্ণু পালন করেন। জীবনের সমস্যা ও সেসব কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তারই সমাধান দেন তিনি। শিব বা মহেশ্বর যখন দরকার হয়, মানুষকে বিনাশ করেন। যমই তাকে নিয়ে যান পরপারে। আর নারদ মুনির কাজ হচ্ছে মধ্যস্থতা করা।
দেবর্ষিরা বরাবরই পৃথিবী বা মানুষ নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে মহাসভা হয়। ঘটনার অনুপুঙ্খ বিচারে তারা করণীয় নির্ধারণ করেন।

সেলিম আল দীনের শকুন্তলার কথা মনে করিয়ে দেন অধ্যাপক মীর আনিসুল হাসান। সামনের সারির মাঝখানটিতে আমরা। প্রেক্ষাপট উঠে আসে। বিশ্বামিত্র মুনি ধ্যান করেন। কিন্তু হিংসায় জ্বলে ওঠে স্বর্গ। মুনির চরিত্র কলঙ্কিত করার জন্য নানা জল্পনা কল্পনা চলে। ইন্দ্রের রাজসভায় ষড়যন্ত্র হয়। স্বর্গের অপ্সরী রম্ভাকে পাঠানো হয় মর্ত্যে। এতে কামবোধ জাগ্রত হয় বিশ্বামিত্রের। জন্ম হয় শকুন্তলার। এখানেও স্বর্গ বড় স্পর্শকাতর। তাদের চর্চিত বিষয় মানুষ ও সমাজ।
সমাজ ও মানুষই তার লক্ষ্য। সেই বিবেচনা থেকে নাট্যকার সমাজ দেহের ভেতরকার দুর্বৃত্তায়নকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। দুর্বৃত্তদের কুকীর্তি স্বর্গকে বানিয়ে তোলে নরক। আর একই প্রবণতা থেকে মর্ত্যও হয়ে ওঠে দুষ্কর্মের আখড়া। নাটকে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী তথাকথিত নেতা, মাস্তান, ভণ্ড প্রতারকদের চেহারা উন্মোচন করার প্রয়াস চালিয়েছেন নাট্যকার। মঞ্চায়ন দেখছি আমরা। বিরতিতে শুভেচ্ছা বিনিয়ম হয় বিলায়েত হোসেনের সঙ্গে। পাশে তার সহধর্মিণী তাহমিনা রিতা। বিলায়েত বললেন, এটা প্রচলিত সমাজেরই মূল্যায়ন। চমৎকার একরাশ হাসি তাদের মুখে তখন।
বহুমুখী সমাজটাকে যে যার মতো চালিয়ে নিতে চায়। ভণ্ড যোগিনী জগৎ যামিনী ভূমিকায় রূপ দিয়েছেন শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য। মানুষ আসছে তার কাছে আর তিনি তার কেরামতি দেখাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে লাভ করছেন মুদ্রা, গাড়ি ইত্যাদি পারিতোষিক। সবিতা নামের তরুণী বুঝতে পারেন তার ফাঁকিবাজি।

এখানে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাস সামনে আসে। সেখানে আছে এক মাসি। তিনি ঝুমুর দল চালান। বাসন্তী-বসন এই দলে গান গায়। তারও টনটনে কথা দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য, বসন মাসির টাকার দিকে তাকায়নি। অন্যদিকে সবিতা বুঝিয়ে দিয়েছেন এখানে ভাগাভাগি যৌক্তিক। এও সত্য মাসি যতটা সন্তানবৎসল, জগৎ যামিনী ততটাই যান্ত্রিক।
নাটকে শ্রোতারা কবিতা নামে এক তরুণীর মুখে শোনেন, বউকে পুষতে পারিস না আবার বড় বড় কথা, এমন কিছু বয়ান। আপাতদৃষ্টিতে এ সবে গায়ের মেয়ের তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায় বটে। তবে ভেতরে থাকে এক সমুদ্দুর ভালোবাসা। আদিবাসী সমাজের চিত্র এটা। তরুণীর মুখে আরও কিছু সংলাপ জুড়ে দেওয়া হয়েছে যা প্রকৃত অর্থে বাধা-বন্ধনহীন তারুণ্যের জয়গানই। প্রগতিশীল রাজনীতির নামে এক নেতা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে চলেছেন। সন্তান তার আমেরিকায় পাঠ নিচ্ছেন। অথচ তার জীবনে সুশিক্ষার চর্চা নেই। অসৎ ব্যবসায়ী ওষুধে অপকারী জিনিস মিলিয়ে বাজার সয়লাব করে। এ নিয়ে পান্না লালের ভূমিকায় শুভাশীষ চট্টোপাধ্যায় পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। লিলি তার অফিস সেক্রেটারি। যুবতী প্রতিবাদ করেন তার অফিস কর্তার ঘৃণ্যতায়। চাকরি থেকে সরে যাবেন বলেও জানিয়ে দেন। এও নাট্যকারের বড় সৃষ্টি। বৈলালী সরকারের তেজস্বী উচ্চারণে তখন আসলেই যেন কেঁপে ওঠে চরাচর। আছে নেংটি তরফদার। রাজনৈতিক কর্মী, মাস্তানও বলা যায়। স্বর্গে গিয়েও সে কোনো কিছু মানে না। আলো আঁধারি মঞ্চে অয়ন চক্রবর্তীর অস্থিরতা নেংটি চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে অসফল বলা যাবে না।
আবার নরক গুলজার মূলত একটি প্রতীকী নাটক। দেশ চালায় রাজা, মন্ত্রী, সাংসদেরা। নাট্যকার ব্রহ্মা, বিষ্ণু শিব চরিত্র এনে ক্ষেত্রটার বিশালত্ব দাঁড় করিয়েছেন। শিব পার্বতীকে রেখে গাঁজার আসরে বিভোর। শুরুটা এমন চমক দিয়েই। প্রশান্ত বসু বেশ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন অভিনয়ে। এদিকে নারায়ণ নারায়ণ বলে মুখে ফোয়ারা তুলছেন নারদ। জয়দ্বীপ রায় এখানে এক ধরনের আকর্ষণ আনতে পেরেছেন। ব্রহ্মা চরিত্রে উদয় মুখার্জি শ্রোতার মনে দাগ কেটেছেন। শুভ নব সরকারকে বিষ্ণুর রূপায়ণে দর্শকেরা মনে রাখবেন তার সংলাপের পাশাপাশি।
আমার ডান পাশে কৌশিক দত্ত। ফিল্ম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। সেইভাবেই পরিচয়। আজ কথা হচ্ছে নাটক নিয়ে। কী সুন্দর করে তিনি ব্যাখ্যা করছেন মঞ্চকে! বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলছে সমাজ। জীবন এখানে হাবুডুবু খাচ্ছে। রাজসভা এ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। হ্যাঁ যমই এমন কাউকে ভব নদীর ওপারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু অবস্থা হলো বেগতিক। এই চিত্রটি তখনই বেশি মাত্রায় আলোচিত হয় যখন কয়েক হাজার নির্মাণ কর্মীকে এক যোগে মেরে ফেলা হয়। পরপার গিয়েও ওরা নিয়মনীতি মানছে না। এদিক ওদিক-দুই দিকেই টালমাটাল অবস্থা।
রাজসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নেংটিকে বশে আনার জন্য রম্ভাকে উপঢৌকন দেওয়ার। কিন্তু না, সে লিলিকে চায়। পরপার থেকে মানুষকে ফেরত আনার কথা ওঠে। কিন্তু কাকে কাকে আনবে! চিত্র গুপ্তের কাছে যে তালিকা তাও সঠিকভাবে করা হয়নি। কিংবা অসম্পূর্ণ। দেশ শাসনে এও এক দেউলিয়াত্ব যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ডকুমেন্টের ওপরও নির্ভর করা যায় না। নাট্যকার যুগ্মভাবেই এই দিকটি শনাক্ত করেছেন। আবার মানুষ মারা শেষে তাকে ফিরিয়ে আনারও কোনো পথ নেই। যমই বলেন, আমরা কেবল মরতে পারি, একটি জীবন দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। অতনু ব্যানার্জি এই দার্শনিক সত্যটি এনেছেন দার্শনিকের মতোই। এ পর্যায়ে সমস্যা নিরসনে সংবিধান সংশোধনীর সুপারিশ আসে।

কিন্তু মানুষ ক্ষেপে যায়। তারা চায় না এমনটি। শুদ্ধির দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ছন্দা ভাদুড়ি সাংহাইয়ের কণ্ঠে সবিতা কবিতা জনতার বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয়-কেইবা বলবে, কেইবা করবে, কেইবা সইবে, কেইবা মরবে এমন প্রশ্ন সামনে আসে। ছন্দা শ্রোতাদের আনুকূল্য পান। অতঃপর দাবির মুখে সংবিধানের সংশোধনী স্থগিত রাখা হয়। নাটক এই পর্যন্তই। ফিরে যাই শুরুতে। মঞ্চ প্রস্তুত। আমি ও অধ্যাপক মীর আনিসুল হাসান দেখা করলাম নাট্যকার পরিচালকের সঙ্গে। এ আমাদের শুভেচ্ছা সাক্ষাৎ। তন্দ্রা মুখার্জি এগিয়ে এলেন। স্বাগত জানালেন সামনের সারিতে। এ সম্মান এপার বাংলার।
তারপর দীর্ঘক্ষণ নাটক দেখা। অভিনয়ের ফাঁকে ছোটখাটো মতো বিনিময়। প্রতিটি অঙ্কের শেষে ধ্রুপদি গানের সুর এসেছে। সে এক মোহন সময়। সমাপ্তিতেও তাই। সবাই নেমে এসেছে সামনে। আমরা অভিনেতা অভিনেত্রীদের ধন্যবাদ জানাই। তারা বিনয়ে সবাই নেমে এসেছে সামনে। আমরা অভিনেত্রীদের ধন্যবাদ জানাই। তারা বিনয়ে মাথা নোয়ান। বুক ভরে ওঠে। কারণ, এ সম্মান প্রিয় বাংলার, প্রাণের বাংলার এপার বাংলার নাট্যকারকে অভিনন্দন জানাই। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, এই বালির দেশে শান্তির বারি! হাত মেলাই। আরও অনুসারীরা পাশে। এক জায়গায় জড়ো হয়ে পড়ি। ক্লিক ক্লিক শব্দ আলো ছড়ায় প্রকৌশলী অনুপমের মুখে তৃপ্তির হাসি। রাখী পাল বলেন, কী আনন্দ! মিতা কণ্ডু মন্তব্য, শেষটার মজাও অন্যরকম।
প্রতি বছরই রানা মুখার্জি একটা নয় এক জোড়া নাটক মঞ্চস্থ করেন। এর আগেও পর পর দুই বছর তার নাটক দেখার সুযোগ হয়। বাংলাদেশ স্কুল অডিটোরিয়ামে গত বছরে অভিনীত নাটক ছিল-রিটায়ার্ড স্বীকৃতি। আমারই মুখে আসে প্রসঙ্গটি। ধ্রুপদি গানে তখনো বাজে। আমরা এগোই।