নরডিক দেশে দিবা পরিচর্যা কেন্দ্রে আমাদের শিশুরা

উন্নত জীবনের নামে প্রবাসে আসার সমীরণ আমাদের সহজ সরল পরিচয়কে হরণ করে আশ্রয় নামক অভিবাসী শব্দকে বরণ করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আমদের শিশুর পরিচয় মানে তাদের বেড়ে ওঠাকে আমরা কখনো আমাদের বর্তমান পরিচয়ের (অভিবাসী) বেষ্টনীতে দেখতে চাই না। তাই প্রবাসী বাংলাদেশি হয়ে নতুন জীবন গড়ার যুদ্ধে আমরা আমাদের আদরের শিশুদের রেখে আসি বা আসতে বাধ্য হই ভিনদেশি সংস্কৃতির ধ্যানধারণায় পরিচালিত শিশু দিবা-পরিচর্যাকেন্দ্রে।
এই শিশুকেন্দ্রের সংক্ষিপ্ত নাম এসডিপিকে। যেখানে আমাদের নিকটতম ভবিষ্যৎ জীবনের ধারক-বাহক তথা বাংলাদেশি পরিবারের শিশুরা তাদের জেগে থাকা সময়ের বেশির ভাগ সময় অবস্থান করে। শিশুর জেগে থাকা অবস্থাতেই একটি শিশুকে শেখায় বা শেখাতে সহযোগিতা করে তার দেশের কাঠামোগত সামাজিক রীতিনীতি।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের প্রবাসী বাঙালি শিশু যারা তাদের বেশির ভাগ সময়ই এসডিপিকেতে অবস্থান করে তারা যা দেখছে, শুনছে ও মনে মনে রপ্ত করছে তা কতটা আমাদের জাতীয় মূল্যবোধ কিংবা বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে? অভিবাসী অভিভাবক হিসেবে আমরা কখনো কি এই বিষয়টা একটু হলেও ভেবে দেখেছি?
এখন আপনার জাগ্রত চৈতন্য আপনাকে বলতে পারে, কেন আবার আমদের নরডিক দেশের এসডিপিকে নিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্নের অবতারণার প্রয়োজন হলো। এটা খুবই সঠিক কথা। অনেক কারণের মাঝে একটি কারণ হলো আমরা বাংলাদেশিরা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা কিংবা ইউরোপের যেকোনো দেশে অভিবাসীর খাতায় নাম লিখেছি আক্ষরিক অর্থে মূলত উন্নত জীবনের নামে অর্থলিপ্সা বা অর্থ লালসার অর্থবহ দিকটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য। এটা আমার কিংবা আপনার অনেক আশার মাঝে উল্লেখযোগ্য বড় আশা; তাই নয় কি? এই আশার মরীচিকায় বিশেষত ইউরোপ তথা নরডিক দেশের এসডিপিকেতে আমাদের শিশুরা হারাতে বসেছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবোধ।

ওপরের প্রসঙ্গে আলোকপাত করার আগে আমাদেরই সৃষ্টি বারুদ (বাংলাও না ইঊরোপও না) দৃশ্য দেখার নয়ন দুটিকে ক্ষণিকের জন্য আকর্ষণ করার চেষ্টা করব দুটি বিষয়ের ওপরে। প্রথমত, কেন আমি আপনাদের উন্নত জীবন লাভের আশায় ছদ্মনাম অর্থ প্রলুব্ধ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টায় রত এবং দ্বিতীয়ত, কেন ইউরোপের এসডিপিকে বিশেষত নরডিক দেশের উদাহরণ টেনে আনার চেষ্টা করলাম।
ওপরের প্রশ্ন দুটো কি শুধুই প্রশ্নের সমীরণে বহমান নাকি পরজীবী গাছের মতো আমাদের দুর্বল চিত্তের লুক্কায়িত জানার আগ্রহ। আবার এ জানার আগ্রহকে অনেক অভিবাসী অভিভাবকেরা জিঘাংসায় রূপ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না! এই শ্রেণির মানুষের দাম্ভিকতায় চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে তাদের অর্থ লালসায় পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। যা দেখতে পাই আমাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার চারপাশে। এটাকে দেখতে চাওয়া নয় বরং দেখতে পাওয়াটা আমাদের ভ্রুকুঞ্চিত করলেও তাকে দেখতে হয় বা দেখতে হবে স্বাভাবিক ভাবে। যেভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের দেখতে হয়েছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলার মিথ্যা প্রহসনমূলক মৃত্যুকে। তাই কথায় কথায় আজও আমাদের শুনতে হয়, উপায় নাই গোলাম হোসেন!
যা হোক, যে প্রসঙ্গে বলছিলাম, আমাদের ওই অর্থ লালসায় পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার মানুষকে দেখতেই হবে! কারণ, আমি ও আপনার মতো সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন হাজারো মানুষ ও দার্শনিকদের দৃষ্টিতে মানুষ অভিবাসী হয় সেখানেই, যেখানে খুঁজে পায় নিজেদের (similarities in the language, communication, culture and religion)। এর প্রমাণ হিসেবে রয়েছে হাজারো প্রতিবেদন ও বিজ্ঞান নির্ভর প্রবন্ধ। যেমন, সদ্য প্রকাশিত সমাজ বিজ্ঞানী Abul Hadi Sulaiman (২০১৪)–এর প্রবন্ধে আমরা দেখতে পাই, প্রাচীন rulers ও colonization period থেকে অধিকাংশ প্রবাসগামী মানুষ অভিবাসীর খাতায় নাম লিখতে শুরু করেছে ওপরে আলোচিত বিষয়গুলোকে সামনে রেখে। কিন্তু আজকে আমরা কোন বিষয়কে সামনে রেখে অভিবাসী হয়েছি উন্নত দেশগুলোর একটি জোন নরডিক এলাকায়?
ওপরের প্রশ্নের উত্তরে অনেকে হয়তো বলতে পারেন এভাবে যে, ওয়েলফেয়ার স্টেটের মডেল হিসেবে নরডিক জোনের দেশগুলো সমাদৃত হয়েছে পৃথিবীর বহু সৃজনশীল চিন্তাবিদ মানুষের কাছে। তাই আমরা অভিবাসী হয়েছি নরডিক জোনের দেশগুলোতে। কিন্তু তার পরেও আমাদের জানতে ও মানতে হবে বর্তমানেও নরডিক রাষ্ট্র প্রধানদের রাষ্ট্র পরিচালনায় রয়েছে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা। যেমন, অভিবাসী অভিভাবকের পরিচয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের দিবা পরিচর্যাকেন্দ্র নিয়ে প্রবন্ধ রচনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সমাজ বিজ্ঞানী Katja Frosen–এর মতে, Welfare State–এর সরকারগুলো নিজ দেশীয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সকল জনগণকে রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধার আওতায় আনার চেষ্টা করলেও তাতে রয়েছে অনেক দুর্বলতা। কেননা National family policy model in Nordic Countries is not clearly defined. এটা আমাদের বিশেষ করে অভিবাসী পরিচয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের পরিচর্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কেননা, শিশুনীতি প্রণেতারা তাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির দর্শনকে সামনে রেখে যে structural child welfare model তৈরি করেছেন তা আপনার, আমার ও আমাদের শিশুদের শিকড়ের পরিচয় রক্ষা ও তার ঐতিহ্যবাহী ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে অনেকটাই পশ্চাৎপদ। তার পরেও আমরা আমাদের শিশুদের এসডিপিকেতে রাখি বা রাখতে হয়। যেহেতু আমাদের অন্য কোনো option বা choice নাই। কিন্তু এ কথা বলেই কি আমরা আমাদের মন থেকে শিশুদের কাছে থেকে ভবিষ্যৎ চাওয়া-পাওয়া-আকাঙ্খাকে মুছে ফেলতে পারি? তবে এ কথা বলে আমরা হয়তো দূরে থাকতে পারি বা দূরে থাকতে চাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে! এই দূরে থাকার চাওয়াটা আমাদের দায়িত্ববোধ হীনতা। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের কাছ থেকে আমাদের চাওয়ার বাস্তবতাকে আমি আত্মঘাতী হিসেবে দেখতে পাই!

এখন দেখা যাক আমরা আমাদের শিশুদের এসডিপিকেতে পাঠিয়ে আত্মঘাতীমূলক কাজ করছি নাকি দায়িত্বহীনতা প্রকাশ করছি। একজন অভিভাবক হিসেবে প্রশ্ন করে দেখুন তো, আপনি কখনো আপনার শিশুর এসডিপিকেতে থাকা অবস্থায় তার চাল-চলন, কথাবার্তা ও অন্যান্য সবকিছু পর্যবেক্ষণ বা ফলোআপ করেছেন কি না। করলে নিশ্চিত আপনারা দেখতে পেতেন আপনার শিশুরা কতটা ও কীভাবে প্রাণবন্ত সময় কাটাচ্ছে এসডিপিকেতে! উদাহরণ হিসেবে আমি এক বন্ধুর চার-পাঁচ বয়সের শিশু বাচ্চাটিকে কাজের শেষে ওই এসডিপিকে থেকে আনতে গিয়ে দেখি, বন্ধুর শিশুটি একাকী এই এসডিপিকের এক কোনায় মাটির ওপর বসে পাথর কুড়ে ভরছে তার ছোট্ট পকেটে। অন্যদিকে তার সমবয়সী বাচ্চারা দলগত ভাবে না হয় দুজনে একত্রে মিলে বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ কার্যক্রমে আত্মনিমগ্ন। অর্থাৎ আমার বন্ধুর শিশু বাচ্চাটি একটু হলেও নিজেকে আলাদাভাবে দেখছে বলেই ও একাকী খেলাধুলা করছে। আমি শিশু সেবা নিয়ে গবেষণা কাজে যুক্ত থাকার কারণে ফলোআপের মাধ্যমে জানতে পারি শিশুটি একাকী থাকতেই ভালোবাসে। শিশুর মানসিক উন্নয়ন কর্মে নিয়োজিত গবেষকদের মতে এ অবস্থায় ওই শিশুটির জন্য প্রয়োজন একটি অভিবাসী শিশু পরিচর্যাকেন্দ্র। যেখানে বেশির ভাগ শিশুরই পরিচয় হবে অভিবাসী বাবা-মা। যা তাকে প্রাণবন্ত করতে সহযোগিতা করবে। কারণ প্রত্যেক শিশুই পছন্দ করে একটি comprehensive chid service centre। অভিবাসী অভিভাবক হিসেবে একটু হলেও এই বিষয়ে আমাদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়াটা উচিত নয় কি? নতুবা বর্তমানে আমাদের শিশুরা দিবা পরিচর্যাকেন্দ্রে অবস্থান করে তাদের যে শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন ঘটছে, ঠিক সেই কাঠামোগত আলোকেই তারা বড় হয়ে আমাদের উপহার দেবে একটি নতুন জীবন মাত্রা। যেখানে আমরা আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবোধকে দেখতে পাব বা দেখতে হবে অনেকটাই রোগে-শোকে-ক্ষুধায় কঙ্কালসার এক অন্য গ্রহের মানুষের মতো। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি চাই। আমরা চাই আমদের শিশুরা প্রবাসী শিশু দিবা পরিচর্যাকেন্দ্রে থেকেও তাদের চিন্তা-চেতনায়, মন-মননে স্থান পাবে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির মূল্যবোধ।
অতি সংক্ষেপে ওপরে আলোচিত বিষয়সমূহ আলোচনার প্রেক্ষিতে আমাদের যা করা অত্যাবশ্যকীয় তা হলো; (১) আমাদের শিশুদের জন্য বের করতে হবে Day care centre for immigrant children; (২) শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের কার্যক্রমের ওপর observation and follow-up অব্যাহত রাখতে হবে; (৩) প্রত্যেক শিশুই যেহেতু অনুকরণ ও অনুসরণ প্রিয়; তাই দিবা পরিচর্যা কেন্দ্রের বাইরে যতটা সম্ভব আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে শিশুর বেড়ে ওঠা পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং (৪) আপনার ও আমার শিশুর পরিচর্যাকারীদের জানাতে ও বুঝাতে হবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধ্যান-ধারণা। এই কাজগুলো করতে না পারলে (ক) শিশুরা যেমন হবে দেশের সংস্কৃতি-অধিকার থেকে বঞ্চিত, তেমনিভাবে (খ) আমরা আমাদের বয়সের পড়ন্ত বিকেলের সূর্যকে দেখে মনে হবে ঘোর আমাবষ্যার রাত। পাশাপাশি আমাদের এটাও মনে রাখলে হয়তো ভালো হবে যে জীবনের সকল সন্ধ্যাই অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়, এর মাঝেও শুভ সন্ধ্যার পদার্পণ ঘটতে পারে। এখানে শুভ সন্ধ্যার পদার্পণটাই হচ্ছে আমাদের প্রচেষ্টা। যে প্রচেষ্টা হবে শুধুই আমাদের শিশুর জন্য। অর্থাৎ আমাদের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে শিশুরা পাবে তাদের একটি মন মুগ্ধকর সেবা প্রতিষ্ঠান (আমি আবারও একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটালাম) যেমন, Day care centre for immigrant children.
(লেখক সমাজ বিজ্ঞানী ও শিশু গবেষক, হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ড)