দ-হ-ন
এক
আকাশ আর পূর্ণতার জম্মের পর রূপার একটু কষ্টই হচ্ছিল। এক ছেলেসন্তান থাকলে মানুষ করা যায় না—এমন ধারণাও ছিল তার বেশ প্রবল! আর তার স্বামীও ভাবল, মনে হয় তিন সন্তান হলে মন্দ হবে না। একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার আর আরেকজন তাদের মতো শিক্ষক হোক। রূপা চাইছিল তা-ই; চাইছিল অমিতও। আর তাদের তো আসলে তিন বা চারজন সন্তান নেওয়ার সাধ্য রয়েছেই এমন ভাবও ছিল প্রবলভাবেই এবং তা দুজনের মধ্যেই।
রূপা চাইছিল, ঝুট-ঝামেলা যা করার একবারে শেষ করে ফেলবে, ছেলে-মেয়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে, মানুষ করে একটু ফ্রি থাকবে! জামাইটারে নিয়ে তিড়িংবিড়িং করে ঘুরে বেড়াবে এদেশ-ওদেশ। অমিতও তার সঙ্গে হ্যাঁ, হ্যাঁ করছে সবকিছুতে। আসলে অমিত তার কোনো কিছুতেই খুব বেশি দ্বিমত করে না। হয়তো সংগত কোনো কারণ আছে। যা আমি জানি না। সে সব সময় ‘আমার মনে হয় ভালো হবে; খারাপ হবে না; মন্দ নয় আইডিয়াটা’—এমন সব কথা বলে বেশির ভাগ সময়ে রূপাকে খুশি রাখে। ভালোবাসাটা প্রকাশ করে ওইভাবেই! আসলে অমিত এসব নিয়ে খুব একটা ভাবেও না! রূপা খুব খুশি হয় আর অমিতের খুব ভালো লাগে তাঁকে খুশি দেখতে।
দুই
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই সোনা চলে এল! সোনা গর্ভে এল আর রূপা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল! শারীরিক অবস্থা খুব খারাপের দিকে গেল! অমিতের ডাক্তার বন্ধুরা পরামর্শ দিল, ‘খুব ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে; তোমার ডিসাইড করা উচিত বউদিকে সেভ করবে, না সন্তান সেভ করবে?’
অমিত খুব দুশ্চিন্তায়। একবার ভাবল, ‘এক ছেলে এক মেয়ে আছে, ক্যান রিস্ক নেবে সে?’ আবার ভাবল, ‘আমি বাবা হয়ে কেন সন্তানের এমন চাইছি? আমি কি নিজের সন্তানের খুনি হওয়ার নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না? না, না, আমার সন্তান সেভ করা উচিত!’
আবার ভাবে, আমি রূপাকে হারাতে চাচ্ছি কেন? 'To be or not to be' এসব ভাবতে ভাবতে অমিত অস্থির। ঘুম হয় না তার ইদানীং। সিগারেট টানে আর খুব ঘামে সে সারা রাত! অমিতের বালিশ ভিজে যায়। নিজেকে নিয়তির কাছে বড় অসহায় মনে হয়। কী করবে ভেবে কূলকিনারা পায় না সে। দম বন্ধ হয়ে আসে তার...
একবার ভাবল, রূপার সঙ্গে খুলে কথা বলবে এই নিয়ে। আবার ভাবে থাক। ‘শুধু শুধু ওর কষ্ট বাড়াই কেন?’ তবু কথা বলে সে। সরাসরি না, তাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বোঝায়, ‘আসলে আমাদের সন্তান নেওয়ার ডিসিশনটা ভুল হয়ে গেছে! আর ডাক্তার আমাকে টেলিফোনে যা বললেন আমি তা অনেকটা এমন, তোমার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না, ওষুধ খেতে হচ্ছে প্রচুর। এই অবস্থায় সন্তান নিলে সন্তানের জন্য ক্ষতি হতে পারে! অস্বাভাবিক সন্তান আসতে পারে! এমন হতে পারে সন্তান অথবা মাকে সেভ করার প্রশ্ন আসতে পারে।’ এ কথা শুনে রূপাও খুব বিচলিত। কিন্তু রূপাও চায় সন্তান বাঁচুক! নিজে যদি মরতেও হয়, সে সন্তানকেই বাঁচাবে...
চোখ বন্ধ করে ডিসিশনটা নিয়ে ফেলে মনে মনে অমিত। রূপাকেই সেভ করবে সে। রূপাকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেও বলল। রূপা খুব কান্নাকাটি করছে। অমিত ভাব দেখাচ্ছে সে খুব শক্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুবই নার্ভাস সে। অমিত তার স্ত্রীকে বলে, ‘এক ছেলে, এক মেয়ে আছে আমাদের। আর সন্তানের দরকার নেই! আমরা আজই ময়মনসিংহ যাচ্ছি।’ ‘তুমি এত নিষ্ঠুর পিতা! তোমাকে আসলে দেবতার মতো ভাবতাম আমি! কিন্তু তুমিও অতি সাধারণ মানুষ! খুব স্বার্থপর তুমি! প্লিজ, একা থাকতে দাও। আমার সামনে থেকে যাও, প্লিজ...’, এই বলে কপাল কুঁচকায় রূপা। অমিত চোখ বড় করে বলে, 'It's my final decision. The unknown one (baby) is future! I care for the present only! Don't bother please! Get ready. I need wife, not more children!'
তিন
ডাক্তারের জন্য ওয়েট করছে আর খুব ঘামছে অমিত। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, ‘সন্তান ব্যথামুক্ত অবস্থায় অপসারণ সম্ভব! এক-দুই মাস এমন কিছু নয় এবং এ জন্য দুই থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগবে মাত্র। ভয়ের কিছুই নেই! আমরা তিন মাস পর্যন্ত কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই ক্লিয়ার করতে পারি! আর খরচটাও খুবই সামান্য, ছয় হাজার টাকা, যদি ব্যথামুক্ত এমআর চান!’ অমিত বলল, ‘এক্সকিউজ মি ডাক্তার, পাঁচ মিনিট পর আমরা আসছি!’ এই বলে রূপাকে বাইরে নিয়ে এল হাত ধরে! বলল, ‘রূপা, আমি খুব দুঃখিত এবং বিব্রত! আমি...আমি মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি! কাল আসি আবার? চলো, আজ চলে যাই!’ সে ফ্যালফ্যাল করে অমিতের দিকে একবার তাকাল আর বলল, ‘আমি একবার ভাবলাম, তোমাকে বলি তুমি টাকা নাওনি সাথে; তুমি সব সময় এমনই, চলো... ডাক্তারকে বলে যাবে না?’ এরপর অনেকক্ষণ দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না...
অমিত রূপাকে নিয়ে প্রেসক্লাবে গেল। গেল কফি হাউসেও। তার প্রিয়
খাবার চিকেন বিরিয়ানি খাওয়াল! রূপা আসতে করে বলল, ‘বিল দেওয়ার টাকা আছে তো?’ অমিত বলল, আছে...
চার
গাড়িতে বাড়ি ফিরছে তারা। এক ঘণ্টার জার্নি। অমিত সারা রাস্তা রূপার হাত ধরে চুপচাপ বসে আছে। কোনো কথা হলো না এর মধ্যে...
বাড়ি পৌঁছে অমিত বলল, ‘রূপা, একটা কথা বলি?’
- বলো, কী? কী কথা? খুব নিচু স্বরে রূপা জিজ্ঞেস করে।
- তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম, আমি টাকা নিতে ভুলে গেছি! সরি। আসলে আমি সন্তানকে সেভ করতেই মিথ্যে বলেছিলাম। মানিব্যাগটা পকেটেই ছিল...
- তার মানে?
- তার মানে, বাবা হিসেবে আমার সন্তানকে সেভ করা উচিত! এই কথা বলে অমিত মাথা নিচু করে! চিৎকার করে কাঁদতে মন চায় তার। কিন্তু পুরুষদের কাঁদতে নেই! তাই সে কাঁদে না, একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসে শুধু...
- অমিতকে দুই হাতে ধরে রূপা বলল, ‘অমি, মা হিসেবেও আমারও তাই করা উচিত, উচিত না? আমি খুব লাকি তোমার মতো একটা ছেলেকে আমার হাজব্যান্ড হিসেবে পেয়েছি! Believe me, I feel proud for you. I honour your decision! সত্যি, আমি খুশি তোমার ডিসিশনে! আমি হাসতে হাসতে মরতে পারব আমার সন্তানের জন্য। কিন্তু আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি অমি’ বলে অমিতকে জড়িয়ে ধরে রূপা হাউমাউ করে কাঁদে...
এরপর দুজন কতক্ষণ চুপ ছিল তারা কেউ জানে না...এক ঘণ্টা! দুই ঘণ্টা! কী জানি...সন্ধ্যা নামে, বাতি জ্বলেনি ঘরে আজ। অন্ধকারে দুই মানব-মানবী পাশাপাশি বসে জীবনের জটিল হিসাব কষে চলে!
অমিতই বলল...
- তুমি রাগ করলে?
- না, কেন রাগ করব?
- এই যে আমি সিদ্ধান্ত পাল্টালাম!
- বাবা হিসেবে যা করার, তুমি তো তা-ই করছ!
- হুম্। আমি আর ভাবতে পারছি না রূপা, সব কেমন উলটপালট লাগছে...
- ডোন্ট অরি, সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে...
পাঁচ
যে সন্তানের জন্য অমিত তার রূপাকে হারাতে চেয়েছিল আর রূপা তার জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল, সেই মেয়ের আজ জম্মদিন! ওর নাম পরি! পরির মতো সুন্দর সে। এই পরির জম্মদিন এলেই একটু একটু ঘামে অমিত! কারণটা খুব সিরিয়াস কিছু না, কিন্তু খুব সিরিয়াসও। পরি বা রূপা নিশ্চয়ই কোনো দিন তাকে ক্ষমা করবে না, এমন চিন্তা শুধু শুধু!
তাদের দুই ছেলে-মেয়ে খুব তাড়াতাড়ি কথা বলা শিখেছিল। এই পরি (সোনা) যখন দুই বছরেও কথা বলছিল না, অমিত ধরেই নিয়েছিল মেয়েটি বোবা! শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিত! ওর মা কষ্ট পাবে মনে করে কখনো বলেনি! রূপাও মনে মনে এই রকমই নাকি ভেবেছিল! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তাদের সব ছেলে-মেয়েই অনেক গুছিয়ে কথা বলে!
এই পরি মেয়েটা খুব হাসিখুশি, একদম দিল খোলা, চঞ্চল, চপল আর সারা দেশ ঘুরে বেড়ানো মেয়ে। বাবা-মা ছেড়ে অন্তু মামার (রূপার কাজিন) সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো তার শখ! একদম এক বছর বয়স থেকে মামার মোটরসাইকেলে চড়ে দূর-দূরান্তে চলে যায়! ক্লাসে বরাবর প্রথম হয়, তাই তাকে মেধাবী বলাই যায়! হইচই করে থাকা তার স্বভাব!
মেয়েটার প্রায় প্রতিটি জম্মদিনে একটা না একটা প্রবলেম হয়। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কত কী হয়! কেউ মারা যায়; নতুবা কারও বিয়ে অথবা আনএভয়েডেবল প্রোগ্রাম থাকে অথবা তীর্থ থাকে! এবারও তার জম্মদিনে বারোয়ারি তীর্থ। এবার সে প্রতিবাদ করেই বসেছে! তার অভিযোগ, সবার জম্মদিন ঘটা করে পালিত হয় বাড়িতে, শুধু তারটাই হয় না! ওর দিদি পূর্ণতা ক্লাস সিক্সে পড়ে। তার মতে, ‘তোর জম্মদিনটা একটা কুফা!’ পরি তা মানতে নারাজ। সে বলে, ‘আমার জম্মদিনটাও শুভ; মানুষ কুফা বানায়!’
দাবি আদায়ে সে খুব সোচ্চার। যেটা সে একবার চাইবে, সেটা না পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন কায়দায় চাইতেই থাকবে। ছোটদের হলে/তার সাধ্যের মধ্যে থাকলে সে বল প্রয়োগও করবে। আর তার মামার কাছে হলে গায়ে হাত তুলে হলেও। কেউ যদি অন্যায় করে তবে সে তার প্রতিবাদ করবেই। বড় হলেও।
ছয়
তার ভাই-বোন বাবার সঙ্গে ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করত। পরি আর অরি থাকে তাদের মায়ের সঙ্গে, গ্রামে। পরিও ঢাকায় বাবার কাছে থেকে পড়াশোনার বায়না ধরল। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে স্ট্রাইক শুরু করলে তাকেও ঢাকায় আনা হলো। অমিত ভাবছিল, পুরো ফ্যামিলিটাই ঢাকায় শিফট করে ফেলবে। সে দুটো জব করে ঢাকায়। একটি পত্রিকায় সাব-এডিটর আর একটা কলেজে পড়ায়। আবার তিন ছেলে-মেয়ের যত্ন-আত্তি করা, তাদের পড়াশোনার তদারক করা একটু টাফ-ই!
একদিন কলেজ থেকে আসামাত্র মেয়েটি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কোনোমতেই তাকে আর থামানো যাচ্ছে না! পত্রিকা অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে এল কিন্তু সে তার কান্না থামাচ্ছে না। তার দিদিকে জিজ্ঞেস করল, অমি কিন্তু কোনো উত্তর পেল না।
অনেক কষ্টে তার কান্না থামানো গেল...
সে বলল, ‘বাবা, আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে! তুমি আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো! আমি মরে যাচ্ছি!’
ওর কথা শুনে অমিতের কান্না চলে এল। ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়ের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর তার বাবা কি শ্বাস নিতে পারে!
অমিত বলল, ‘মামণি, কাঁদে না; আমরা আজই গ্রামের বাড়ি চলে যাব! কী হয়েছে বলো?’
সে বলল, ‘আমাদের এক টিচার বলেছে, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না! কেন তিনি এইটা বলছেন? আমি কি এত গাধা যে আমার দ্বারা কিছুই হবে না? আমি এই স্কুলে আর পড়ব না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো, আমি শ্বাস নিতে পারছি না; আজকেই চলো...বলে আবারও চিৎকার করে কান্না!’ অগত্যা অফিস কামাই দিয়ে মেয়েকে নিয়ে রাতেই বাড়ি ফিরল তার বাবা!
সাত
মেয়ে বড় হচ্ছে! দেখতে দেখতে কবে চতুর্থ ক্লাসো উঠে গেছে! ‘মেয়ে বড় হলে একদিন ওই বিষয়টা জানবেই কোনো না কোনোভাবে। গোপন করেই কী লাভ! আমি বা রূপাই হয়তো একদিন বলে দেবে মেয়েকে! তাই আর গোপন করার চেষ্টা করলাম না! আমার মেয়ে কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে যখন জানবে, আমি নিজের সুখের জন্য তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম? রূপাই কি মনের ভুলে কখনো ভাববে না, আমি মেয়েকে বাঁচানোর অজুহাতে তাকে মেরে ফেলার ডিসিশন নিয়েছিলাম!’ মনের অজান্তে এসব একা একা ভাবে আর ঘেমে ওঠে অমিত। অমিত মনের অজান্তে ভাবে, ‘ক্ষমা চাইলেই কি তার সীমাহীন ভুলের ক্ষমা মিলবে? অমিত দুঃখের দহনে পোড়ে। এই দহন শেষ হবার নয়...