দেশ ছেড়ে এলে বোঝা যায় দেশ ও মাতৃভাষা কী

‘নানান দেশের নানান ভাষা
বিনে স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা?’
জাপানে আসার পর এ দুটো লাইন আমি মর্মে মর্মে টের পেয়েছি। ভিনদেশ থেকে আসা একজন বাঙালি নারীর কাছে সম্পূর্ণ অচেনা আর ভিন্ন ধরনের ভাষা অদ্ভুত শোনাবে সেটাই স্বাভাবিক। তার ওপর যদি আগে থেকে জাপানি ভাষার ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকে, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। একেবারে মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা এক এলিয়েন যার ভাষা কেউ বোঝে না, আবার সেও কারও ভাষা বোঝে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
যা হোক, যেহেতু বাংলাদেশ থেকে জাপানি ভাষা রপ্ত করে আসিনি তাই জাপানে এসেই বই-খাতা নিয়ে বসে পড়লাম। শুরু করলাম শব্দার্থ দিয়ে। কোনটাকে কী বলে সেটা জানলেও অনেকটা কাজে লাগবে। মোটামুটি এক মাসের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ শব্দ মুখস্থ করে ফেললাম। এর মধ্যে আবার আমার এক আত্মীয় আমাকে একটা চাকরি জুটিয়ে দিলেন। একজন ভাষা জ্ঞানহীন মানুষ জাপানে আসতে না আসতেই জাপানিজ কাইশা মানে কোম্পানিতে কাজ করতে গেল। বিভীষিকাময় সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়লে এখনো আমার জ্বর আসে। চিড়িয়াখানার জন্তুকেও মনে হয় এভাবে কেউ দেখে না। আমার মস্তিষ্ক থেকে সাড়ে পাঁচ শ জাপানিজ শব্দ মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল। শব্দ শিখেছি কিন্তু বাক্য তৈরি তো শিখিনি! বুক ফেটে কান্না আসছিল সেদিন...আ মরি বাংলা ভাষা। আহারে আমার দেশের মাটিতে আমি কত স্বচ্ছন্দে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলি। আর এখানে কতটা অসহায় পরিস্থিতিতে পড়েছি শুধুমাত্র তাদের ভাষায় কথা বলতে পারি না বলে। দু–একজন ইংরেজি জানত, তারা সেদিন আমায় সহযোগিতা করেছিল।
জাপানে আসার পর শুধুমাত্র ভাষা না জানার জন্য আমি যে কত ধরনের ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। ইংরেজিতে পারদর্শিতার কারণে চাকরিতে মোটামুটি টিকে গিয়েছিলাম। কিন্তু পথেঘাটে বের হলে চোখে অন্ধকার দেখতাম। এ জাতি ইংরেজি ভাষায় ততটা দক্ষ নয়। আর তারা নিজের ভাষাতেই কথা বলে। এমনকি রাস্তায় সাইনবোর্ডেও ইংরেজি তেমন চোখে পড়ে না। আমার শুধু ভয় লাগত, যদি হারিয়ে যাই! এই হারিয়ে যাওয়ার ভয় করতে করতে একদিন সত্যিই হারিয়ে গেলাম। আট নম্বর বাসের জায়গায় দশ নম্বর বাসে উঠে পড়লাম। কিছু দূর যাওয়ার পর বুঝলাম, আমি ভুল বাসে যাত্রা শুরু করেছি। ভাঙা ভাঙা জাপানিজ শব্দ দিয়েই চালককে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়? চালক জানাল, আমি পুরো উল্টো পথে চলে এসেছি। উপায়ন্তর না দেখে বাড়িতে ফোন দিলাম। পরে চালকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলাম। তিনি আমাকে দয়া করে একটা স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ট্রেন দেখিয়ে দিলেন, আবার আগের পথে ফিরে যেতে।

আরেকবার কাজ শেষ করে ফিরছিলাম বাড়ির পথে। প্রচণ্ড ক্লান্ত। জাপানে প্রত্যেক রেলস্টেশনের প্রবেশ পথে কার্ড স্পর্শ করতে হয়। কার্ড স্পর্শ করলে প্রবেশ দ্বার খুলে যায় নতুবা খোলে না। কিন্তু সেই রেলস্টেশনটা ছিল অনেক দিন আগের পুরোনো। সেখানে কোনো প্রবেশ দ্বার ছিল না। আমি মনের ভুলে কার্ড স্পর্শ না করেই ট্রেনে চেপে বসলাম। হঠাৎ বোধোদয় হলো, আমি তো কার্ড স্পর্শ করিনি। নিজেকে সে সময় একজন বড় ধরনের অপরাধী মনে হচ্ছিল। বিনা টিকিটে বাসায় যাচ্ছি। নিজেকে কেন জানি চোর চোর মনে হচ্ছিল। জীবনে কোনো দিন সততা থেকে এক পা পিছু হটিনি। আর আজ কিনা নিজের অমনোযোগিতার জন্য এমন অন্যায় কাজ করতে বসেছি।
বিবেকের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে পরের স্টেশনেই নেমে পড়লাম। নেমেই গেলাম স্টেশন মাস্টারের কাছে। কিন্তু কী বলব? ভাষায় তো ব-কলম। পরে ইশারায় কার্ড দেখিয়ে সোজা বাংলায় বললাম, কার্ড পাঞ্চ করি নাই...আমার বারবার না সূচক হাত নাড়ানো দেখেই স্টেশন মাস্টার বুঝে ফেললেন। বললেন, আমি যে স্টেশনে নামব, সেখানে দেখালেই হবে। বলে চলে গেলেন।
তখন ঠিকমতো ভাষা বলতে না পারলেও একটু একটু বুঝতাম। কিন্তু আমার মনের সংকোচ দূর হলো না। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই স্টেশন মাস্টার আবার এসে হেসেই বলে ফেললেন, দাইজোবো মানে ঠিক আছে। ট্রেনে উঠতে অনুরোধ করলেন। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। সেবার বাসায় ফেরার পথে কেবল একটা কথাই কানে বাজছিল, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।’ পরের দেশে পরের ভাষায় কথা বলতে না পেরে যে বিপদে পড়েছি আর নিজের দেশে যদি নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারতাম, তাহলে কেমন লাগত? দম বন্ধ হয়ে মরে যেতাম।
তবে জাপানে এসে একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছিলাম, এ জাতি নিজের দেশ ও নিজের ভাষাকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করে। তারা যখন কথা বলে শুধু নিজেদের ভাষাতেই বলে। সঙ্গে ইংরেজি যুক্ত করে না। অথচ আমরা বাঙালিরা, যে ভাষার জন্য এত আত্মত্যাগ সে ভাষাতে কথা বলতেও অনেক সময় দ্বিধাবোধ করি। আমরা বাংলায় না বাংলিশ ভাষায় কথা বলি। বাংলা আর ইংরেজির জগাখিচুড়ি বানিয়ে কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমাদের সন্তানদেরও ইংরেজি ভাষার প্রতি মনের অজান্তেই ছোটবেলা থেকে আকৃষ্ট করে ফেলি। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যেন বাংলাতে কথা বলতেই লজ্জাবোধ করে। এদের অভিভাবকেরা বেশ গর্ব করে বলে, পরীক্ষায় সব বিষয় এরা ভালো, শুধু বাংলায় খারাপ। আমার পক্ষ থেকে ধিক্কার ছাড়া আর কিছু দেওয়ার নেই তাদের জন্য। প্রিয় স্বদেশে থেকে যারা প্রিয় মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন না, তাদের সে দেশে থাকার অধিকারও থাকা উচিত না।
জাপানে থাকতে থাকতে এখন হয়তো কিছুটা জাপানিজ ভাষা আয়ত্ত করতে পেরেছি। কিন্তু নিজের ভাষায়, নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার যে আত্মতৃপ্তি, তা কোথাও পাই না। দেশ ছেড়ে এলে বোঝা যায় দেশ কী। মাতৃভাষা কী!
দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন ভাষার মাস। এ মাসেও যদি আমরা প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে গিয়ে অনুসন্ধান চালাই দেখব ভিনদেশি ভাষার ভিনদেশি সংস্কৃতি শোভা পাচ্ছে বেশির ভাগ বাড়িতে। তাহলে সালাম, রফিক ও জব্বারসহ এত এত ভাষা শহীদ নিজের প্রাণের বিনিময়ে বাংলা ভাষা রক্ষা করে কি লাভ হলো? সেই তো উর্দু-হিন্দি কৌশলে স্থান করে নিল বাংলার বুকে। আমরা হুজুগে বাঙালিরা আয়েশ করে নিজের ভাষার বদলে পরের ভাষা নিয়ে সময় ব্যয় করি। অথচ একেবারে ভাবি না, আমাদের মাতৃভাষা কতটা শ্রুতিমধুর, কতটা সম্মানের।
কাল একুশ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিন লাখো মানুষের ঢল নামবে শহীদ মিনারে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে পুরো শহীদ মিনার। চারদিকে শোনা যাবে সেই চিরচেনা গান: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?
তারপর সাদা-কালো শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরা তরুণ-তরুণীরা হাতে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলবে এবং যথারীতি ফেসবুকে সেই ছবি দিয়ে ভরিয়ে তুলবে। ছবির ওপরে লেখা থাকবে, Celebrating 21st February...! এটাই ধ্রুব সত্য। ভাষার প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসাটা এখন বড়ই দুষ্প্রাপ্য।
জাপানে ভাষা না জানার জন্য বাস আর রেলস্টেশনে যে বিপদে পড়েছিলাম, নিজের দেশ হলে কিন্তু এমন পরিস্থিতি কোনো দিন আমার জীবনে আসত না। কারণ আমার নিজের দেশে আমি আমার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতাম। নিজের দেশের ভাষার মর্ম তখনই বোঝা যায় যখন আমরা কোনো অচেনা ভাষার পাল্লায় পড়ি। হয়তো সে কারণেই চোখের কোণে ভেসে উঠে এ দুটো লাইন—
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনে স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা?
তাই আসুন শুধু ভাষার মাসেই নয়, সারাটি বছর আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা পোষণ করি। তাহলেই ভাষা শহীদদের আত্মা কিছুটা শান্তি পাবে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই ভাষার জন্য লড়াই করেছে, রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে। এ ভাষা গর্বের, মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে দাঁডাবার...আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকলের স্লোগান হোক একটাই—মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।