দেশটা যেভাবে হেরে যায়

বর্তমান দুনিয়ায় সম্ভবত বাংলাদেশেই সবচেয়ে সহজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায়। শিক্ষাগত যোগ্যতা সেখানে সব সময় মুখ্য নয়। রাজনৈতিক দয়া–দাক্ষিণ্য নিয়ে অনায়াসে শিক্ষক হওয়া যায়। স্নাতক পাস করে শিক্ষক হওয়া যায়। গবেষণার কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই হর-হামেশা সেখানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দুনিয়ার কোনো সভ্য-শিক্ষিত দেশে এখন পিএইচডি ও পোস্টডক গবেষণা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। অন্তত বিজ্ঞান অনুষদে তো নয়ই। হয়তো আফ্রিকার কোনো ক্ষুধাপীড়িত দেশে সম্ভব। মিয়ানমার কিংবা মঙ্গোলিয়ায় সম্ভব। তবে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানেও সম্ভব নয়। অথচ আমাদের দেশে সেটা সম্ভব।

গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তরুণ সৃষ্টিশীল প্রাণগুলো। একজন সহকারী কিংবা সহযোগী অধ্যাপক পিএইচডি করার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছেন। তাহলে কুড়ি-বাইশ বছরের মেধাবী ও উদ্যমী শিক্ষার্থীরা কোথায় গিয়ে গবেষণা শিখবে? কার কাছে গিয়ে বলবে, আমাকে গবেষণা শেখান। রিসার্চ প্রপোজাল লেখা শেখান। আর্টিকেল লেখা শেখান। এগুলোতো শিখতে হয় সে বয়সেই। ভারতের ছেলে–মেয়েরা ২৫–২৬ বছর বয়সে আইআইটিগুলো থেকে পিএইচডি করে বের হচ্ছে। আর আমাদের ছেলে-মেয়েরা? তাহলে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকব কি করে!
ইউরোপ-আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হওয়া যত কঠিন, সেটা বিবেচনা করলে তাঁদের বেতন অনেক কম। এখানে কেউ শিক্ষক হওয়ার আগে তাঁর অবশ্যই পিএইচডি থাকতে হবে। পাশাপাশি এক বা একাধিকবার পোস্টডক গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাঁর শিক্ষকতা ও গবেষণার মানের ওপর নির্ভর করে পদ স্থায়ী হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সেটা পাঁচ-সাত বছর কিংবা আরও বেশিও লাগে। অর্থাৎ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেও, তাঁর চাকরি স্থায়ী নয়। যেকোনো সময়ে তিনি চাকরি হারাতে পারেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেই কেউ নিশ্চিন্তে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারেন না। একজন শিক্ষক যেকোনো সময়ে তাঁর চাকরি হারাতে পারেন।
এসব দেশে কারও দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়ে শিক্ষক হওয়া যায় না। নেতা-নেত্রীর সুপারিশ দিয়ে কাজ হয় না। আর ম্যাট্রিক-ইন্টারমিডিয়েটে ফলাফল দিয়ে মেধা যাচাই হয় না। এখানে শিক্ষক হওয়ার পূর্বশর্ত হলো, গবেষণায় কৃতিত্ব। পিএইচডিতে কত ভালো কাজ করেছে, পোস্টডক কোথায় করেছে, কত ভালো পাবলিকেশন আছে এবং রিসার্চ প্রপোজালের মান ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকদের জবাবদিহিতায় কোনো ছাড় নেই! কারণ তারা জানেন, দুনিয়ার সবকিছু তৈরি করেন মেধাবীরা আর মেধাবীদের তৈরি করেন শিক্ষকেরা। শিক্ষকেরা হলেন কারিগরদের কারিগর। তাদের বিষয়ে হেলাফেলা করা যায় না।

লেখক
লেখক

সারা দুনিয়ার শিক্ষকেরা পড়াশোনা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। রাজনীতির সময় তাদের নেই। স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সময় সুইডেনের দুটি জাতীয় নির্বাচন পেয়েছিলাম। সেখানের শিক্ষকদের মধ্যে নির্বাচন বিষয়ক কোনো মাথাব্যথাই দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পোস্টারও চোখে পড়েনি। আমেরিকায় নির্বাচন হলো কিছুদিন আগে। এখানেও নির্বাচন নিয়ে শিক্ষকদের কোনো সাড়া-শব্দ দেখিনি। আর আমার দেশের শিক্ষকেরা ক্লাস করানোর সময় পান না কিন্তু রাজনীতি করার সময় পান। লাল-নীল দল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে অবহেলা করেন। একটা দেশের মেরুদণ্ড কী করে ভেঙে দেওয়া হয়, সেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেলেই বোঝা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের অর্থ হলো, শত-শত ছেলেমেয়েকে আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করা। এটা প্রতারণা। এটার নাম অসভ‍্যতা। শিক্ষার্থীদের ঠকানোর এই অধিকার রাষ্ট্র কিংবা এর প্রতিষ্ঠানের নেই। অথচ এই ঠকানো চলছে। এটা বন্ধ করার উদ্যোগ আমাদের নেই। আমাদের সবচেয়ে মেধাবী তরুণ-তরুণীরা প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছেন। যে বয়সে তাদের ভেতর থেকে যতটুকু সম্ভাবনা বের করা যেত সেটা বের করা যাচ্ছে না। আর এতে করে আমাদের দেশটা পিছিয়ে যায়। পৃথিবীর আধুনিকায়ন, উদ্ভাবন-আবিষ্কারের দৌড়ে আমরা হেরে যাচ্ছি। সে উপলব্ধিটুকু কি আমাদের হবে কোনো দিন!

*ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>; ফেসবুক: <www.facebook.com/rauful15>