বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর দীর্ঘ ৫০টি বছর পার হয়ে গেছে। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে আমরা যারা বড় হয়েছি, তারা নিজের পরিবার-পরিজন, গুরুজন, শিক্ষক, সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের প্রতি ভালোবাসা এগুলো দেখেছি ও শিখেছি। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সেই ৪৫ বছর পূর্বেকার সময়টাকে যদি ফিরে দেখি, তাহলে দেখতে পাব ভয়ংকর এক বড় ফারাক। ‘লালসালু’র মজিদের সেই ধর্মের আগাছা আর সুবিধাবাদী রাজনীতির ব্যবসায়ীতে দেশটা ভরে আছে। গুরুজনে শ্রদ্ধা, নৈতিকতা, শিষ্টাচার যেন সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শলিপি’র সঙ্গেই হারিয়ে গেছে। পারিবারিক মূল্যবোধ আর একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা আজ বিষয়বৃত্তি আর আত্মতুষ্টির চাহিদায় গণ্ডিবদ্ধ হয়ে স্বার্থপরতার কালো গর্তে পড়ে বিলীন প্রায়।
উন্নত জীবনযাত্রার মোহে আচ্ছন্ন এ রকম একটি নীতিবোধ অবক্ষয়িত সামাজিক আয়নার সামনে যখন আমরা দাঁড়িয়ে, তখন ১৪ আগস্ট দেখতে গিয়েছিলাম পার্থে বাওয়া আয়োজিত বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ২০২১। অনুষ্ঠানের নাম ‘প্রিয় পরিবার’ দেখে, শুরুতেই বেশ আগ্রহ জন্মেছিল।
ড. তন্ময় দেবনাথের গল্প, সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানটি দেখার পরে অনুষ্ঠানের নামের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পেলাম। আর সেই সঙ্গে বুঝলাম গল্পটি নিজের বিবেকবোধ, পারিবারিক মূল্যবোধ আর দেশকে ভালোবাসার জায়গাগুলোকে সজোরে নাড়া দিয়ে গেল। আমি কোনো পেশাদার ক্রিটিক নই, কিন্তু অনুষ্ঠানটি খুব সহজভাবে আদর্শগত যে কথাগুলো বলে গেল, তা তুলে ধরার নৈতিক তাগিদ বোধ করলাম, তাই নিচের কথাগুলো লিখিছি।
ভালোবাসা, আদর্শ, দেশভক্তি, দেশসেবা, শ্রদ্ধাবোধ আর নৈতিকতা দিয়ে সুন্দর একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে অনুষ্ঠানটিতে। সংস্কৃতি তো এমনই হওয়া উচিত। শিক্ষণীয় ইতিহাস, দেশ, ঐতিহ্য, ছন্দ, প্রথাগত সুশীল বিশ্বাস, নৃত্য, সুর, উৎসব ইত্যাদির সঙ্গে থাকবে শিশু-কিশোর আর যৌবনের সমাহার, যারা শিখবে এবং ধারণ করবে এ সংস্কৃতিকে। গল্পের শব্দযোগ আর অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্ব দেখে অনুষ্ঠানটি ঠিক এই উদ্দেশ্যেই সাজানো ছিল বলে মনে হয়েছে। প্রিয় পরিবারের পাঁচ সদস্যের অসাধারণ উপস্থাপনা আর তাদের সাবলীলতা দেখে কখনোই মনে হয়নি যে তারা এক পরিবারের সদস্য নয়। প্রথমার্ধে এমনই মন ছুঁয়ে যাওয়া অভিনয়ের মাঝে মাঝে একে একে তুলে ধরা হয়েছে ছোটদের রূপকথার কাহিনি ডালিমকুমার, নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ গল্প হিংশুটে দৈত্য, বাঙালির যৌবনের রঙের উৎসব বসন্ত আর কাবুলিওয়ালার মতো মানবতা বোধমূলক অসাধারণ গীতিনাট্য। প্রিয় পরিবারের তিন সদস্য: বাবা, মা আর দাদাভাই যখন দেশসেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য একে অন্যের প্রতি গর্ব বোধ করে কথা বলছিল, তখন পরিবারের সদস্যদের সত্যিকারের আদর্শের পরিচয় ফুটে উঠেছিল।
সামাজিক মৈত্রী আর বন্ধনের বার্তা দিয়ে, দ্বিতীয়ার্ধে তন্ময় অনুষ্ঠানটিকে আরও জমজমাট নান্দনিকতায় ভরিয়ে দিয়েছে চীন আর নেপালের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। আর তার সঙ্গে ছিল উপমহাদেশের মোগল ইতিহাসের এক চমৎকার ন্যায়বিচারের উপাখ্যান ‘মোগল–এ আজম’। মোগল সম্রাট আকবরের মহানুভবতার এই কাহিনি যে অসাধারণ দক্ষতায় উপস্থাপিত হয়েছে আর শিল্পীরা তা এত চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন, তাই এটাকে ভালো বলিউডি থিয়েট্রিক্যালের সঙ্গে তুলনা করলে খুব একটা ভুল হবে বলে মনে হয় না।
এ পর্ব যত অগ্রসর হয়েছে, ততই দেখতে পেয়েছি অনুষ্ঠানটিতে পারিবারিক মূল্যবোধ আর দেশভক্তিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ‘বিজয় রথে বাংলাদেশ’ নামের নৃত্যনাট্যের পরতে পরতে ছিল দেশের ইতিহাস–ঐতিহ্য আর দেশকে নিয়ে অসাধারণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইচ্ছা। পর্বটি দেখতে দেখতে এতই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম যে যখন দারুণ নৃত্যশৈলী দিয়ে এই কথাগুলো ফুটিয়ে তোলা হচ্ছিল, ‘বাংলাদেশ, তোমায় নিয়ে যে আরও অনেক স্বপ্ন দেখি, তোমাকে উঠতে হবে সেই উচ্চতায়। সবাই বলবে, শাবাশ বাংলাদেশ, তুমিই সেরা। স্বপ্ন দেখি, একদিন মঙ্গলে উড়বে বাংলার পতাকা, ক্রিকেট জিতে আনবে বিশ্বকাপ, অর্থনীতিতে হবে ঈর্ষণীয়, বিজ্ঞানে আনবে নোবেল জিতে। চলো বাংলাদেশ, এগিয়ে যাই সেই পথে, একসাথে’, তখন মনের অজান্তেই দারুণ উচ্ছ্বাসে হাততালি দিয়েছি আর গর্ববোধ করেছি। একই সঙ্গে মিলনায়তনে উপস্থিত ছয় শতাধিক দর্শক ও মুহুর্মুহু হাততালি দিয়ে তাঁদের মনের একই স্বপ্নের সরব জানান দিয়েছেন। আর এখানেই বলব তন্ময়ের গল্পের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
‘বিজয় রথে বাংলদেশ’ পর্বটি ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশকে নিয়ে ‘প্রিয় পরিবার’ গল্পের মূল সদস্য ‘দাদাভাইয়ের’ দেখা স্বপ্নকল্পের একটি চমৎকার মঞ্চায়ন। নৃত্য পরিচালক তাঁর অসাধারণ দক্ষতায় সেটি তুলে এনেছেন মঞ্চে। শেষ অংশে প্রিয় পরিবারের ছোট্ট দুই সদস্য দাদাভাইয়ের আদরের নাতনিরা যখন বলেছে, দেশপ্রেম তারা শিখছে তাদের বাবা, মা আর দাদাভাইয়ের কাছ থেকেই আর দাদাভাইয়ের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছে, ‘দেশটাকে নিজের পরিবারের মতো ভালোবাসলে দেশ এগিয়ে যাবেই’, তখন গল্পটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে আর গল্পকারের মতোই আমারও মনে হয়েছে, আমার দেশটা তো আমার একটা বড় পরিবারই বটে।
চমৎকার এই দেশপ্রেমমূলক সহজ পারিবারিক ভালোবাসার গল্পটি শেষ হয়েছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ‘আমরা করব জয়’ গানটি দিয়ে, যেখানে শতাধিক শিশু–কিশোর অংশগ্রহণ করে হাতে হাত ধরে যেকোনো কঠিন সময়ে একে অন্যের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে।
এ ছাড়া পুরো গল্পের মাঝে মাঝে ছিল আনুষঙ্গিক চমৎকার সব বাংলা গান। প্রিয় নায়িকা কবরীকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনও ছিল প্রাসঙ্গিক। তবে গল্পটির সম্ভাব্য একটি দুর্বলতা হতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বিজয়ের ইতিহাস উপস্থাপনে স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ না করা। বিষয়টি অন্তত সব রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়।
এমন মনোমুগ্ধকর একটি অনুষ্ঠান, যা আমার সেই ছোটবেলার আদর্শ আর নীতিবোধকে বর্তমানের অবক্ষয়িত সামাজিক আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দারুণ দক্ষতায়। তফাতটা ভেবে এবং মেপে দেখার দায়িত্ব তো পড়লই আমাদের ওপর, তা ছাড়া নিজের অবস্থান থেকে এ মূল্যবান বার্তাগুলো নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করলাম অনুষ্ঠান শেষে।
সাংস্কৃতিক সম্পাদক ড. তন্ময় দেবনাথ, সভাপতি ডা. শাহেদীন শহীদ, সাধারণ সম্পাদক তাসনীমুল গালিবসহ অনুষ্ঠান আয়োজনে অন্তর্ভুক্ত সব সদস্যের এবং বাওয়াকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন একটি সময়োপযোগী গল্প নিয়ে এবারের বার্ষিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য।