দুর্গা পূজার সেই দিনগুলো

‘ঢাকের তালে কোমর দোলে খুশিতে নাচে মন’—একসময় দুর্গা পূজার কথা মনে পড়লে এ রকম আরও অনেক গানই মাথায় বাজতো। আমি এই সুদূর প্রবাসে ব্যস্ত নগরে পাড়ি দেওয়ার আগের কথা বলছি—যখন সকালবেলা ঘড়ির অ্যালার্ম কিংবা বাচ্চার কান্না শুনে শুরু হতো না। সকাল শুরু হতো মায়ের ডাক কিংবা প্রতিবেশীর পূজার ঘণ্টার শব্দে। তখন দুর্গাপূজার আমেজ শুরু হতো মহালয়ার দিন থেকে। ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ঠাকুরমা বসে বসে চণ্ডীপাঠ শুনতো—আমিও তা শোনার চেষ্টা করেছি। বয়স কম ছিল, তাই সবকিছু বুঝতাম না। তবে ওই চণ্ডীপাঠ শোনার মধ্যে মজা ছিল। আর ছিল পূজার আগমনী বার্তা—যা হয়তো এখন এই শহরে বসে ইউটিউবের চণ্ডীপাঠ শুনে পাওয়া যাবে না।

কবিগুরু শরতের আকাশ দেখেই বোধ হয় বলেছিলেন, নীল আকাশে ভাসাল কে সাদা মেঘের ভেলা। সাদা মেঘ, শিউলি ফুল কিংবা কাশবন ছাড়াও শরতের আর একটি বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো দুর্গা পূজার আগমনী বার্তা। বর্ষার বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির শরতে এরূপ যেন জগৎ জননী দেবী দুর্গার আগমন বার্তা দেওয়ার জন্যই হয়। তখন পূজা আসবে আসবে বলে কত আয়োজন শুরু হয়ে যেত—ঘর বাড়ি পরিষ্কার করা, নতুন জামা কাপড় ও জুতা কেনা, নানা রকমের খাবার তৈরি করা—যেমন, সন্দেশ, ক্ষীর, মুড়ির লাড়ু, চিড়ার লাড়ু, পাটি সাপটা পিঠা ইত্যাদি। রিকশা ভাড়া করে ৮ / ১০টি পূজা মণ্ডপে ঘুরে বেড়াতাম। সেখানে আমার স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। তখন কী যে আনন্দ লাগত, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বান্ধবীরা সবাই মিলে পূজা মণ্ডপে ঘুরে বেড়াতাম আর ছোট ছোট দোকানগুলো থেকে টুকটাক খাবার কিনতাম।

অষ্টমীর দিন পূজা মণ্ডপে মণ্ডপে চলতো প্রসাদের বিতরণ। দশমীর দিন আবার দুর্গা বিসর্জন দেওয়ার অপেক্ষায় পূজা মণ্ডপে যেতাম। যে পুকুরে বা দিঘিতে বিসর্জন দেবে, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম প্রতিমার বিসর্জন দেওয়া পর্যন্ত। বিসর্জন শেষে বাড়িতে এসে দেখতাম, মা আর দিদা কত রকমের তরকারি রান্না করেছেন। পূজার চার দিন সবাই নিরামিষ খেত, দশমীর দিন ঘরে ঘরে বিশাল খাওয়ার আয়োজন চলতো। পূজার শেষ দিন মন খারাপ হলেও লক্ষ্মী পূজার কথা মনে করতে করতে সপ্তাহ কেটে যেত। এতক্ষণ দেশের পূজা উদ্যাপনের মধুর স্মৃতির কথা বললাম। শুনেছি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নাকি জীবনের ধারার পরিবর্তন হয়। আর যারা সেটাকে মেনে নিতে পারে না, তারা হেরে যায় জীবনের কাছে। তাইতো দুর্গা মায়ের বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের চিরচেনা জীবনটাকে বিসর্জন দিয়ে অচেনা দেশে পাড়ি দিলাম। যদিও এখন আর তেমন অচেনা মনে হয় না।

নিউইয়র্কে আসার পর প্রথম দুর্গা পূজা দেখি ২০১৩ সালে। সে দিনের দিন–তারিখ ঠিক মনে নেই, তবে মনে পড়ে প্রচণ্ড ঠান্ডা ছিল। আমি আর আমার স্বামী, দুজনই পূজা দেখার উত্তেজনার মধ্যে ছিলাম। দেশের বাইরে প্রথম পূজা দেখা বলে কথা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমরা বাসা থেকে বের হই—উদ্দেশ্য কুইন্সের পূজা মণ্ডপগুলো ঘুরে দেখা। পূজা মণ্ডপে যখন পৌঁছাই, তখন প্রায় আটটা বাজে। আমরা তখন কুইন্সে থাকতাম। আমার স্বামী আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে পার্কিং খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ফায়ার হাইডরেন্টের পাশে পার্ক করে পূজা মণ্ডপে প্রবেশ করতে করতে বেচারার অর্ধেক মজা মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল।

মডেল লেখক ও তাঁর কন্যা

ভেতরে ঢোকার পর বাকি মজাটুকুও শেষ হয়ে গেল। চারদিকে অনেক মানুষ, কিন্তু কোন চেনা মুখ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল, এ আমার দেশ না। যদিও সব দেশের মানুষই পূজাতে ছিল। চারদিকে কেমন একটা কৃত্রিমতা উপলব্ধি করছিলাম। মনে হয়, দেশের পূজাকে ভুলতে পারছিলাম না। তখন দেশের সবাইকে খুব বেশি মনে পড়ছিল। আমরা আর বেশিক্ষণ মণ্ডপে থাকতে পারিনি। এর পরের বছরগুলোতে হাতে গোনা কয়েকবার পূজা দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই দিনের মতো এত খারাপ কখনো লাগেনি। মনে হয়, জীবন বাস্তবতাটাকে মেনে নিতে পেরেছিলাম তত দিনে। এ বছরও দেবীদুর্গা আসার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু নেই সেই প্রাণোচ্ছল, পূজা উদ্যাপন করার মন–মানসিকতা। নিউইয়র্কে এখন শীত আসি আসি করছে। এখানে শীত মানে সব ঝেড়ে–ঝুড়ে প্রকৃতির বিধবা রূপ ধারণ করা। এ দেশে দুর্গাদেবীর আগমনের ক্ষেত্রে প্রকৃতির পরিবর্তনের থেকেও আয়োজকদের ছুটি থাকাটা বেশি জরুরি। অনেকের ছুটি থাকে না, তাই দেবীদর্শনও হয় না। প্রতি বছরের মতো এবারও দুর্গা পূজা আসছে। কিন্তু আগের মতো আর স্বাভাবিকভাবে উদ্যাপন করা হবে না। সবাই করোনার নিষ্ঠুর রূপ দেখে আতঙ্কিত। দেবীর রূপ তাই দেখা এ বছর হবে না।

লোকের মুখে শুনতে পেলাম, এবার নিউইয়র্কের কোথাও পূজা হবে না। প্রথমে শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণে মহামারির বাস্তবতাকে না মেনে নিয়ে উপায় ছিল না। আসছে বছর করোনামুক্ত পরিবেশে আবারও মায়ের পূজা হবে, এটাই এখন আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা।