থমকে গেছে বিপন্ন পৃথিবীর মানুষ

থেমে গেছে গোটা পৃথিবী, থমকে গেছে মানুষ। কেউ কি কখনো ভেবেছিল হঠাৎ এমন করে উল্টে যাবে জীবনের চাকা? অনিশ্চয়তার জালে জড়িয়ে পড়বে মানুষ। কোথায় হবে এর শেষ পরিণতি, কারও জানা নেই। ভাবতেই সব ওলটপালট হয়ে যায়। মনে হয়, চিরদিনের জন্য পৃথিবীটা আঁধারে ঢেকে গেছে; আর বুঝি কোনো দিন আলোর মুখ দেখব না। এই বিপর্যয়ের দ্রুত সমাধান জরুরি। অন্যথায় সামনে আরও অন্ধকার অপেক্ষা করছে। সঙ্গে যোগ হবে মহাবিপদ।
বর্তমানে আমি অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছি। এখানকার কথাই যদি ধরি, এদের খাবারের অভাব নেই। শুধু খাওয়া-পরাই কি জীবনের সব? ব্যবসা, চাকরি হারিয়ে দিশেহারা মানুষ। সঙ্গে রয়েছে বাড়ির মর্টগেজ; এ বিল-সে বিল, আরও কত কী।
নিজের চোখে দেখা এক অভিজ্ঞতার থেকে বলছি। বাড়িভাড়া, বিল পরিশোধ করতে না পেরে এমেলিয়া নামের এক আইরিশ মহিলার পরিবার কীভাবে ছারখার হয়ে গেল। মা, ছেলেমেয়ে—একেকজনকে একেক জায়গা চলে যেতে হলো।
আমি অস্ট্রেলিয়া পোস্টে কাজ করি। সেই সুবাদে অনেকেই আসে বিভিন্ন কাজে নিয়ে। তাদের মধ্যে এমেলিয়া নামের আইরিশ মহিলাটি আসত বিল পরিশোধ করতে। স্বামী ছাড়া একা থাকলে যা হয়। মালভান এলাকায় একটি তিন বেডরুমের বাড়ি ভাড়া করে থাকত সে। সেখান থেকে একটি রুম সাবলেট দিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল তার। বিল দিতে আসার সুবাদে এমেলিয়া আমার ভালো বন্ধু হয়ে উঠল। আমার রান্না ওর খুব পছন্দ। তাই মাঝেমধ্যে মাংস, ডাল রান্না করে দিতাম। তরকারি পেয়ে খুব খুশি হতো। ওর হাসিমাখা মুখ এখনো ভুলতে পারি না। দেখতে একহারা লম্বা পাতলা। খুব সুন্দরী এই এমেলিয়া। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেক বছর আগে। স্বামী থাকে আয়ারল্যান্ডে। স্বামীর ভয়ে নিজের দেশে একবার বেড়াতেও যেতে পারে না। আয়ারল্যান্ডে নাকি তার স্বামী খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি। এমেলিয়া আমার কাছে ওর জীবনের অনেক কিছু শেয়ার করত। হঠাৎ একদিন এসে বলল ডিনা, ‘আমি আর সংসার চালাতে পারছি না। সরকার যা দেয় আর একটা রুম সাবলেট দিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল কিন্তু...।’
আমি বললাম, তাহলে আবার কিন্তু কিসের! সে বলল, ‘আমি যে বাড়িতে থাকি, বাড়ির মালিক বাড়িটা হঠাৎ বিক্রি করে ফেলেছে। নোটিশ দিয়েছে বাড়ি খালি করে দিতে হবে।’ আমি ওকে বললাম, এত ভাবনার কী আছে। নতুন আরেকটা ভাড়া নাও। ও হেসে বলল, ‘আমাকে কে দেবে বাড়িভাড়া। আমার এখন চাকরি নাই। এই বাড়ি যখন ভাড়া নিয়েছিলাম তখন চাকরি ছিল। তবে চেষ্টা করছি দেখি কী করা যায়।’
এ দেশে চাকরি না থাকলে বাড়িভাড়া পাওয়া খুব মুশকিল। ও আরও বলল, ‘আমার ছেলেটা তার বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করে থাকছে।’ ছেলেটা বড়, মেয়েটা ছোট। যতটা মনে পড়ে ছেলেটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত আর পার্টটাইম চাকরি করে কোনোমতে নিজের খরচ চালাত। মেয়েটি ক্লাস নাইনে পড়ত। এর মধ্যে মাসখানেক এমেলিয়ার আর দেখা নেই। খুব চিন্তা হচ্ছিল। মাঝেমধ্যে রাতে ওর কথা মনে করে ঘুম আসত না। ভেবে হয়রান, এমন একটি দেশে থেকেও কেন তার এমন পরিস্থিতি। যা হোক, এমেলিয়া একদিন হঠাৎ করে হাসিমাখা মুখ নিয়ে উদয় হলো। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি বাড়ি খুঁজে পেয়েছ? ও বলল, ‘না, পাইনি। কান্ট্রি সাইডে আমার ফ্রেন্ডের সঙ্গে গিয়ে থাকব। সেখানে ভাড়া দিতে হবে না।’ আমি বললাম, তোমার মেয়ে? সে বলল, ‘ওর জন্য ফোস্টার কেয়ার ঠিক করেছি। সেখানে থেকে পড়াশোনা করবে।’
ফোস্টার কেয়ার মানে কোনো এক পরিবারের সঙ্গে মেয়েটি থাকবে। মানে দত্তক নেবে তারা। সব পরিবার তো আর এক রকম হয় না। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে। এমেলিয়ার কথা শুনে বুকটা ভেঙে আসতে লাগল। কী করে একটি পরিবার ভেঙে খানখান হয়, সেটা নিজের চোখে দেখা। তারপর ওর সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি, পারিনি। জানি না কেমন আছে এমেলিয়া আর তার ছেলেমেয়ে দুটো।
দুই.
করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এমেলিয়ার মতো অনেকের পরিবার ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। ঘরে বন্দী থেকে মানসিক রোগীতে পরিণত হবে লাখো মানুষ। আত্মাহুতির সংখ্যা বেড়ে যাবে অনেক। অন্যদিকে গরিব দেশের মানুষ রোগে যে পরিমাণ আক্রান্ত হবে বা মারা যাবে, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ মারা যাবে না খেতে পেয়ে। চুরি-ডাকাতি রাহাজানি বেড়ে যাবে। এ পর্যন্ত করোনার আক্রমণে যতটুকু ঘটেছে, তাতেই মানুষের মেরুদণ্ডের সঙ্গে পৃথিবীর মেরুদণ্ড ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। প্রতিটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, যা কোনো দিন কেউ চিন্তা করতে পারেনি। আজ কত দিন হলো আকাশে একটি প্লেন উড়তে দেখি না। ভূমিকম্প পৃথিবীজুড়ে। দুলছে চাঁদ তারা আকাশ বাতাস। সবই স্তব্ধ। মানুষে মানুষে দেখা নেই, শুধু খবরের পর খবর আসছে, যা শুনতে কেউ প্রস্তুত নয়। মৃতদেহের ভারে জর্জরিত ইতালি, স্পেন, আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশ।
অস্ট্রেলিয়ায় লকডাউনের এক মাসের বেশি হতে চললেও কী হবে, কোনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না। খোলা রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দোকানপাট। বেশির ভাগ মানুষ ঘরে বন্দী থেকেও অফিসের কাজ করে যাচ্ছেন। কিছু মানুষের আবার কিছুই করার নেই। ঘরে বসে দিন কাটছে। তবে অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাস প্রথম দিকে বাড়তি থাকলেও এখন কিছুটা কমের দিকে। আমার কর্মস্থলে যাঁরা আসেন তাঁদের গা ছাড়া ভাব দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে কিছুই ঘটেনি। মাস দুয়েক আগে যেমনটি দেখে এলাম বাংলাদেশে। সবার মধ্যে একই কথা, অন্যান্য দেশে ওই রোগ থাকলেও তাদের দেশে নাকি ওসব নেই।
যেহেতু কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করি তাই মানুষ নিয়েই আমার কাজ। কত কিসিমের মানুষ যে দুনিয়াতে আছে সে আমার অনেকটাই দেখা। দিনের শুরুতেই খিটখিটে মেজাজের পিটার নামের মধ্যবয়সী এক বুড়ো এসেই পরিবেশ নষ্ট করে ফেললেন। তিনি বিল দিতে এসেছেন। তাঁকে দূরত্ব মেনে দাঁড়াতে বলতেই খেপে গেলেন। বললেন, Oh God! When this drama will be finished? Disgusting। গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। যদিও মেঝেতে দাগ টানা রয়েছে, এর ভেতরে কেউ আসতে পারবে না। কে শোনে কার কথা। ষাটের ওপর বয়স এই পিটারের। কোথায় ঘরে থাকবেন তা না, বাইরে এসে কড়া মেজাজে কথা বলছেন। মনের রাগ মাথা থেকে পায়ের তলায় নামিয়ে নিয়ে হাড্ডিতে পুঁতে ফেললাম। কথায় আছে, কাস্টমার অলওয়েজ রাইট। তাই তেমন কিছু বললাম না। তাঁকে কিছুতেই বোঝানো গেল না এই মরণ রোগ যেকোনো সময় যে কাউকে ধরতে পারে। কিছুক্ষণ পরই কড়া লাল লিপস্টিক মেখে মারিয়া নামে এক বয়স্ক মহিলা পোস্ট অফিসে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে মনে হলো পৃথিবীটা সুখের সাগরে ভাসছে। কিসের কী করোনা, তার কাছে অযথাই বাড়তি জঞ্জাল। তবে তাঁকে দেখে বোঝা যায়, বয়সকালে খুব সুন্দরী ছিলেন। আলাপচারিতায় বললেন, নিজের বাড়িতে থাকেন আর পেনশনের টাকায় ভালো চলছে তাঁর। স্বামী গত হয়েছেন অনেক দিন হলো। ছেলেমেয়েরা নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তাই বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে হই-হুল্লোড় করে চলাই মারিয়ার আনন্দ। আমাকে দেখেই ফিক করে হেসে তাঁর প্রথম কথা: Look! I don't have any cough or fever. Don’t worry! I am absolutely fine! বলার কারণ আছে। আমি মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে করোনা থেকে দূরে থাকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। প্রথমে মনে মনে একটু রাগ হলেও তাঁর সাজুগুজু মার্জিত হাসিমাখা মুখখানি দেখে করোনার উৎপাতটা কিছুক্ষণের জন্য হলেও মন থেকে দূর হলো। তার কাজ শেষ হওয়া সত্ত্বেও পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলেন। বুঝলাম, ঘরে বন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠেছেন, তাই বিল আর ওষুধ কেনার ছুতোয় বেরিয়েছেন। মানুষ বড়ই বিচিত্র জীব। একটুতেই মান-অভিমান মন খারাপ হাঁপিয়ে ওঠে; নিমেষেই আবার ভালো লাগা ভালোবাসায় মেতে উঠতে সময় লাগে না।
সেখানে বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের কথা আর কী বলি। দেশ থেকে ফেরার পর নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষগুলোর মুখ মনে ভেসে উঠছে বারবার! এই মানুষগুলোর খাওয়া-পরার নিশ্চিত ব্যবস্থা থাকলে আমরা হতাম বিশ্বের সেরা জাতি। সাদারা নিজেদের মনে করে সভ্য জাতি, গরিব দেশগুলোর কাছে সভ্যতার ঝান্ডা উড়িয়ে বেড়ায়। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বেহায়ার মতো রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পেটের ধান্দায় মাথা ঘামাতে হলে এই মাইকেল-পিটারদের উগ্রতা জানালা দিয়ে পালাত। এখানকার মানুষের চেয়ে আমাদের দেশের সলিম-করিমদের আচার-আচরণ আদবকায়দা অনেক ভালো। পিটারের মেজাজ হজম করতে না-করতে মারিয়ার মিষ্টি মুখখানি দেখে মনটা শান্ত হলো কিছুটা। ও মা, কিছুক্ষণ পর আরও একজন ঢুকলেন। তিনি যৌবনের পাল যেভাবে উড়িয়ে দিয়ে বেড়াচ্ছেন তাতে তাকে মহিলা বলব, নাকি মেয়ে, বুঝতে পারছি না। কচি মেয়েদের পোশাকে ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মহিলা, হৃষ্টপুষ্ট একখানা শরীর। তার মধ্যে হাফপ্যান্ট পরেছেন। দুর্দিন বলে তো একটা কথা আছে। দুদিন বাদেই শীতকাল শুরু হবে, তাই আগেভাগে তার এই সাজসজ্জা! টাইট কাপড় পরেছেন, যেকোনো সময় ফেটে বেরিয়ে আসতে পারে থলথলে চর্বি। এটা দেখে মেজাজ আরও বিগড়ে গেল। ওপর-নিচে খুব সামান্য কাপড় পরা মহিলা। ২৫ বছর ধরে দেখে আসছি। এমন রাগ কখনো ওঠেনি। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক পরে নিজকে ক্লাউন মনে হতে লাগল। এদের কাছে সেই কারণেই হয়তো রাগের সূত্রপাত। করোনার ভয়ে মানুষ যেখানে দিশাহারা, সেখানে এরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়াচ্ছে।
যেখানে ঘরে বসে ইয়া নফসি, ইয়া নফসি করছে গোটা বিশ্ব। ওপরওয়ালার দরবারে হাত তোলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আতঙ্ক চারদিকে। মৃতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অদৃশ্য এই শক্তির সঙ্গে লড়াই করে চলেছে মানুষ। কোথা থেকে এল, কেমন করে হলো সেটা ভাবার মতো সময় এখন কারও নেই। রোগের নমুনা বোঝা বড় দায় প্রাণঘাতী রোগটি কার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, সেটাও বোঝার উপায় নেই। অলৌকিক এক গোলকধাঁধার চক্করে সবাই ঘুরপাক খাচ্ছে। শেষটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, জানা নেই। তবে অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে খুব গা ছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, তাদের কিছুই হবে না। যেমনটি ভেবেছিলেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখন তাদের অবস্থা ভয়াবহ। ভাবতেও পারেনি চায়না ভাইরাস তাদের এমন করে ধরাশায়ী করবে!
তিন.
লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে করোনাভাইরাসে। ছোটবেলায় বড়দের মুখে গল্প শুনেছিলাম তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে একটি যুদ্ধ লাগবে। এখন মনে হচ্ছে এটি এমন একটি যুদ্ধ, মানুষে মানুষে লড়াই না করেই মানুষ মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। করোনা নামের চোখে না দেখা বস্তুটি তাহলে কি সেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ! নাকি মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায়-অবিচার আর ক্রূর আচরণের ফল। কেউ সঠিক করে কিছু বলতে পারছে না। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ভাইরাস। বিনা অস্ত্রে মানুষ নিধন পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে! তাই বিশ্বের রথী-মহারথীরা আতঙ্কে ধরাশায়ী। সেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মানুষের পিঁপড়ার মতো মরে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।
গরিব দেশগুলোর সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এর আগে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে একটি কথা খুব উচ্চারিত হয়েছে। গরমে নাকি করোনা টিকতে পারবে না। কী জানি, হয়তো সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য এসব কথার সৃষ্টি। একেবারে উড়িয়ে দিতেও পারছি না। সৃষ্টিকর্তার হাতে মানুষের জানমালের চাবি। তিনি চাইলে নিমেষেই সবকিছু আগের মতো সুন্দর করে দিতে পারেন। মানুষের মন কত কথাই না বলে, কত কথাই না ভাবে। যদি এমন হয়, মানুষছাড়া পৃথিবী!
কী আশ্চর্য, পৃথিবীতে তাহলে কি মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। যেমনটি হয়েছিল ডাইনোসরের বেলায়। প্রকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের। আমরা কি তাহলে সেই দিকে এগোচ্ছি? পৃথিবীতে মানুষ না থাকলে কেমন হবে? ভাবতেই বুকটা হুহু করে ওঠে। হায়রে, ধনদৌলত বাড়িঘর ব্যাংক ব্যালান্স! সবই আস্তে আস্তে মাটিতে মিলিয়ে যাবে। দালানকোঠা গাড়ি-ঘোড়া লতাপাতায় ঘিরে ফেলবে। বাংলাদেশের কথাই যদি ধরি, সেটা কেমন হবে? ওপরে নীল আকাশ, উঁচু উঁচু বিল্ডিং, গ্রামগঞ্জগুলো দেখতে মনে হবে ঘন একেকটা সবুজ পাহাড়। মানুষের পরিবর্তে সেখানে বিচরণ করবে পশুপাখি, বাঘ-ভালুক, বাদুড়, বেবুন। ভাবতেই মাথাটা গুলিয়ে আসে। এটা কি কখনো ভাবা যায়, মানুষ জাতি নিঃশেষ হয়ে যাবে ডাইনোসরের মতো?
মানুষ নামের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষের পরিবর্তে পোকামাকড়, পশুপাখি রাজত্ব শুরু করবে সেখানে। ঢাকার পাকা রাস্তাগুলো হবে চিকন সরু নদী। অর্ধেকটা হয়তো চলে যাবে বঙ্গোপসাগরের বুকে। মনে হবে উঁচু উঁচু পাহাড় নীল সবুজ এবং বনজঙ্গলের গা ঘেঁষে নদী। সেই নদীতে নৌকা ভাসানোর কোনো সভ্য মানুষ থাকবে না। ছোট ছোট দোকানপাটের চিহ্ন থাকবে না। লতাপাতায় ভরে উঠবে। বিচরণ করবে বিষধর সাপসহ নানা জাতের জীবজন্তু। ভয় পাওয়ার মতো সেখানে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষ ছাড়া পৃথিবী কেমন হবে—সুন্দর নাকি অসুন্দর! সেটা বোঝার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্ধেক থেকে পুরো দেশটি হয়তো একসময় আস্তে আস্তে সমুদ্রের বুকে তলিয়ে যেতে থাকবে। মানুষ ছাড়া একটি দেশের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
না না, তা কী করে হয়। যত দিন সুন্দর বেঁচে থাকবে, তত দিন মানুষ বেঁচে থাকবে। বাইরে চোখ পড়তেই মনে হয় মানুষছাড়া এই প্রকৃতি খুবই বেমানান। ভারসাম্য রক্ষার জন্য দুটোই প্রয়োজন সমানে সমান। এই যে রোদেলা দুপুর, চকচকে রোদ, পাখির কলকাকলি, ফুলেরা হাসছে, উড়ে উড়ে মৌমাছিরা পরাগায়নে ব্যস্ত। সবকিছুতেই মানুষ জড়িয়ে আছে একে অপরের আত্মার আত্মীয় হয়ে। যে যার জায়গাতে নিজের মতো করে চলছে। জানালায় চোখ পড়তেই গাছপালা, রাস্তাঘাট কোনো কিছুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু মনটা কেন এমন তোলপাড় করছে। কেন এত মনগড়া ভাবনা উঁকিঝুঁকি মারছে! মনে হচ্ছে, বুকের ওপর মস্ত বড় আকাশসমান পাথর চাপা দেওয়া রয়েছে। কোনো কিছু ভালো লাগছে না। বেশির ভাগ মানুষের কাজ শুধু ঘরে বসে খাওয়া, মন খারাপ করা আর ফেসবুকে ভয়ংকর সব পোস্ট দেওয়া। ঘরবন্দী জীবন কারও কাম্য নয়। দুরুদুরু বুকে উদ্ভট সব আতঙ্ক বাসা বেঁধে ঘুণপোকার মতো কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে।
চার.
দিন নেই, রাত নেই একই চিন্তাভাবনা। কোনো কিছুতে কারও মন নেই। যতটুকু রান্না চলছে কোনো রকমে খাওয়ার জন্য খাওয়া। দেশ-বিদেশে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে চিন্তাভাবনা, এটাও বাড়তি। কিসের আলামত কে জানে, একেক জনের একেক রকমের তর্কবিতর্ক। বড় বড় কথায় আমরা সবাই কম-বেশি ওস্তাদ। তাই কেউ বলতে ছাড়ি না। পৃথিবীজুড়ে জ্ঞানীগুণী মানুষের অভাব নেই। কেঁচোর মতো কিলবিল করছে! কে কার ওপর কথা বলবে, কার কত খ্যাতি মিলবে, চলছে এমন প্রতিযোগিতা। তাই একেকজন একেক রকমের কথা ছুড়ে মারছেন। কেউ বলছেন চাইনিজদের ছাইপাঁশ খাওয়ার কারণেই এই রোগের উৎপত্তি। আবার কারও মন্তব্য, ওরা তো বহুকাল ধরেই এই ছাইপাঁশ খেয়ে আসছে। এত দিন তো কিছু হলো না। আবার জ্ঞানীগুণীদের মধ্যে থেকে কেউ বলছেন, এই রোগের পেছনে তৃতীয় কোনো শক্তির হাত রয়েছে।
এই রকমের ভাইরাস যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। সোয়াইন ফ্লু, প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু আরও কত রকমের অসুখ। এর ওষুধও আবিষ্কার হয়েছে। ওষুধ বাজারে আসার আগে অনেক প্রাণ ঝরে গেছে। বারবার মানুষকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে এবারের এই ফ্লু খুব বেশি শক্তিশালী। মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের চেয়ে আরও বেশি শক্তিধর কিছু পৃথিবীতে আছে। এই শক্তিধরের ওজন এমন ভারী, যা মানুষের বইবার ক্ষমতা নেই।
ফেসবুক বুদ্ধিজীবীরা গায়ের জোরে কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত না করে সময়োপযোগী সুন্দর কথা বলা এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন। যেসব কথা দিয়ে অর্ধেক রোগ সারিয়ে তোলা যায়, এমন কথা বা সান্ত্বনার দরকার। প্রতিদিন কত মারা গেল আর কত আক্রান্ত হলো, এটা কি কোনো সুখের খবর যে তাতে তেল-মসলা মাখিয়ে প্রচার করতে হবে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মিডিয়া বয়কট করা ছাড়া উপায় নাই। নইলে সবাই মরার আগেই মরে ভূত হয়ে যাব। এত গালগল্প শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে চোখ আর মন দুটোই আধমরা। অস্ট্রেলিয়ার তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে ২০ শতাংশের মতো মানসিক রোগী বেড়েছে।
সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। তার পরও থেমে নেই চুরিচামারি হিংসাত্মক সব ঘটনা। মানুষ নিজেরা নিজেরা মারামারি, খুনোখুনি করে সুখশান্তি বিনষ্ট করছে। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। বোমা, অ্যাটম বোমা, সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা আবিষ্কার হলো নিউক্লিয়ার বোমা। যে যার শক্তি দেখাতে ওস্তাদ, এক দেশ অন্য দেশকে থ্রেট করে চলেছে প্রতিনিয়ত। যার খেসারত কিছু দেশকে দিতে হচ্ছে। নইলে ইয়েমেন-সিরিয়ার মতো দেশ প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যেত না। খোলা আকাশের নিচে লাখো মানুষ বছরের পর বছর মানবেতর জীবন যাপন করছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, যুবতী সবারই এক হাল। তাদের জীবনের কথা কি কেউ কোনো দিন একবারও ভেবেছে? মানুষ হয়ে মানুষের ওপর নিষ্ঠুরতা কাকে বলে, সেটা একবার আমরা দেখেছিলাম ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানিদের বর্বরতার শিকার হয়েছিলাম আমরা। এখন দেখছি বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের হুংকার। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির অমানবিক নির্যাতন কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। সু চি নিজের দেশের মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যায় ইন্ধন দিয়েছেন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের মতো গরিব দেশের বোঝা হয়ে রয়েছে। ওদিকে রক্তলোলুপ সু চি বহাল তবিয়তে বসে রয়েছেন! বাঘা বাঘা নেতারা কিছুই করতে পারলেন না! কোথায় গেলেন পৃথিবীর বড় বড় মাথারা। তাঁদের কি কিছুই করার ছিল না! এখনো নেই?
মানুষগুলোর চোখের পানি, বুকের কষ্ট, নিশ্বাস-প্রশ্বাস আজ পয়জন হয়ে পুরো পৃথিবীর মানুষকে গ্রাস করবে একদিন। অনেকের মনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এই আগুন থামার নয়। এখন কোথায় গেল মানুষের আনন্দ-উল্লাস! সবই বন্ধ। সৃষ্টিকর্তা চাইলে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন চোখের নিমেষে। যেমনটা থেমে নেই জন্ম-মৃত্যু। অশান্ত পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে জন্ম নিচ্ছে লাখো শিশু। প্রতিদিন পৃথিবীতে মন্দ কাজের পাশাপাশি অনেক ভালো কাজও হচ্ছে। থমকে দাঁড়ানো পৃথিবী যেকোনো সময় আবার জেগে উঠতে পারে। মানুষে মানুষে ভালোবাসা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। তাই মানুষ না চাইলেও পৃথিবী আজীবন বেঁচে থাকবে। নতুন নতুন রোগ আসতে থাকবে, মানুষ তা প্রতিরোধ করবে তাদের শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। পৃথিবী ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হতে পারে না। যত দিন চন্দ্র-সূর্য থাকবে, তত দিন মানুষ নামের প্রাণী বেঁচে থাকবে এই পৃথিবীর বুকে। এটা যুক্তির কথা নয়, বিশ্বাসের কথা। পৃথিবীর আবার সুস্থ হোক, মানুষের আগের জীবন ফিরুক।