তুমিই আমার সব, তবু তোমার সাথে আড়ি...

১. 

বহু বছর আগে একদিন তুমি বলেছিলে, যেদিন অমিতাভ বচ্চন মারা যাবেন সেদিন বুঝি পৃথিবী ভেঙে পড়বে মানুষে। কত মানুষ যে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যাবে কে জানে! কত মানুষ যে জ্ঞান হারাবে, হার্ট অ্যাটাক করবে ভাবাই যায় না। জনপ্রিয় হলে এমনই হতে হয়। আজকালকার নায়কগুলো শরীরেও যেমন হালকা, মেজাজেও তেমনই পল্কা। খালি লাফায়।
বচ্চন সাহেবের পঁচাত্তর হলো। কদিন আগেই তাঁর ‘পিংক’ সিনেমাটি চারদিকে মারমার-কাটকাট অবস্থা তৈরি করেছে। কোর্ট-রুম থ্রিলার যে মানুষের এত পছন্দ হবে তা কে জানত!
কথাটি শুনে স্কাইপের ওপাশে তুমি হেসে বলেছিলে, দেখা হয়নি এখনো ছবিটি। বাসার টিভি-টাতে ভালো পিকচার আসে না। কিংবা আমার চোখই হয়তো খারাপ হয়ে গেছে। স্পষ্ট দেখতে পারি না আজকাল। কখন কোনো সিনেমা কোনো চ্যানেলে যে দেখায় ঠিক জানিও না ছাই। তোমার ওখানে যখন যাব তখন দেখব। তুমি তো শুনেছি বড় টেলিভিশন কিনেছ।
স্কাইপের এপাশ থেকে আমি দেখি তোমার ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের হাসি। সে হাসি কেমন ম্লান দেখায়।
ইদানীং প্রোজেক্টরের দাম বেশ সস্তা হয়ে গেছে। হাই-লুমেন্সের নানা ধরনের প্রোজেক্টর বাজারে পাওয়া যায়। অনলাইনে সামান্য রিসার্চ করে পছন্দ মতো কিনে নাও, কে মানা করেছে। তার সঙ্গে ঘরের পরিসর হিসেব করে স্পিকার। ব্যস হয়ে গেল ঘরের মাঝেই সিনেমা হলো। আমাদের বাইরের ঘরে এমন একটা ব্যবস্থা করলে দারুণ হয়। পাঁচ শ স্কয়ার ফুটের চৌকোনা ঘর। এ পাশের দরজাটা লাগিয়ে দিলে মূল বাসা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাউকে কিছু না জানিয়ে মনে মনে মেলা গবেষণা করছি। প্রোজেক্টরটা কখন কিনলে সাশ্রয় হয়, কোথায় লাগালে ভালো হয়, কোনো ডাইমেনশনে দেখলে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যায়, স্ক্রিনটা কালো হবে নাকি সাদা, সেটা অটোমেটিক হবে নাকি ম্যানুয়েলি পুল-ডাউন, ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে মনে আমার ইচ্ছা তুমি যখন আসবে ঠিক তার আগে আগেই কিনব ওটি। একদিন তোমাকে এনে বসিয়ে ঘরটা অন্ধকার করে ছেড়ে দেব ‘সিলসিলা’, কিংবা ‘শক্তি’ সিনেমাটি। আব্বা হয়তো বলবেন, ‘এক সিনেমা কতবার দেখো তুমি! আশ্চর্য!!’
তোমার আসার তো তেমন বাকি নেই। মার্চ তো এই এল বলে। দেখতে দেখতেই কেটে যাবে এই সময়টা। পৌলোমীর গ্র্যাজুয়েশনের বেশি দিন বাকি নেই। তারপরই ওর কলেজ শুরু হবে। তোমার প্রথম নাতনির এই অনুষ্ঠানে কী পরবে, কী রান্না হবে, কাকে কাকে দাওয়াত দেওয়া হবে এই সব নিয়ে তোমাদের শলা-পরামর্শের বুঝি শেষ নেই। সেদিনের অনুষ্ঠানে তোমরা, মানে মেয়েরা, নাকি বিশেষ রঙের শাড়ি পরবে। আর তারই কেনাকাটার জন্য তুমি কলকাতা যাবে-আবার এটাও জেনেছি।
গতবার যখন এলে, তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই, আমরা সবাই এক গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়ে ছিলাম। তোমাকে আর আব্বাকে নিয়ে আমরা হয়ে গেলাম ছয়জন। কিন্তু আমাদের সিডান কেম্রি গাড়িতে ধরে পাঁচজন। একটা ভ্যান ভাড়া করব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু সেটা তো আর সব সময় করা যায় না। আর তা ছাড়া অনেক খরচও তো হয়। আমাদের জীবন এখানে সত্যিই প্রান্তিক। তুমি হয়তো আঁচ করেছিলে ব্যাপারটা। বলেছিলে, ‘আমরা মেয়েরা পেছনে একটু আগপিছ করে বসে যাব। তোমরা যখন দেশে ছিলে, এমনটা করতাম না? গাড়ি ভাড়া করার দরকার নেই। তুমি চিন্তা করো না।’
আমরাও মেনে নিলাম। মুখে বললাম, সেটা একেবারে খারাপ না। সবাই এক সঙ্গে গেলে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। আর কষ্ট হলে মাঝে মাঝে থামব। অথচ মনে মনে ঠিকই খচখচে একটা অনুভূতি কাজ করেছে। ইশ্‌, একটা বড় গাড়ি থাকলে বেশ হতো। তোমাদের ঘোরাঘুরিটা আরামের হতো। আমি আর নীলা ঠিক করলাম, তোমাদের এবার আসার আগেই একটা বড় গাড়ি কিনব। তখন আর তোমাদের কষ্ট হবে না। সেই অনুযায়ীই হিসেব নিকেশ করছি। অনলাইনে বড় গাড়ির দাম দেখছি। নিজের ক্রেডিট হিস্ট্রি কাজে লাগাব। তাই ওটি অক্ষত রাখার জন্য আমার নাম করে কোনো কিছুই কিনছি না। নিজেদের একটা পুরোনো কেম্রি আছে। ওটাও বিক্রির চেষ্টা করছি। কথা ছিল আমার শাশুড়িও আসবেন তখন। সাতজনে মিলে আমরা অনেক ঘুরে বেড়াব। গতবার নিউইয়র্ক যেতে পারো নি। এবার নিশ্চয়ই তোমাদের নিয়ে যাব। অথচ হঠাৎ করে জানতে পারলাম, পৌলোমীর নানু আগামীবার হজে যাচ্ছেন। তাই তোমাদের সঙ্গে শামিল হতে পারবেন না এবার। আমাদের দলের একজন কমে গেল। তবু ভাবলাম, সবাই সুস্থ থাকলে নিশ্চয়ই আবার এক সঙ্গে ঘুরতে পারব।
প্রথম প্রথম এখানে এসে দুরুমের একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া করেছিলাম। বাসাটা ছোট হলেও ওটার সামনে ছিল প্রকাণ্ড মাঠ। সে মাঠটিই ছিল তখন আমার ভালো লাগার একমাত্র বিষয়। ব্যস্ততা কম থাকাতে জানালার পাশে বসে অপলক তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম সে খোলা ময়দান। দেখতাম, স্ফটিক সূর্যালোকে কটকট করছে চারপাশ, অথবা তুমুল বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের ডগা। কিংবা মোহময় জোছনায় ভেসে যাচ্ছে কল্পনার উদ্যান। আবার হয়তো অপার বিষণ্নতায় নামছে সন্ধ্যা আমার মননের ক্ষণগুলো এভাবেই কাটিয়েছি। একাকিত্বও যে সৃষ্টিশীল হয় সেতো তোমার কাছ থেকেই জানা। তোমরা এলে তো সেসব দেখেই কেবল কাটাতে পারবে না। ঘুমাবে কোথায়? আমাদের তো একটা ভালো বিছানাও নেই। হয়তো তোমাদের আসা উপলক্ষেই কিনে ফেললাম একটা বাড়ি। পুরোনো যদিও, তবুও কিছুটা বড়। অবিকল আমাদের উত্তরার শ্রাবস্তীর মতো লাল ইটের বাড়ি। আরাম করে সবাই মিলে থাকা যাবে। কিন্তু সে বাড়ির কার্পেটটা বেশ পুরোনো হয়ে গিয়েছিল। বাথরুমগুলোতেও কিছু মেরামত করা দরকার। শুরু হলো সে কাজ। মেঝের কার্পেট বদলে ওখানে ওখানে বসানো হলো ল্যামিনেট কাঠ। বাথরুমের দেয়ালের কাজটি আমরা নিজেরাই করলাম। আগে ওয়াল পেপার ছিল। আমরা তার ওপর পেইন্ট করলাম। সে কাজ আগে কোনো দিন করেনি। ওয়েবসাইট আর ইউটিউব ঘেঁটে ঘেঁটে কত কিছু যে জানলাম। প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরে শুরু করে দিতাম কাজ। বলতে দ্বিধা নেই, বেশ ভালো লাগত। তোমরা এসে দেখে অবাক হয়ে বলবে, ‘আরে তোরা রং মিস্তিরি হয়ে গেলে কবে থেকে?’
আমাদের বাসাটার চারপাশে অনেক বড় বড় গাছ। দুপাশে বেশ ঘন জঙ্গল। দেখলে মনে হবে যেন ‘সিক্রেট উইন্ডো’র জনি ডেপের গৃহ। কেবল লেক নেই পাশে। ইয়ার্ডের ঘাসগুলো এত তাড়াতাড়ি বাড়ে যে কি বলব। আবার তিনদিকের অ্যাজেলিয়া গাছগুলো এমন বেয়াড়া, তরতর করে বেড়েই চলছে। সেবার দেখি একটা গাছে ফুটেছে সাদা সাদা গন্ধরাজ! অবাক হয়ে দেখেছি সে ফুলগুলো। আকারে বাংলাদেশে ফোঁটা গন্ধরাজের থেকে একটু ছোট যদিও। এ ফুল আমার সবচেয়ে প্রিয়, তুমি তো জানো। না চাইতেই দুটো গন্ধরাজ গাছ বোনাস হিসেবে পেয়ে বসে আছি। যা হোক, এই জংগুলে বাসাতে তো তোমাদের ওঠাতে পারি না তা সে আমাদের যতই প্রিয় হোক না কেন। তাই কিছু যন্ত্রপাতি কিনলাম ঘাস কাটার জন্য, গাছের ডালপালা ট্রিম করার জন্য। কিন্তু সব নিজে নিজে পারছিলাম না। তাই লোক খুঁজছিলাম। যাতে চারপাশটা সুন্দর করে রাখা যায়। কিন্তু লোক পাওয়া গেলে খরচের হিসেবে কুলিয়ে ওঠা যায় না। আবার কম পয়সার লোক দিয়ে কাজ করালে তৃপ্তি হয় না। চরম ত্রিশঙ্কু অবস্থা। তাই আমরা নিজেরাই একটু একটু করে প্রতিদিন কাজ করি। ভেবেছি, এবার তোমরা এলে একটা ছোট্ট বাগান করব। নীলা বলে আব্বার হাতে নাকি গাছ ভালো হয়। ড্রাইভ ওয়ের পাশে একটা জায়গা নির্ধারণ করলাম ফুল ও সবজির বাগানের জন্য। সেখানে দুটো ক্যামেলিয়া বেশ দৃঢ়তায় আগে থেকেই বেশ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তাতে ফোঁটা ক্যামেলিয়া ফুল আমাদের চোখ রাঙিয়ে বলছে, ‘আমাদের এত অবহেলা করো না, বাছা। এই আমাদের নামই কিন্তু ঝুলছে তোমাদের মোহনপুরের বাড়িতে।’ জেনেছি, সদ্য নির্মিত আমাদের গ্রামের বাড়ির নাম ‘ক্যামেলিয়া’ রেখেছ। কি কারণে এই নামকরণ সে নিয়েও রয়েছে অনেক রসগল্প। সেসব আনন্দ-বেদনার কাব্য না হয় অন্যদিন।
২.
আমি আর মনি বসে আছি শিকাগো এয়ারপোর্টে।
প্লেনের অনেক দেরি। এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনাল যেতে হবে। ট্রেনে গেলে এক পথ, আর শাটল বাসে গেলে আরেক পথ। আমরা শাটল বাসের জন্যই অপেক্ষা করছি। সেটিরও দেরি আছে। তবুও দুই ভাইবোন অনেক আগেই এসে বসে আছি। যদি মিস হয়ে যায়, এই ভয়ে। এমনিতেই বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তুমি সেই কখন থেকে শুয়ে আছ বারডেমের হিমাগারে! আমাদের জন্যই অপেক্ষা। আম্মা, তোমার শীত লাগে না বুঝি! খালি তো বলতে, ‘আমার কী যে হলো! সারা শরীরে কে যেন মরিচ ডলে দিয়েছে। খালি জ্বলে, গরম লাগে খুব। মাঝে মাঝে মনে হয় ফ্রিজের ভেতর ঢুকে বসে থাকি। তবেই কিছুটা শান্তি যদি হয়’। এখন কি আর সে রকম লাগে? বরফের ভেতর কেমন নিথর শুয়ে আছ। সে শীতলতা বুঝি পলাশকেও ছেয়ে গেছে। তোমার হিমাগারের সামনে সে অতন্দ্র ঠায় দাঁড়িয়ে! সারা জীবন ভাবতে, তোমার এই পিচ্চিটা কবে যে বড় হবে। পদে পদে ভুল করে। অথচ দেখো, সে কেমন বড় হয়ে গেছে। তোমার সবকিছু তো সে-ই সামলাচ্ছে। আমরা তো পলাতকের মতো এদিক-ওদিক। সে-ই দেখছে সব। তোমার আর ভাবনা নেই গো, মা। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।
মনি মিনেসোটা থাকে, আর আমি সাউথ ক্যারোলাইনায়। কাল বিকেলে ওর এখানে এসেছি। আজ দু’ ভাইবোন চলছি ঢাকায়। জীবনের দীর্ঘতম এবং বিষাদতম যাত্রা বুঝি একেই বলে।
আমি যেখানে থাকি সেখানকার বাঙালি কমিউনিটিটি বেশ ছোট। হাতে গুণে বলা যাবে সবার নাম। এরাই ঠিক করল এবার ক্যাম্পিং-এ যাবে। ঠিক হলো জুলাইয়ের ২৯ তারিখে সবাই যাবে হ্যামিলটন ব্রাঞ্চ স্টেট পার্কে। কিন্তু আমার যেতে মন চাইছে না কিছুতেই। কারণ, গত কদিন ধরেই তুমি হাসপাতালে শুয়ে আছ। তুমি নড়তে পারছ না। পড়ে গিয়েছিলে। বাঁ পায়ের কোমর আর উরুসন্ধির হাড় খুলে গেছে। ডাক্তার বলেছে দুদিন পর সার্জারি হবে-তারই জন্য এখন অপেক্ষা। সেদিন সকালেই বাসার সবার সঙ্গে তোমার কথা হলো। আমাকে বললে, ‘আজ অনেক ভালো আছি। চিন্তা করো না।’
আমি চিন্তা করি না। কিন্তু নিজেকেই জিজ্ঞেস করি, মাঝের এ কদিন কিন্তু সবার সঙ্গে কথা বলনি। সেদিনই ডেকে ডেকে সবার সঙ্গে ফোনে কথা বললে। কেন বলেছিলে? আজ কেন তোমার কণ্ঠস্বর অনেক দূরের মনে হলো? কেমন যেন ভেসে ভেসে আসে। তবে কি কথা বলার সময় তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, আম্মা? নাকি সেটা আসলে সুদূরে যাওয়ার আভাস?
বাচ্চারা ক্যাম্পিং-এ যেতে চায়। সামার চলে যাচ্ছে। ওরা কোথাও যায়নি এবার। বলতে গেলে আমাদের মাঝে আনন্দ করার তেমন উপকরণ নেই। ওরা চায় যেতে, আমি বুঝি। রাহাত একটা লম্বা লিস্ট পাঠিয়েছে জিনিসপত্রের। রাহাত-এশার কথা মনে আছে তো তোমার? সেই যে তুমি বলেছিলে, ‘এশা মাশাল্লাহ একটা দারুণ মেয়ে। একদিকে সংসার সামাল দিচ্ছে, আবার ছোট ছোট বাচ্চাদের নাচও শেখাচ্ছে! একেই বুঝি বলে, যে রাঁধে, সে বুঝি চুলও বাঁধে’! রাহাতের মাও বেশ কদিন ধরে হাসপাতালে পরে আছেন। দুইটা কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ সে দেশে যেতে পারছে না। সব ট্রাভেল ডকুমেন্ট হারিয়ে বসে আছে।
ক্যাম্পিং-এ কখনো যাইনি আগে। মন না চাইলেও টুক টুক করে কিনছি সেসব জিনিস। সবাই হয়তো আমার মনের অবস্থা জানে। তাই মাঝে মাঝেই কেউ না কেউ ফোন করে, খবর নেয়। পরোক্ষ ভাবে আমাকে বোঝায়, ক্যাম্পিং-এ গেলে হয়তো আমার ভালো লাগবে। তোমার ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে তা হয়তো কিছুটা ভুলে থাকা যাবে। আমি মনে মনে হাসি, কিছু বলি না তেমন। তবে ঠিক সেদিন তোমার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, নাহ যাওয়া যায়। তুমি তো আজ ভালোই আছ। অপারেশনটা হয়ে গেলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার এটাও ভেবেছি, তোমরা এলে একটা ক্যাম্পিং করব। কী কী করতে হয় এবার গিয়ে তাও জানা হবে। সেই ভেবে ধীরে ধীরে জিনিসগুলো গাড়ির ব্যাক ট্রাঙ্কে ওঠাচ্ছি। টেন্টটা শুধু ওয়ালমার্ট থেকে উঠিয়ে নিলেও হলো। ড্রাইভিং সিটে বসে জিপিএস সেট করছি। বেশ খানিকটা দূরে যেতে হবে। আমি তাই তাড়া দিই সবাইকে। ঠিক সে সময় কোথা থেকে যে একটা ফোন আসে। আর সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। যেন ‘কোথা থেকে কখন যে কি হয়ে গেল’। ক্যাম্পিং-এ যাওয়ার জন্য যে ব্যাগ গুছিয়ে ছিলাম তাই নিয়েই মিনিয়াপলিস।
শিকাগোর ও’হ্যের এয়ারপোর্টে বসে বসে দুই ভাইবোন বিমানের ওড়াউড়ি দেখি আর আকাশ-পাতাল ভাবি। চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ভেসে ওঠে আমাদের শৈশব, কৈশোর এবং তারুণ্যের দৃশ্যপট। রায়ের বাজারের বাসা-অলিগলি, হাই স্কুলের মাঠ, মিতালি রোডের ছাদ, অনুজের বাড়ি ফেরার জন্য উদ্বিগ্ন রজনী-প্রহর, উত্তরার শ্রাবস্তী, ঢাকা বিমান বন্দরে উড়ন্ত বিদায়-রুমাল—সব। আমাদের তিন ভাইবোন আর আব্বা, এই ছিল আমাদের দিনরাত্রি। এ সবই একই সুতোয় গাঁথা। আর সে কণ্ঠ মাল্যের নাম বুঝি তুমিই, আম্মা।
আমেরিকার মোটামুটি সব বিমান বন্দরেই ওয়াইফাই রয়েছে। আর শিকাগো এয়ারপোর্টে তো থাকবেই। সময় কাটাতে আমি ইউটিউব ঘাঁটি। চিরকুটের একটা গান বেজে ওঠে। স্তব্ধ হয়ে দুই ভাইবোন সে গান শুনি।
‘আমি বোকা, আমি বোকা
তাই তোমায় ভুলে থাকি
এই লজ্জা বল হায় কেমন করে ঢাকি...’
ঢাকায় পৌঁছাব ঠিকই। সমগ্র ঢাকায় হয়তো ফুটেছে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া। কিন্তু সে রং আর আমাদের ছোঁবে না। ফলের বাজারে মৌ মৌ করবে পাকা আমের সুবাস। অথচ সে ঘ্রাণ আমাদের আকৃষ্ট করবে না আর। ঝকঝকে ও’হ্যের এয়ারপোর্টের আকাশ কখন যে ঝাপসা হয়ে গেছে টের পাইনি। এই যে এত আয়োজন, এত প্রত্যাশা, এত কল্পনা-সব কেমন খেলো হয়ে গেল। তোমার শীতল নিথরতা আমাদেরও যেন পেয়ে বসেছে। এবারও ভাবলে না আমাদের কথা, আব্বার কথা! কী করে পারলে, এভাবে হুট করে চলে যেতে! তীব্র অভিমান পাথর হয়ে আমার বুকে বসে থাকে। ‘প্রার্থনার সকল সময়, শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়’। ইউটিউবে তখনো বেজে চলেছে, ‘তুমিই আমার সব, তবু তোমার সঙ্গে আড়ি...’।

অরেঞ্জবার্গ, সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে