তিন বোনের গল্প

ব্লু মাউন্টেনের থ্রি সিস্টারস
ব্লু মাউন্টেনের থ্রি সিস্টারস

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেটের দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি হলো ব্লু মাউন্টেন। রাজধানী সিডনির সিবিডি থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে এই ব্লু মাউন্টেন পাহাড়। আর সেখানে গেলেই দেখা মেলে এই তিন বোনের। যাদের একসঙ্গে থ্রি সিস্টারস বলা হয়। ব্লু মাউন্টেন ইকো পয়েন্টে গেলে দেখা যায় তিনটি পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। যাদের উচ্চতা ছোট থেকে বড় ক্রমান্বয়ে ৯০৬, ৯১৮ ও ৯২২ মিটার। এরাই হচ্ছে থ্রি সিস্টারস।

মায়ের সঙ্গে লেখিকা
মায়ের সঙ্গে লেখিকা

এই তিন বোন বা থ্রি সিস্টারস নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি মিথ হচ্ছে কাতুম্বা গোষ্ঠীর তিন বোন মেহ্নি, মিলাহ, গান্নিডো বাস করত জামিসন উপত্যকায়। তারা প্রেমে পড়ে আরেক গোষ্ঠীর তিন ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু উপজাতীয় আইনে তাদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই তিন ভাই এই নিয়ম মানতে রাজি ছিল না, যেভাবেই হোক তিন বোনকে তারা বিয়ে করবে। অবশেষে তারা যুদ্ধ বাঁধাল দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। যুদ্ধের মধ্যে তিন বোনের সমূহ বিপদ দেখে কাতুম্বা গোষ্ঠীর এক জাদুকর মন্ত্র বলে তাদের জাদু করে তিনটি পাথর বানিয়ে রাখে—যে যুদ্ধ শেষ হলে আবার তাদের আগের রূপে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু জাদুকর নিজেই যুদ্ধে নিহত হয়। আগের রূপে ফিরিয়ে আনার মন্ত্র একমাত্র জাদুকর জানত। সেই থেকে এই তিন বোন তিনটি পাহাড় রূপে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে আছে প্রেম আর যুদ্ধের স্মারক হিসেবে।
সিডনি আসার পর অনেকবার যাওয়া হয়েছে ব্লু মাউন্টেন। কেউ দেশের বাইরে থেকে বা অন্য স্টেট থেকে এলে বেড়াতে যাওয়া হয় সেখানে। অনেকবার গেলেও শীতের সময় যাওয়া হয়নি কখনো। এবার শীতে মা আসলেন দেশ থেকে। এখানে শীতের সময় দিন খুব ছোট আর ৫টার আগেই অন্ধকার হয়ে যায়। অনেক শীত পড়ে। বাইরে তেমন ঘুরতে যাওয়াও যায় না ঠান্ডার জন্য। শীতের সময় ব্লু মাউন্টেন স্নো পড়ে। আর তাপমাত্রাও অনেক নেমে যায়। মায়ের আবার স্নো পড়া দেখার খুব ইচ্ছা। আর তিনি কেন, আমি নিজেও কখনো দেখেনি। তবে নিউ সাউথ ওয়েলসে স্নোয়ি মাউন্টেন বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে দারুণ স্নো দেখা যায়। কিন্তু দুই দিনের প্ল্যান করে যেতে হবে। অনেক দূরে, তাই সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা এবার নাই। তাই আমরা ভাবছিলাম ব্লু মাউন্টেন কাছে আছে, যদি এখানে দেখা যায় খারাপ কী।
আবহাওয়ার আপডেট দেখলাম। এখানে আবার আবহাওয়া আপডেট যা দেখায় তাই থাকে, তেমন পরিবর্তন হয় না। একদিন দেখলাম তাপমাত্রা রাতে ১ ডিগ্রিতে নামবে ও স্নো পড়বে। পরদিনও ৫ ডিগ্রিতে থাকবে। স্নো পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর দিনটি ছিল রোববার। তাই আর কোনদিকে না তাকিয়ে ওই দিন বেরিয়ে পড়লাম মা আর মেয়ে মিলে সকাল সকাল। যা আছে কপালে। স্নো পড়লে দেখব, না হয় মাকে নিয়ে ব্লু মাউন্টেন বেড়িয়ে আসব। আর তার যাওয়ার সময়ও চলে আসছে। উইকেন্ডে না গেলে আর যাওয়াও হবে না। আমার বর আর মেয়ে বাসায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাবে। কারণ ওদের এত ঠান্ডা যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই।
সকালবেলা আমি আর মা সাড়ে আটটার ট্রেন ধরলাম। তখনো রোদ ওঠেনি। আর প্রচণ্ড শীত। স্টেশনে আমরা চারজন মাত্র যাত্রী আর স্টেশন মাস্টার আছেন। বেচারা ডিউটির জন্য এসেছেন। না হয় তিনিও মনে হয় আসতেন না। আর বাকি দুজনের ড্রেস দেখে বোঝা যাচ্ছে কাজে যাচ্ছেন। আমরাই শুধু ঘুরতে বের হয়েছি। মা শুধু ভয় পাচ্ছেন আর বলছেন, না আসলেই হতো।

লেখিকার মা
লেখিকার মা

এত দিনে তার অবশ্য সিডনি সম্পর্কে ধারণা পালটে গেছে। প্রথম আসার পর আমার সঙ্গে বের হতে চাইতেন না। তার মতে আমরা দুজন মেয়ে মানুষ একা বের হওয়া মানে বিপদ। তারপর ট্রেনের কথা বললে বলতেন, ভিড় হবে, কেন রিকশা নাই। কিন্তু যখন দেখলেন, এখানকার মানুষ কত লাইন ধরে ট্রেনে ওঠে, রাস্তা পার হতে নিয়ম মানে। ভিড় ও সিট না থাকলে কোনো যাত্রী উঠে তাকে নিজের সিট দিচ্ছে। শুধু তাকে না, যেকোনো বয়স্ক মানুষ আর বাচ্চাসহ মায়ের জন্য সিট রাখাই আছে। এই সিটগুলোতে শুধু তাদের প্রায়োরিটি। মা অবাক। এভাবে বাংলাদেশে তো কল্পনাই করতে পারি না। আমরা একা একা এত দূর বেড়াতে যাব আর ট্রেনে চড়ব কোনো ধাক্কাধাক্কি ছাড়া।
ট্রেন আসার পর দেখা গেল অনেক ভিড়। আমরা কোনোমতে এক কম্পার্টমেন্টে উঠলাম। মাকে দেখে একজন উঠে সিট দিল। এই শীতে এত মানুষ কেমনে যাচ্ছে ব্লু মাউন্টেন। আমরা সাড়ে এগারোটার দিকে পৌঁছে গেলাম কাতুম্বা স্টেশন। সেখান থেকে ব্লু মাউন্টেন যাওয়ার বাস আছে। আমরা বাসে চড়ে পৌঁছে গেলাম মেইন স্পট ইকো পয়েন্ট, যেখান থেকে থ্রি সিস্টারস দেখা যায়। যাওয়ার পথে পড়ে স্ক্যানিক ওয়ার্ল্ড। এখানে আরও দর্শনীয় স্থান আছে যেমন কাতুম্বা ফলস, ওয়েন্ট ওয়ার্থ ফলস, বোটানিক গার্ডেন, Leura Cascades, ট্র্যাকিং করার জন্য আছে পাহাড়।
ইকো পয়েন্ট থেকে হেঁটে থ্রি সিস্টারস এর ভেতরে যাওয়া যায়। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তা আর অনেক লম্বা সিঁড়ি। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবেন কিনা। দেখি তিনি রাজি। সেই খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে আমরা নিচে নামলাম। ওপরে ওঠার সময় দেখলাম তিনি আর পারছেন না। কারণ মা এমনিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারেন না, তার ওপর কোমরে ব্যথা। ওপরে ওঠার সময় একটা ছেলে মাকে তুলতে সাহায্য করল। আমরা হাঁপিয়ে গেলাম। দুপুর হয়ে গেল, আমরা লাঞ্চ সঙ্গে করে নিয়ে গেয়েছিলাম। তাই খাওয়া হলো।

লেখিকা
লেখিকা

থ্রি সিস্টারস ট্র্যাকিং আর লাঞ্চ শেষ করে আমরা ফিরে এলাম ইকো পয়েন্টে। সেখানে কিছু শপ আছে স্যুভেনির, কার্ড, খেলনা, চাবির রিং—এসব কিনতে পাওয়া যায়। আমরাও কিছু স্যুভেনির, চাবি রিং আর খেলনা কিনলাম। ৩টা বাজে কনকনে ঠান্ডা বাতাস কিন্তু স্নোয়ের নামগন্ধ নেই। কী আর করা। স্নো ফলিং না দেখেই ফিরতে হবে। এর মাঝে এক ইতালিয়ান পর্যটক দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হলো। তারা আমাদের অনেক ছবি তুলে দিলেন। বললেন, রাতে তারা কাতুম্বা হোটেলে থাকবেন। কারণ স্নো ফলিং হবে রাতে। সেটা তারা মিস করতে চান না। আমি তাদের স্নোয়ি মাউন্টেনের কথা বললাম। স্নোয়ি মাউন্টেনের কথা তারা জানতেন না। শীতের সময় বরফের পাহাড় দেখার কথা শুনে তারা আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন। এদিকে একটু পর অন্ধকার হয়ে আসবে। আমাদের ফিরতে হবে। ফেরার পথে গেলাম স্ক্যানিক ওয়ার্ল্ড। সেখানে রোপ ট্রেনে করে ওপরে ঘুরলাম। নিচে কাছের প্লেট দেখা যাচ্ছে। আমরা অনেক ওপরে উঠছি, এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
সব কথার শেষ কথা হলো স্নো ফলিং আর দেখা হলো না। কিন্তু আমার সঙ্গে আমার মা ব্লু মাউন্টেন ঘুরে অনেক আনন্দ পেয়েছেন। সেটাই হলো আমার অনেক বড় পাওয়া।