‘তার আগে চাই গণতন্ত্র’

বেদনামিশ্রিত একটি তথ্য দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। আমার ধারণা এই তথ্যটি অনেকেই জানেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা এখন ‘সুশীল’ শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে থাকে। তাঁদের কোনো সহপাঠী যদি একটু তত্ত্বীয় কথা বলে, জ্ঞান–বিজ্ঞান, সমাজ–রাষ্ট্র নিয়ে ভাবে এবং বন্ধুদের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, তাহলে তাঁকে ‘সুশীল’ আখ্যায়িত করে। এমনটি অনেক সময় বন্ধুমহল বর্জনও করে। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নানা কারণে আমার যোগাযোগ রয়েছে। এই তথ্যটি আমি দায়িত্ব নিয়ে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করছি। যারা একটু ভিন্ন চিন্তা করে, লেখাপড়ার বাইরে রাষ্ট্র, সমাজ নিয়ে ভাবে, বন্ধুরা তাদের কেন তারা এড়িয়ে যায় বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি। একটা সময় তো শিক্ষার্থীরা পাঠচক্র করত, রাষ্ট্র, সমাজ, বিশ্বকে জানার জন্য। পাঠচক্রে যারা অংশগ্রহণ করত তাঁরা সাধারণত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিল। এখন মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করে, খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী রাজনীতি করে নিবেদিত প্রাণ হয়ে। নিরাপদে হলে থাকা, চাঁদাবাজি ও ছাত্র নেতাদের ভয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থী রাজনীতিতে নাম লেখায়। এ কারণে মেধাবীরা রাজনীতি থেকে সযতনে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করে। যারা নিবেদিত হয়ে রাজনীতি করে, তাঁদের সংখ্যা খুব কম। তাঁদের মিছিলের দৈর্ঘ্য খুব ছোট। কেন এ রকম হলো আজ?

‘সুশীল’ বলতে আমাদের শিক্ষার্থীরা সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের সদস্যদের বুঝে। তাঁদের মতে, সুশীল বা নাগরিক সমাজের সদস্যদের কাজ হলো বিবৃতি দেওয়া, টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে গিয়ে দলীয় মনোবৃত্তি নিয়ে কথা বলা। নিজের মতামত যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা না করে উচ্চ স্বরে অসৌজন্যমূলক আচরণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা। অন্যের কথা শোনার ধৈর্য নেই তাঁদের। অন্যের মতামতকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন তাঁরা। দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁদের অনেকেই আলোচনাকালে কুৎসিত, মুখভঙ্গি এমনকি শারীরিক বল প্রয়োগ করতেও পিছপা হন না। তাঁদের নাম ও চেহারা বলে দেয়, তারা এখানে কার জন্য এবং কেন এসেছেন কথা বলতে। ঢাকা শহর ও বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহরে তাঁরা বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। সে সব বক্তৃতা একপেশে। দলীয় আনুগত্যে ভরপুর। এসব বক্তব্য আবার টেলিভিশনের সংবাদে প্রচার করা হয়। টেলিভিশন সংবাদে তাঁদের মুখগুলো যখন দেখা যায়, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সংবাদের চ্যানেলটি পরিবর্তন করে বিনোদনের চ্যানেলে চলে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের মেধাবী, অমেধাবী শিক্ষার্থীরা ন্যায্যতার পক্ষ থেকে সরে গিয়ে নিজেদের অন্য এক ভুবনে নিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

এ নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে আন্তরিকতার সঙ্গে যুক্ত হলে প্রতিবাদ হবে, প্রতিরোধ হবে। অন্যায্য পথে যারা হাঁটছেন, তাঁদের চলার পথ বিঘ্নিত হবে। কালোটাকা পাচার হলে আরও জোরে আওয়াজ উঠবে। তাঁদের মতে, দেশ অস্থিতিশীল হবে। দেশ অস্থিতিশীল হলে উৎপাদন হবে না, মাথা পিছু আয়, জাতীয় আয় বাড়বে না। বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ (!) পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। এ কারণে এখন টেলিভিশন ও অধিকাংশ সংবাদপত্র বিদ্যমান অবস্থার পক্ষে থেকে কথা বলে যাচ্ছে। আর আমাদের রাজনীতিবিমুখ শিক্ষার্থীরা যেমন এড়িয়ে যাচ্ছে টেলিভিশন ও ক্যাম্পাসের সুশীলদের, একইভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে রাজনীতিকে। সব মিলিয়ে ন্যায্যতার পক্ষে থাকার লোকের সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলের কোনো আশাব্যঞ্জক ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া যেমন দেখা যায় না, তেমনি একসময়ের সুশীল বা নাগরিক সমাজও নিষ্ক্রিয় থেকে দলদাসে রূপান্তরিত হচ্ছেন। ছাত্রদের ইতিবাচক রাজনীতি থেকে সৃষ্ট ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যদি না আসে তাহলে, আমাদের (অব.) সামরিক ও বেসামরিক আমলা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী নেতাদের পোয়া বারো। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তখন তাঁদের ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিশ্চিত হবে। বিষয়টি অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক (!)।

নাগরিক সমাজের ধারণা ও দর্শন বেশ পুরোনো। নাগরিক সমাজের ধারণা, গণতন্ত্রের ধারণার থেকেও প্রাচীন। সভ্যতার আন্দোলন যখন অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে মুক্ত চিন্তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তখনই সক্রেটিস, প্লেটোর মতো মানুষেরা অন্ধবিশ্বাস, অন্ধ আবেগ থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তি, বিজ্ঞানের পথে হাঁটার নির্দেশনা দিতে শুরু করেন। নাগরিক সমাজের সঙ্গে তাই তাঁরা যুক্ত করেন নাগরিক, নাগরিকত্ববোধ ও রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক অবস্থানকে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এই দর্শন মূলত ইউরোপীয়। এ ক্ষেত্রে আমরা সক্রেটিসের উদাহরণ উল্লেখ করতে পারি। তিনি একটা যৌক্তিক সমাজ চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সমাজের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি সংলাপের মধ্য দিয়েই মিটমাট হোক। এই সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে তিনি সত্যের সন্ধান করেছেন। যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়েই সমাজ অগ্রসর হবে, রাজনীতি ক্রমশ ভব্য হবে এবং মানুষ উন্নত জীবনের অধিকারী হবে, এই ছিল তাঁর বক্তব্য। কিন্তু ক্ষমতা, ভোগ, বিলাসে যারা একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা সক্রেটিসের কাছ থেকে যৌক্তিক সমাজের ধারণা না নিয়ে তাঁর হাতে বিষের পেয়ালা ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

বলা হয়ে থাকে, সমাজে সক্রিয় ও প্রভাবশালী দুটি শক্তি আছে কেন্দ্রে। এদের মধ্যে প্রথমেই আসে রাষ্ট্রের নাম এবং এর পরে আসে যার নাম সেটি হলো ‘বাজার’। এর বাইরে একটি তৃতীয় ধারা কিংবা প্রবণতা আছে, আর সে ধারা, প্রবণতা বা শক্তি যে নামেই অভিহিত করি, তার অস্তিত্ব সমাজে বসবাসকারী সবাই অনুভব করতে পারি। এই ধারা যত বেগবান হয়, যত সংহত হয়, যত প্রকাশমান হয়, ততই তার শক্তি উপলব্ধি করা যায়। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে, সচেতনভাবে ও স্বেচ্ছায় জড়ো হয়ে সমাজে যুক্তির ঢেউ তোলে যে জনগোষ্ঠী তাঁরাই নাগরিক সমাজ। এক সময় যাকে সবাই ইংরেজি বাংলায় মিশিয়ে সিভিল সমাজ বলতেন, তাঁকে ভাষান্তর করে আধুনিক মানুষেরা নাগরিক সমাজ হিসেবে ডাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ‘নাগরিক সমাজ’ বললে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ভেদাভেদ না করে সব নাগরিককে সম্মানের সঙ্গে শুভ শক্তির দলে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

স্বাধীনতা–পূর্ব বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের কার্যকর ও নিবেদিত প্রাণ যে ভূমিকা, তা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি গৌরবজনক অংশ। রাজনীতির স্বচ্ছতা ও দেশপ্রেমের কারণে নাগরিক সমাজ তখন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এটা ধ্রুব সত্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হয়েছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা মনোভাব এবং ব্যাপক সামাজিক শক্তির সুসংগঠিত প্রয়াসের কারণে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমরা নাগরিক সমাজের অনেক সফল আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করি। ওসমানী উদ্যানের গাছ কেটে যখন সম্মেলন কেন্দ্র তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, আমরা দেখতে পাই পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আন্দোলনের কতিপয় নাগরিক সংগঠনের জোরালো ভূমিকা।

এ ক্ষেত্রে প্রথম সফল আন্দোলনের রূপকার ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি অল্প কয়েকজনকে সঙ্গী করে ওসমানী উদ্যানে গাছ কেটে সম্মেলন কেন্দ্র বানানোর সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কোনো দাতা সংস্থার অনুদান ছাড়া নিজেদের শ্রম, ঘাম দিয়ে এ রকম একটি আন্দোলন সফল করে তোলার উদাহরণ সম্ভবত এটিই প্রথম। তখন স্লোগান ছিল, নাগরিকদের জন্য খোলা জায়গা চাই, মুক্ত পরিবেশ চাই, বিশুদ্ধ বাতাস চাই। এই আন্দোলনের ফলে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রটি স্থানান্তরিত করে সরকার শেরেবাংলা নগরে স্থাপন করতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশে নারী অধিকার আন্দোলনে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকায় যে নাগরিক সংগঠনটিকে দেখা যায়, তার নাম বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ নামে এটি জন্ম নেয় ১৯৭০ সালে। সাংবিধানিক সংস্কার, ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড, যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন—এসব ক্ষেত্রে এ দেশে যা কিছু অর্জন, তাতে মহিলা পরিষদের ভূমিকা খুব কার্যকর ও দৃশ্যমান। এ রকম আর একটি জোরালো ভূমিকা নেওয়া সংগঠন হলো ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’। এ নাগরিক সংগঠনটি বুড়িগঙ্গা নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হাতে নিয়ে তাঁদের আন্দোলন শুরু করেছিল। তৎক্ষণাৎ খুব বেশি ফলাফল পাওয়া না গেলেও এর প্রভাব পড়েছে সুদূর প্রসারী। পরিবেশ আন্দোলনের প্রভাব আমরা এখনো দেখি সরকারের নদী দখলমুক্ত করার লাগাতার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে।

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও টেকসই করতে হলে বিরুদ্ধ মতের প্রকাশ ও বিরুদ্ধ মতের মূল্যবান উপাদান গ্রহণ করা খুব জরুরি। কার্যকরী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে আজ বেনোজলের ভেতর দিয়ে অনেক আবর্জনা এসে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। আজ সারা দেশে মৌলবাদীদের যে আস্ফালন, তা হলো রাজনীতির স্বচ্ছ বাতাসের মধ্যে থেকে বিরোধী মত, বিরোধী দলের অনুপস্থিতিজনিত শূন্যতা। বাতাসে যেমন শূন্যতা তৈরি হলে চারিদিক থেকে নানারকম বাতাস ঘূর্ণমান হয়ে শূন্যস্থানে ঢুকে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করে, আজ তেমনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও স্বাভাবিক উপস্থিতি ব্যাহত হওয়ার কারণেই বেনো জলের মধ্যে অন্ধকারের শক্তির এত উন্মত্ত নাচন।

কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতায় যেমন একসময় সমতা, সাম্য, ন্যায্যতার জন্য তাঁর প্রিয়ার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার আশাবাদ ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন, সমস্ত আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের আগে তাঁর একটি কঠিন শর্ত। তিনি সবকিছুর আগে চান সমতার সমাজ, অর্থাৎ সমাজতন্ত্র। কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে তিনি সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজনের কথা বলেতে গিয়ে বারবার সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। প্রথম পঙ্ক্তি ছিলে এ রকম—‘...তোমাকে নিশ্চয়ই একদিন আমি কিনে দিতে পারবো/একটি আশ্চর্য সুন্দর ইজিপ্সীয়ান কার্পেট/মখমল-নীল শাড়ি পরে তুমি ভেসে বেড়াবে সারা ঘরময় রাজহাঁস/কিন্তু তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।

সমাজতন্ত্র যেমন ছিল সব সময় প্রয়োজন, কিন্তু একইভাবে আমাদের জাতীয় জীবনের এ সময়ে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্র বিকশিত না হলে, নাগরিক সমাজ বিকশিত হবে না। সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতির চর্চা হবে না। ছাত্র রাজনীতিতে সুস্থতা না আসলে ভবিষ্যৎ মানবিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে না। সুস্থ সচেতন নাগরিক সমাজ গড়ে উঠবে না। তাই এখন সবকিছুর আগে চাই সুষ্ঠু, সুস্থ গণতন্ত্রের বিকাশ। আমাদের প্রিয় কবি গুনের

ভাষায় আমরা বলতে পারি, সব উন্নয়ন, সব স্বপ্ন দেখা প্রয়োজনীয়, কিন্তু ‘তার আগে

চাই গণতন্ত্র’।