তারা ফুলের গল্প
‘ফুলে গন্ধ নেই এ তো ভাবতেই পারেননি’ সুরের জাদুকর আর ডি বর্মন। কিন্তু সুগন্ধের বদলে দুর্গন্ধ ছড়ায়—এমন ফুলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ক্যালিফোর্নিয়া এসে।
কখনো মুষল ধারায়, কখনোবা ইলশেগুঁড়ি...নানা ধারাপাতের বর্ষণ দেখে বেড়ে উঠেছি আমি। ঈশান কোণে মেঘ জমলে তোড়জোড় শুরু হতো ঘরে ফেরার, বা ছাদের শুকনো কাপড় ঘরে তোলার। তাই মাতৃভূমি ছেড়ে যখন সদ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস শুরু করেছি, লস অ্যাঞ্জেলেসের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা দেখলেই মনের অজান্তে প্রহর গুনতাম, এই বুঝি মেঘদূত আকাশ ভেঙে নামবে তার শান্তির ধারায় চারপাশ সিক্ত করে দিতে। কিন্তু মনের ভাবনা আকাশের কালো মেঘের মতো মনেই জমাট বেঁধে থাকত, বারিধারায় নেমে আসত না।
লস অ্যাঞ্জেলেসের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৬ ইঞ্চির মতো। গড়পড়তায় বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত হয় ৪৭ থেকে ৫৭ ইঞ্চির মতো। তাই স্বাভাবিকভাবে যে আবহাওয়া, প্রকৃতি বা গাছগাছালির মাঝে কেটেছে আমার ছোটবেলা, লস অ্যাঞ্জেলেসের প্রকৃতি বা গাছপালা তার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। ক্যালিফোর্নিয়ার স্থায়ী গাছপালাগুলো স্বভাবতই প্রচণ্ড খরার মধ্যেও বেঁচে থাকার ক্ষমতা রাখে। স্টারফিশ ফ্লাওয়ার বা টোড ক্যাকটাস হলো এমনই একধরনের গাছ, যা ক্যালিফোর্নিয়ার শুষ্ক আবহাওয়ার মধ্যেও প্রাণবন্ত থাকে সহজেই।
স্টারফিশের মতো দেখতে বড় আকারের এ ফুলের চারপাশ মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করে না। যার কারণে রঙিলা ডানা মেলে ভিড় করে না প্রজাপতির দল। ‘টোড ক্যাকটাসের’ চারপাশে মৌমাছির পরিবর্তে আবর্জনা চষে বেড়ানো মাছি ভনভন করে। পলিনেশন বা পরাগমিলনের জন্য এ মাছিই তাদের ভরসা। খুব কাছ থেকে শুঁকলে টের পাওয়া যায় পচা মাংসের গন্ধ ছড়াচ্ছে বড় তারার মতো ফুলগুলো থেকে। পানি স্বল্পতার কারণে সাকুলেন্ট বা ক্যাকটাস ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট বা বড় বাগানের একটি বড় আকর্ষণ।
যেহেতু ‘সাকুলেন্ট’ তাদের ডাল, পাতা বা কাণ্ডে পানি সঞ্চিত করে রাখে, তাই খুব কম পানি আর কিঞ্চিৎ যত্নে বেড়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন, বর্ণিল এ গাছগুলো। এখন মাতৃভূমিতেও দেখেছি গাছ-অনুরাগীরা গর্ব ভরে সংগ্রহে রাখেন এ ‘স্টার ফ্লাওয়ার’ গাছ।
আমি উদ্ভিদবিদ নই। ছাত্র পড়ানো আমার পেশা। আমার মনে হয়, এ গাঢ় সবুজ কাণ্ডবিশিষ্ট ক্যাকটাসগুলো সামান্য হলেও যেন ভাবতে শেখায় আমাদের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। মনে করিয়ে দেয় সহমর্মিতার কথা। ফুলমাত্রই সুগন্ধ ছড়াবে, তা ঠিক নয়। বর্ণে, গন্ধে, রূপে অমিল হওয়া মানে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরঞ্চ, অস্বাভাবিক হলো ভিন্নতা মেনে না নিতে পারা আমাদের অক্ষম, স্থবির মন। প্রচলিত ধারা থেকে ভিন্ন হলে, তা আমাদের অনেকের দৃষ্টিতেই অসহ্য ঠেকে। আমরা তখন উপর্যপুরি চেষ্টা করি সব ভিন্নতা হটিয়ে, তার স্বাভাবিক রূপ পাল্টে, নিজের মনের মতো ছাঁচে তা গড়ে নিতে।
এমেলিয়া পর্তুগাল থেকে আমার ক্লাসে মাত্র এসেছে মাত্র কয়দিন আগে। না জানে মার্কিন চালচলন, না জানে ভাষা। অথচ ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ক্লাসে হইহুল্লোড় বাধাতে জুড়ি নেই তার! কোনো অঙ্ক একবারের বেশি দুবার বোঝানোর দরকার পড়ে না। অথচ ডিলেন, সাতবার বর্ণনার পর যদি ওর মাথায় কিছু ঢোকে তাতেই শোকর! ডিলেনের মায়ের ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে। আজ ওর বাবার সঙ্গে তো কাল থাকে ওর নানু বা দাদির সঙ্গে রাত কাটায় ও। ডেভিড কখনোই তার ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে খেলে না। সব সময়ই ঘুরঘুর করে মেয়েদের সঙ্গে। সেকেন্ড গ্রেডের অন্য ছেলে ও কিছু মেয়েরা যখন দারুণ হুল্লোড় করে বাস্কেট বল খেলে, ডেভিড তখন মেয়েদের সঙ্গে মাংকিবারে ঝুলে গালগল্পে থাকে ব্যস্ত। এমেলিয়া, ডিলেন বা ডেভিড কেন হতে পারে না ক্লাসের আর দশটা বাচ্চার মতো, সে ভাবনায় অস্থির হয়ে চরম বিরক্তিতে তাদের চৌদ্দগুষ্টিকে শাপশাপান্ত করতে পারি আমি। অথবা বুঝতে পারি, এ ছাত্ররা যাতে সম্ভাবনার দাঁড়প্রান্তে পৌঁছাতে পারে, তার জন্য তাদের নিজ নিজ উপযোগী উপায় বের করে দিকনির্দেশনা দেওয়াটাই হলো শিক্ষক হিসেবে আমার যথাযথ দায়িত্ব।
পটভূমি ভিন্ন হওয়ার কারণে মানুষের চিন্তাচেতনা, অভিব্যক্তি বা রূপ বৈচিত্র্যময় হতেই পারে। কারণ, প্রকৃতি ভিন্নতা পছন্দ করে, তাই তো ফুল কখনো সুগন্ধ ছড়ায়, কখনো বা দুর্গন্ধ...আবার কখনো হয় গন্ধহীন।