টুনি বউ
টুশিকে আসিফ প্রথম দেখে এ বছরের শুরুতে বাংলাদেশে। অনেকগুলো বছর পর এ বছরই ওর দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়। আসিফরা ছয় বোন ও এক ভাই। মাস্টার্স করার জন্য আসিফ কানাডার থান্ডার বে-তে এসেছিল বহু বছর আগে। তখন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি কাজও করত। এভাবে বেশ সময় নিয়ে এমএস করার পর ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডায় স্থায়ী হয়। বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আসিফ কানাডায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই ওর বাবা মারা যান। স্বাভাবিকভাবেই বড় ও একমাত্র ছেলে বলে আসিফকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। বোনদের পাত্রস্থ করা, বাবার উত্তরাতে একটা প্লট ছিল—সেখানে বাড়ি বানানো, দেশের বাড়িটাকে সংস্কার করা—সবই আসিফকে করতে হয়েছিল। এ জন্য ওকে রাত-দিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও একটা টেলিকম কোম্পানিতে কাজ করার পাশাপাশি কিছুটা বাড়তি আয়ের জন্য হোম ডিপোতেও কাজ করত সে। অনেক সময় দেশের মানুষ প্রবাসীদের এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কথা বুঝতে চায় না। মনে করে প্রবাসীরা স্বর্গসুখে বাস করে; আর এখানকার আকাশে-বাতাসে ডলার উড়ে বেড়ায়, শুধু হাত বাড়িয়ে ধরতে হয়। সে যাক, এভাবে দায়িত্ব পালন করতে করতে মেঘে মেঘে বেলা বাড়ার মতো আসিফের বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেল।
এ বছর জানুয়ারি মাসে আসিফের দেশে যাওয়া হয়। আর আত্মীয়-স্বজন উঠে পড়ে লাগে তার বিয়ের জন্য। আসিফের ঘটা করে পাত্রীর বাসায় গিয়ে ‘মেয়ে দেখা’ পছন্দ নয়। তার মনে হয় এতে মেয়েটার অপমান করা হয়। কিন্তু বিয়ের পাত্রী দেখা উপলক্ষে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে কোনো শপিং মল বা রেস্তোরাঁয় যেতে ওর আপত্তি নেই। অনেক মেয়েপক্ষই খুব আগ্রহ দেখায়। কিন্তু সেসব পাত্রীর আচরণ, চাল-চলন দেখে আসিফ দমে যায়। সবাইকে কেমন জানি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে হয়। আরেকটা শঙ্কাও কাজ করে—আসিফ এখনো সংসারের সব দায়িত্ব পালন করে; এতে যদি কেউ বাধা হয়।
আসিফের বোনেরা অবশ্য এখন যে যার সংসারে প্রতিষ্ঠিত। শুধুমাত্র ছোট বোনের বিয়ে বাকি। তবে বিগত বছরগুলোতে আসিফ যা সম্পত্তি করেছে, তাতে মা ও বোনের কোনো অসুবিধাই হয় না। সামনেই ছোট বোন তুলির জন্মদিন। আসিফের আসা উপলক্ষে সবাই মিলে পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীর মহিষবাথানে যাওয়ার আয়োজন করে। অনেকগুলো আম বাগান কিনেছিল সেখানে আসিফ। শানবাঁধানো পুকুর, গাছ-গাছালিসহ বাড়িটাকে সে বাংলো বাড়ি বানিয়েছিল, যা একটা অবকাশ যাপনের চমৎকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এর দৃষ্টিনন্দন ভিউ অনেকের নজর কাড়ে। একজন পরিচিত আত্মীয় চিত্র পরিচালক তো কয়েক দিন শুটিংও করেছিলেন ওখানে। এবার আসিফের দেশে আসা উপলক্ষে সব বোনদের পরিবার, মামা, ফুফু ও তুলির ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর পরিবার নিয়ে তারা বাংলো বাড়িতে বেড়াতে যায়।
টুশি তুলির ছোটবেলার বান্ধবী। কিন্তু আসিফের সঙ্গে এবারই প্রথম দেখা। প্রথমেই আসিফের মনে হয়েছিল সে যেন এক চঞ্চলা হরিণী—প্রজাপতি বা ঘাস ফড়িংয়ের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। অসম্ভব প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ও আন্তরিক এ মেয়েই যেন এত বড় বাড়িটাকে মাতিয়ে রেখেছে। বড়-ছোট সবার সঙ্গে টুশি সরল আন্তরিকতায় সহজে মিশে গিয়েছিল। আসিফ লক্ষ্য করে টুশিকে ওর মা কয়েকবার ডেকে একটু স্থির হতেও শাসন করলেন। কিন্তু ঘাস ফড়িং বা বহতা ঝরনাকে কি বাঁধা যায়? ছোট বোনদের সঙ্গে বয়সের পার্থক্যের কারণে আসিফ একটু গম্ভীর হয়ে পড়ে। কিন্তু টুশি আসিফকেও ফানি জোক্স বলে হাসিয়েছিল।
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ দুষ্টুমি করে বলেছিল টুশিকেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায় আসিফের সঙ্গে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আসিফ পাত্রী হিসেবে টুশিকে কল্পনাও করতে পারে না, শুধু বয়েসের পার্থক্যের কারণে। সে চল্লিশ পেরিয়ে গেছে, আর টুশি কেবল ২২ বছরের বালিকা। দুদিন ওদের সবারই আনন্দে কেটেছিল রাজশাহীতে। আম বাগানে আর বিস্তৃত মাঠের মধ্যে টুশির কিশোরীসুলভ ছোটাছুটি, আর ঘাস ফড়িংয়ের মতো বিচরণ আসিফকে মুগ্ধ করে। মনে মনে সে টুশিকে খুবই পছন্দ করে ফেলে। আসিফ যেন ঘোরের মধ্যে চলে যায়। ওর এক বড় ভাইয়ের একটা কবিতার কিছু চরণ মনে পড়ে যায়—
‘হাসিমুখে সাত সকালেই সে এসে বলবে
সুপ্রভাত প্রিয়...
আমার অসম্ভব সুন্দর একটা দিনের সূচনা করে দিয়ে সে
আবার হারিয়ে যায় তার নিজস্ব নক্ষত্রে।’
ব্যাপারটা মায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই মা টুশিদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে ওরা সবাই আপত্তি জানালেও টুশির সঙ্গে আলোচনা করে এ বিয়েতে সবাই মত দিয়েছিল। টুশির যথেষ্ট মার্জিত, রুচিশীল আসিফকে ভালোই লেগেছিল। কাজেই তাকে জীবনসঙ্গী করতে আপত্তি করেনি।
তড়িঘড়ি করে বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। আর মাত্র দিন সাতেকের মধ্যেই আসিফের কানাডার ক্যালগেরিতে ফিরে আসার কথা। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা উচ্ছল তরুণী টুশির ছিল বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ফটোশুটে দারুণ আগ্রহ। আর ওদিকে বেশি বয়সে বিয়ে করতে গিয়ে বেচারা আসিফের অপ্রস্তুত ভাব। টুশিকে ওর অসম্ভব ভালো লেগেছে। কাজেই ওর কোনো আবদার পূরণ করতে কার্পণ্য করেনি আসিফ।
বাসর রাতের বড় একটা সময় ভরা পূর্ণিমায় ছাদে গল্প করেছে আর জ্যোৎস্না দেখেছে দুজন। পরদিন হঠাৎ বৃষ্টিতে বাড়ি ভরা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আসিফের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বৃষ্টিতে ভিজতে! আসিফের মা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তিনিই ওদের দুদিনের জন্য জোর করেই কক্সবাজার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এতে করে নিরিবিলি একে অন্যকে জানার সুযোগ হবে। আসিফ বাসর রাতেই টুশিকে বলেছিল, ‘তুমি আমার টুনি বউ।’ টুশি তখন প্রথমবারের মতো একটু লাজুক হাসি হেসেছিল। সেই থেকে আসিফ ওকে একান্তে ‘টুনি বউ’ বলেই ডাকে।
সত্যিই সেই দুদিন সমুদ্র সৈকতে খুবই আনন্দে কেটেছিল ওদের। আসিফের কানাডা ফিরে আসার সময় এয়ারপোর্টে টুশি তাকে বিদায় জানাতে এসে খুব কেঁদেছিল। আসিফ যেন ওর আত্মার অংশ। আসিফ কানাডা ফিরে এসে একা ঘরে এক বিশাল শূন্যতা বোধ করতে থাকে। এতগুলো বছর একাকী জীবনে ও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সে জীবনের ছন্দপতন ঘটল। ওর টুনি বউ যেন পায়ে নূপুর পরে সারা বাড়ি বিচরণ করে। অবস্থাদৃষ্টে এমন দাঁড়াল যেন টুনি বউ ওর ছায়াসঙ্গী হয়ে গেল। ‘ছায়া বউ’ হয়ে সে যেন সারাক্ষণই আগলে রাখে আসিফকে। প্রতিদিনই কয়েক ঘণ্টা ওর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তারপরও যেন আসিফের শূন্যতা কাটে না।
টুশির কাগজপত্র গোছাতে শুরু করেছিল আসিফ। এরই মধ্যে দ্রুত করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারিতে রূপ নেয়। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল, অর্থনৈতিক চরম মন্দা, বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনীতি প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত, ভয়াবহ এক অনিশ্চয়তা বিশ্ববাসীকে যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। ক্ষমতাধর পরাক্রমশালী দেশগুলো এ খুদে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেন পরাস্ত। সমাজের কত বিত্তশালী ক্ষমতাবান আমলা, মন্ত্রী, শিল্পপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সর্বস্তরের মানুষকে গ্রাস করতে থাকল এ ব্যাধি। ফ্লাইট চলাচলও বন্ধ হয়ে গেল। ওদিকে কানাডা সরকার তার রেসিডেন্স ও সিটিজেনদের কানাডা ফিরে আসতে বলেছে। কিন্তু নতুন করে কানাডায় মানুষ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। টুশিকে কানাডা আনার ব্যাপারে আসিফের যথেষ্ট টেনশন হতে থাকে। ওদিকে মায়েরও বয়স হয়েছে। প্রথম দিকে টুশি ওর বাবার বাড়ি ধানমন্ডিতে ছিল। লকডাউন একটু শিথিল হলে উত্তরাতে আসিফের মায়ের সঙ্গে কিছুদিন থেকে এসেছে। ইতিমধ্যে করোনায় ওর একমাত্র মামা ও কিছু আত্মীয়স্বজন মারা গেছে।
বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে কোভিড-১৯-এর ওষুধ আবিষ্কারের জন্য। গত কয়েক মাসে আমাদের চিরচেনা পৃথিবী যেন অনেকটাই বদলে গেছে। করোনায় মৃত্যু হলে আপনজনও ভয় পায় সৎকার করতে! লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং শব্দগুলো এখনকার জীবনযাত্রায় একেবারে মিশে গেছে। উইকেন্ডে চিরাচরিত দাওয়াতের হিড়িক আর নেই। মাস্ক পরে চেনা মানুষও বড়ই অচেনা হয়ে গেছে।
সেপ্টেম্বর থেকে ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়েছে আবার। টুশির কাগজপত্র ধীর গতিতে প্রসেস হচ্ছে। আশা করা যায় জানুয়ারির দিকে আসিফ ওকে কানাডা নিয়ে আসতে পারবে। ওদিকে শীত শুরু হওয়াতে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে নতুন করে বহু মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সাত কোটিরও বেশি মানুষ এ মহামারিতে আক্রান্ত। প্রতিদিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানীরা ১০ মাসের নিরলস পরিশ্রমে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। যদিও বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে প্রায় ২৫ বারের মতো করোনাভাইরাস তার চরিত্র পরিবর্তন করেছে। তবুও আশার আলো দেখতে শুরু করেছে মানুষ।
এর মধ্যে হঠাৎ টুশির শরীর খারাপের খবর এল। প্রথমে ভেবেছিল ঠান্ডা-জ্বর। কিন্তু কয়েক দিন পর করোনা টেস্ট করে পজিটিভ রেজাল্ট আসে। খবর পেয়ে জরুরি ভিত্তিতে আসিফ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রায় দুদিনের জার্নিতে ও দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। টুশির প্রতি এক পরম মমত্ববোধ কাজ করে। এক সুগভীর ভালোবাসা উপলব্ধি করে আসিফ।
ভোরবেলায় বাংলাদেশে পৌঁছে এখান থেকেও করোনা টেস্ট করে ‘নেগেটিভ’ সার্টিফিকেট নেয় আসিফ। টুশি ‘এভার কেয়ার’ হাসপাতালে ভর্তি। সেখানকার এক বড় চিকিৎসক ওদের রিলেটিভ হওয়ায় টুশিকে এক নজর দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। ওদিকে টুশির অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। আসিফের পক্ষে যতটা হাসপাতালে থাকা সম্ভব হয়, ততটা সে করে। চিকিৎসক জানালেন, ৭২ ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। কয়েকটা দিন জমে-মানুষে টানাটানি চলল।
অবশেষে সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে চাইলেন। জ্বরটা কমের দিকে গেলে ওকে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়। এটা মোটামুটি ভালো রেসপন্স করতে থাকে। ওর অসম্ভব জীবনীশক্তি ওকে লড়াইয়ের শক্তি জোগায়। পরম করুণাময়ের অপার মহিমায় টুশি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে। আরও কিছুটা সুস্থ হলে কেবিনে স্থানান্তরিত করা হয় তাকে। এখন টুশি মোটামুটি শঙ্কামুক্ত। কিন্তু দুর্বলতা কাটতে সময় লাগবে। তাই আরও কিছুদিন হাসপাতালে থেকে যাওয়াই উত্তম।
হাসপাতালের বেডটা পূর্ব দিকের জানালার পাশে। টুশি আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকাল। ভোরের সূর্যের ছটা ওর চোখেমুখে পড়েছে। আসিফ ক্লান্ত হয়ে টুশির বিছানার পাশে চেয়ারে বসে দেখে টুশির চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। আসিফ আলতো হাতে সে পানি মুছে দিয়ে বলে—আমার টুনি বউ তোমাকে আমি আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।
টুশির চোখে মুখে পূর্ব আকাশের ভোরের সূর্যের আলোর ছটা। এ যেন নতুন করে ফিরে পাওয়া আসিফের ‘টুনি বউকে’।