টুকরো কিছু স্মৃতি

মাকে আলাদা করে মিস করার কিছু মনে হয় না আমার কাছে। মা তো আমার রক্তের ধারায়ই মিশে থাকেন, প্রতিটি হৃৎস্পন্দন ৷ তাই নতুন করে মিস করি, বলতে ইচ্ছা করে না। নতুন করে মিস করি, বলার অর্থই হলো মাঝে মাঝে মিস করি না, সে রকমই কিছু। আমার মা খুবই সাধারণ একজন ৷ একেবারেই সাধারণ বাঙালি ঘরকন্না করা গৃহিণী। মা লিখতে-পড়তে জানেন, এ পর্যন্তই। বাবাকেই আমার সব থেকে লজিকাল মনে হতো, যখন কিছু বুঝতাম না তখন থেকেই। খুব বেশি পড়াশোনা না করলেও কথাবার্তায় যথেষ্ট শিক্ষিতের পরিচয়ই বিদ্যমান।
ছোটবেলায় সব বাচ্চারই দুধভাত মেখে খাওয়ার গল্প হয়তো মনে আছে। মা আমাকেও রাতে চাঁদ দেখিয়ে হাতের বাটিতে সেভাবেই দুধভাত মেখে ছলিয়ে বলিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন। তখন বিদ্যুৎ দূরে থাক, ১২ ভোল্টেজের ব্যাটারির টিভিও আমাদের ছিল না যে, কোনো বিজ্ঞাপন দেখিয়ে ভোলাবে। আমি ছোটবেলা থেকেই অকালপক্ব আর এই বিদেশিগুলোর মতো মানসিকতা ছিল ৷ এটা কীভাবে পেলাম, তা আরেক গল্প। মা হয়তো লবণ দেখার ছলে একটু খেতে চাইত ৷ কিন্তু আমি অন্য রকম ৷ আমার খাবার কেউ খেলে এমনকি মা খেলেও খেতাম না। আমার কথা হলো, কারও যদি খেতে ইচ্ছে করে, সে তার খাবার নিয়ে খেলেই তো হয়। সেখানে তো কোনো দোষ নেই।
মা আমাদের এতটাই নিরীহ ছিল যে, বাবার সামনে কখনো মুখ তুলে দুটা কথা বলতে দেখিনি। আর আমাদের বাড়িতে আমি বাদে বাবার সামনে কেউই সে সাহস পেত না কথা বলতে। আমি তখন খুবই ছোট। শুধু দুধই খাই, জোর করে দু-একটা ভাত খাওয়ানোর বয়স। আমার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন ৷ একেবারে বিছানায় পড়ে গেলেন ৷ অফিসেও যেতে পারেন না। এ সময়ই আমাদের যৌথ পরিবার থেকে আলাদা করে দিল চাচারা। আমরা ছোট ছোট তিন ভাই আর আমার দুই বড় আপু, অসুস্থ আব্বা, সবকিছুই কেমন যেন অদৃশ্য ক্ষমতা বলে মা সংসারের হাল ধরে দিব্বি পার করে দিল সিনেমার মেজো বউদের মতোই। আমার মা, আমি আর আমার বাবা তিনজনই মেজো, আর মেজোদের মনে হয় কিছু অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে।
আমার মা খিচুড়ি খেতে পারতেন না৷ খুব আদুরে ছিলেন নানাদের কাছে। আমার বাবারা পুরাই চাষাভুষা ৷ ফলে শখ আহ্লাদের কেউ কোনো মূল্যই দেয়নি। আমি যখন মার গর্ভে তখনো মাটির বাড়ি বানানোর জন্য মাটি টানতে হয়েছে মাকে। একদিন তো নাকমুখ দিয়ে রক্তই বের হয়ে গেল। আর খাবারদাবার নিয়ে আগেকার দিনের গ্রামের শাশুড়িদের গল্প, যাঁদের বয়স হয়েছে, তাঁরা হয়তো জানেন। মা কখনো আমাদের কোনো ভাইবোনকে একটা ধমক দিয়ে কথা বলেছেন, বলে মনে হয় না। সে জন্যে আমরাই মাকে বকতাম, ‘তুমি কেনো আমাদের সঙ্গে ধমক দিতে পারো না? আমরা তো অনেক সময়ই খারাপ কিছু করে ফেলি। গ্রামের সব থেকে বড় ঝগড়াটে মহিলাটা আমাদের পাশেই বাড়ি করল মাঠের মধ্যে৷ ’ মা একদিন নিজে থেকেই তাকে গিয়ে বলল, ‘তুমি নাকি অনেক ঝগড়া করো তাই টিকতে না পেরে চলে এসেছ? তো আমার সঙ্গে তো একদিনও ঝগড়া করলে না। ’ উনি তো পুরাই অবাক হয়ে বললেন, ‘মানুষের সঙ্গে কখনো ঝগড়া হয় না, আমি চাইলেও হবে না। ’ মার গল্প সারা দিন-রাতেও শেষ হবে না, যেটা বলার জন্য লেখা সেটা বলি।
মাস্টার্সে যখন পড়ি, একবার বাড়িতে গেলাম ৷ আসার সময় মা একটা মাফলার দিয়ে বলল, ‘এটা কি নিয়ে যাবা? ’ দেখলাম বড়সড় একটা মাফলার ৷ মোটেও ফ্যাশনেবল না৷ তবে এটা দিয়ে শীতকে কাবু করা যাবে। আজকালকার মাফলার নামের পাতলা কাপড়ের মতো না। আমি নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললাম। আমার আনন্দে ব্যাগে ঢোকানো দেখে মা হঠাৎ কষ্ট নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘এটা তোমার বড় ভাইকে দিয়েছিলাম কিন্তু তার পছন্দ হয়নি, তাই রেখে গেছে। ’ আমি অবস্থা শিথিল করার জন্য বললাম, ‘এটা কোনো ব্যাপারই না। পছন্দ না হলে নেবে কেন? ’
অনেক দিন ব্যবহার করেছি, এমনকি শিক্ষক হওয়ার পরও কত ব্যবহার করলাম। বেশ কাজের একটা জিনিস, যতবারই ব্যবহার করতাম, ততবারই মনে হতো এটা তো মা দিয়েছিল। সেটাতে আদর মেশানো থাকতো। ইঁদুর যদি এসে কেটে না দিত, নির্ঘাত এটাকে ত্যাগ করতে বহু মনঃকষ্টে ভুগতাম।
বিদেশে আশার আগে বাড়িতে গেলাম ৷ মা একটা রুমাল দিয়ে বলল, ‘এটা কি নিবা? ’ আমি সানন্দে নিয়ে ব্যাগে ঢুকালাম। ওটা এখনো আমার ব্যাগেই আছে। এখানে আসার পর যতবার বৃষ্টি হয়, আমার মুখ আর সাইকেলের সিট মোছার সময় রুমালটা বেশ কাজে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের নিরীহ মুখটা মনে হয়। আমি আসলে দেখানো আবেগের ক্ষেত্রে বেশ দুর্বল, এটা মোটেও কাজ করে না আমার কাছে ৷ কিন্তু দূর থেকে সত্যিই অনুভব করতে পারি। আজকেও বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছি, লাইব্রেরিতে ঢুকে ওটাই আমার সম্বল, চুল আর মুখ মোছার জন্য। পাশেই ইতালিয়ান বন্ধু জিনেভারা ছিল ৷ ওকে বললাম, ‘জিন, এইটা আমার মায়ের দেওয়া। ’ ও চোখেমুখে ঝিলিক দিয়ে মেসবাহ স্যারের মতো বুড়ো আঙুল তুলে বলল, ‘সুপার কুল। ’ আমার বাড়ির কথাও জিজ্ঞেস করল। নগণ্য দামের এক রুমালের সঙ্গে কত আবেগ, অনুভূতি আর কত গল্পই না জড়িয়ে থাকতে পারে।
আশার সময় যে কাঁথা গায়ে দিতাম, সেটা বাড়িতে পাঠানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। চাইলেই কাউকে দিয়ে আসতে পারতাম। আমার টিএসসির আপন ভ্রাতৃসমতুল্য মানুষগুলোকে বলাই হয়ে ওঠেনি যে এই কাঁথাগুলো আমার মায়ের হাতের স্পর্শ দিয়ে বানানো আর প্রতিটি পরতেই আছে তার শরীরের ছোঁয়ায় ধন্য শাড়িগুলো। গ্রামে এই পুরোনো শাড়ি দিয়েই মা-চাচিরা কাঁথা বানান। কীভাবে সেগুলোকে পর করে দেয়!
আসার সময় মাকে বুঝিয়ে এলাম, ‘এটা কোনো ব্যাপারই না। কাঁদছো কেন? সামনে সামারেই তো চলে আসব। ’ আমি দেশে থাকলেও বছরে দু-একবারই বাড়িতে যাই। পার্থক্য এটুকুই যে, অন্য জেলায় নয় নতুন একটা দেশে যাচ্ছি ৷ আর বাসে না চড়ে প্লেনে যাচ্ছি। তাতেও কি আশ্বস্ত করা সম্ভব মায়ের মন!
ভালোবাসা আর অনুভূতির কোনো সংজ্ঞা আমার জানা নেই ৷ তবে এটুকু মনে হয়, তাকে মুখে বলে নয় মনের মধ্যে অজান্তেই অনুভব করতে হয়, দূর থেকে, খুব গোপনে।
(লেখক: শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ ৷ বর্তমানে উচ্চশিক্ষার্থে নেদারল্যান্ডসপ্রবাসী ৷ Wageningen University and Research, Wageningen, The Netherlands)