টিকটক কুইন
—হারামজাদা আসতে এত দেরি করলি কেন?
বাসায় ঢুকতেই খালা চিৎকার করে উঠলেন। আমি শান্ত স্বরে বললাম,
—খালা, গালি দিয়ো না। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিল। তা তুমি কি রেডি?
—রেডি মানে? আমি আর ময়নার মা তিন ঘণ্টা থেকে রেডি হয়ে বসে আছি।
ময়নার মা হলেন খালার বাসার গৃহকর্মী। দীর্ঘদিন থেকে তিনি এ বাসায় কাজ করেন।
—ময়নার মাও কি আমাদের সঙ্গে যাবেন?
—হ্যাঁ যাবে। আচ্ছা দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে? জানিস, গত তিন ঘণ্টা ধরে সাজুগুজু করেছি।
ভালো করে খেয়াল করলাম, খালা মারাত্মক সাজ দিয়েছেন। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম।
—কিরে, চুপ করে আছিস কেন? উত্তর দে।
—সত্যি বলব?
—অবশ্যই সত্যি বলবি।
—তোমারে পেত্নীর মতো লাগছে।
উত্তর শুনে ময়নার মা ফিক করে হেসে ফেললেন। আমি খেয়াল করলাম, খালার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে।
—খালা, তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
—রানা, তুই তো দেখি দিনকে দিন বেয়াদব হচ্ছিস। তোরে তো তোর মা আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠায়ে ফেলছে।
—খালা শোনো, আমি যা সত্য তাই বলেছি। গুরুজনেরা বলেছেন, সদা সত্য কথা বলিবে।
—খবরদার হারামজাদা, আমার সঙ্গে জ্ঞানের কথা বলবি না।
—তুমি কিন্তু আবার আমাকে গালি দিচ্ছ।
—গালি দেব না তো কী করব? আমি সকাল থেকে কত সময় নিয়ে সাজলাম। তোর খালুরে জিজ্ঞেস করেছি, সে বলল, নায়িকা মাধুরীর মতো লাগছে। আর তুই কী বললি!
—খালু তোমাকে মাধুরী বলেছেন! উনি অবশ্যই মিথ্যা বলেছেন। আর না হলে উনার চোখে সমস্যা আছে। খালা শোনো, তুমি যে উদ্ভট সাজ দিয়েছ, তাতে তোমার থেকে ময়নার মাকেই বেশি সুন্দর ও স্মার্ট লাগছে। কী ময়নার মা আপা, আমি কি মিথ্যা বলেছি?
ময়নার মা লজ্জা পেয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকলেন। তারপর বললেন,
—না ভাইজান, আমনে সত্য বলছেন। আমনে মানুষটা আসলে খুবই জ্ঞানী মানুষ। আমনে আমারে সুন্দর কইছেন, আমি খুউব খুশি হইছি। গরিব মাইনসের প্রশংসা এই দুনিয়ায় কেউ করে না ভাইজান। আমি ভাইজান বরাবরই সুন্দর। জীবনে একটা শখ ছিল নায়িকা হব। শাকিব খানের সঙ্গে অভিনয় করব, ড্যান্স দেব। গুন্ডারা আমারে উঠায়ে নিয়া যাইব আর শাকিব খান আমার জন্য গুন্ডাগো লগে ফাইট দেব। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। শাকিব খানের লগে এখনো দেহাই হইল না। ভাইজান, আমনে কি আমারে একবার শাকিব খানের কাছে নিয়া যাবেন?
—অবশ্যই নিয়া যাব। তা আপনি কি শুধু শাকিব খানের সঙ্গেই দেখা করবেন? নাকি অনন্ত জলিলের সঙ্গেও একটু দেখা করবেন?
—এইটা কী বললেন ভাইজান! অবশ্যই দুজনের সঙ্গেই দেখা করব।
—ওকে, নো প্রবলেম। তা আপা, আপনি কি নাচ জানেন?
আমার প্রশ্ন শুনে ময়নার মা লাজুক মুখে বললেন,
—জি ভাইজান, একটু-আধটু জানি।
—ভেরি গুড। নাচ জানলে তো খুবই ভালো। অবশ্য না জানলেও সমস্যা নেই। মোটামুটি লাফাতে জানলেই চলবে। বাকিটা ড্যান্স ডিরেক্টরের কাজ।
—ভাইজান, আমনে টেনশন নিয়েন না। আমি ভালো নাইচ জানি। ভাইজান, আমনে মনে হয় জানেন না, আমি একজন সেলিব্রিটি।
—তাই নাকি! আপনি সেলিব্রিটি?
—জি ভাইজান। আমি টিকটক করি। আমার অনেক পলুয়ার। তা ভাইজান, আমনে কি আমার একটা নাইচ দেখবেন?
—অবশ্যই দেখব। আপনি শুরু করেন।
ময়নার মা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে বললেন,
—কোন গানের লগে নাচুম ভাইজান? হিন্দি না বাংলা?
হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, খালা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। খালার তাকানোর স্টাইল দেখে বুঝলাম অবস্থা বেশি সুবিধার না। তাই থতমত খেয়ে বললাম,
—আপা, আপনাকে নাচতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি নাচ ভালোই জানেন। আমি শিওর, শাকিব খান একবার আপনাকে দেখলে আর ছাড়বে না।
—জি ভাইজান, আমারও তাই মনে হয়। তা ভাইজান আমারে কবে নিয়া যাবেন?
খালা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার তিনি মুখ খুললেন। ধমকের সুরে ময়নার মাকে বললেন,
—ময়নার মা একটু শান্ত হও। আমরা যে কাজে যাচ্ছি সেটা আগে শেষ করে আসি। তারপর তুমি শাকিব খান, শাহরুখ খান যাঁর সঙ্গে ইচ্ছা দেখা করতে যেয়ো। ঠিক আছে?
খালার কথা শুনে ময়নার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখ কালো করে ফেললেন। তারপর হতাশ কণ্ঠে বললেন,
—জি আম্মা, আমি শান্ত হইতেছি। আসলে গরিবের উন্নতি, বড়লোক গো সহ্য হয় না গো আম্মা।
ময়নার মায়ের মলিন চেহারা দেখে মায়া লাগল। আমি খালাকে বললাম,
—খালা শোনো, উনি বাংলা সিনেমার একজন ভবিষ্যৎ নায়িকা, তার ওপর উনি একজন বিশিষ্ট টিকটক শিল্পী। তুমি তো তার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারো না।
—ওই, তোরে না বলছি আমার সঙ্গে জ্ঞানের কথা বলবি না।
—খালা, তোমাদের এই এক সমস্যা, তোমরা কেন জানি জ্ঞানের জিনিস নিতে পারো না। আচ্ছা বাদ দাও। তা খালা আমার শ্রদ্ধেয় খালুজান কোথায়?
—সে এখন টয়লেটে। সকাল থেকে হাগতাছে।
—সকাল থেকে হাগতেছে মানে? উনার কি পেট খারাপ?
—না পেট খারাপ না। পেট ভালোই আছে।
—তুমি না বললে খালু সকাল থেকে হাগতেছে।
—হ, হাগতাছে। তবে তার পেট খারাপ না। সে জোর কইরা হাগতাছে।
—বল কী! কেউ কি জোর করে হাগতে পারে!
—না, কেউ পারে না। তবে ওই বুইড়া পারে। ওই বুইড়ার পক্ষে সবই সম্ভব। আমাদের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার ভয়ে সে এ কাজ করতেছে।
—আচ্ছা খালা আমরা যাচ্ছি কোথায়?
—টিএসসিতে।
—টিএসসিতে কেন?
—সেটা এখন বলা যাবে না। কারণ বললে তুই যাবি না।
খালার গাড়িতে করেই আমরা টিএসসিতে গেলাম।
টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে খালা নিজের ফোন বের করে আমার হাতে দিলেন। তারপর বললেন,
—শোন, এখন আমি আর ময়নার মা হিন্দি গানের সঙ্গে এখানে ড্যান্স দেব। আর তুই তা ভিডিও করবি।
—কী বললা, তোমরা ড্যান্স দিবা মানে!
—ড্যান্স দেব মানে ড্যান্স দেব। তুই ড্যান্সের মানে জানিস না? ড্যান্সের বাংলা হলো নাচ। মানে আমরা এখন এখানে নাচব।
—খালা, ড্যান্সের বাংলা কী, সেটা আমি জানি। আমার প্রশ্ন, তোমরা কেন এখানে নাচবা?
—আরে, আমরা টিকটক ভিডিও বানাব। —মাই গড, তুমি কি সিরিয়াস! —অবশ্যই সিরিয়াস। তুই জানিস ময়নার মা টিকটক করে সেলিব্রিটি হয়ে গেছে? টিকটকে তার নাম হচ্ছে ময়না কুইন। আমিও ময়নার মায়ের মতো ভাইরাল হতে চাই। —খালা তুমি আমারে এ জন্য এখানে আনছ? আর খালা তুমি যে নাচবে, তুমি কী নাচ জানো? —আগে জানতাম না, এখন জানি। গত তিন দিন ধরে আমি নাচ শিখছি। —কার কাছে? —ময়নার মার কাছে। সে আমার নাচের কোরিওগ্রাফার। —ময়নার মা কোরিওগ্রাফার! —হ্যাঁ। ও হিন্দি সিনেমা দেখে দেখে নাচ শিখেছে। —খালা তুমি আর তোমার কোরিওগ্রাফার মিলে তোমাদের যা খুশি তাই করো। আমি তোমাদের সঙ্গে নেই। আমি গেলাম, খোদা হাফেজ। —থাপ্পড় দিয়ে তোর সব দাঁত ফেলে দেব। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। —খালা শোনো, টিএসসিতে আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আসা-যাওয়া করে। এখানে অনেকেই আমাকে চেনে। তুমি একজন বয়স্ক মহিলা, তার ওপর উদ্ভট এক সাজ দিয়ে আসছ। এখন তুমি যদি এখানে নেচে নেচে ভিডিও বানাও, সেটা কি দেখতে ভালো লাগবে? —শোন, টেনশন করিস না। আমরা তোকে বিব্রত করব না। আজ আমরা একটি মার্জিত গানের টিকটক ভিডিও বানাব। —ঠিক আছে, আগে বলো কি গানের ভিডিও বানাবে। যদি গান মার্জিত হয়, তাহলে আমি আছি, না হলে আমি নেই। —অবশ্যই মার্জিত গান। মাধুরীর বেটা সিনেমার একটা গান ছিল না। বলেই খালা সুর করে গাইতে লাগলেন, ‘আউচ ও ধক ধক করনে লাগা, ও মোর জিয়ারা ডরনে লাগা। ছাইয়া বাইয়া ছোর না, কাচ্চি কলিয়া তোরনা...’। ধক ধক করনে লাগা গানটি বলার সঙ্গে সঙ্গে খালা আর ময়নার মা শরীরটা একটু ঝাঁকালেন। সেই সঙ্গে বাঁ হাত কোমরে রেখে এবং ডান হাত মুঠো করে নিজের বুকে দুবার কিল মারলেন। আর দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়িয়ে চেহারার মধ্যে একটা কামুক ভাব ফুটিয়ে তুললেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। —মাই গড, এই তোমার মার্জিত গান! আর খালা এই মাত্র যে শরীর ঝাঁকালে, তোমরা কি আসলেই এভাবে নাচবে! —আরে, এটা তো একটু ঝলক দেখালাম। এটা কিছুই না। মূল গান বাজালেই দেখবি নাচ কাহাকে বলে। দেখিস আজ পুরো টিএসসি ঝাঁকায়ে দেব। ময়নার মা যা কোরিওগ্রাফি করেছে না। —মাই গড, আপা, আপনি এই বাজে নাচ কীভাবে বানালেন! —ভাইজান, এভাবে না বানালে তো পাবলিক দেখবে না। আর পাবলিক না দেখলে তো সেলিব্রিটি হওয়া যাবে না।
—খালা শোনো, বয়সের হিসাব অনুযায়ী কাজ করা উচিত। তোমাকে টিকটক ভিডিও বানাতে মানা করছি না। তবে মার্জিত একটা ভিডিও বানাও। যেটা তোমার বয়সকে ম্যাচ করবে। —আমি বুঝলাম না, তোর সমস্যা কী? সেই তখন থেকে বারবার বয়স বয়স করছিস। শোন, বয়স একটা সংখ্যামাত্র। জানিস, নারীর বয়স নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী বলেছেন? —কী বলেছেন? খালা কবিতার সুরে আবৃত্তি করে বললেন, ‘ওরে অধম, নারীর বয়স নিয়ে তুই মাথা ঘামাস না। ওরে অধম, নারীর বয়স ত্রিশের পর আর বাড়ে না। ওরে অধম,... —খালা, তুমি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ? এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা? তুমি এটা কোন বইয়ে পেয়েছ? —শোন, এটা উনার ডায়েরিতে পাওয়া গেছে। এটা প্রকাশিত হয়নি। তুই বিশ্বাস না হলে ময়নার মাকে জিজ্ঞেস কর। —জি ভাইজান, আম্মা ঠিক বলছেন। রবীন্দু স্যার এটা কইছেন। —মাফ চাই, আমি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তোমাদের দুজনের সঙ্গে কোনো তর্ক করব না। তোমরা নাচবা তো? নাচো, আমি ভিডিও করছি, যা করবা তাড়াতাড়ি করো।
—ভাইজান, আমনে অ্যাকশন বলেন। আমনে অ্যাকশন বললেই আমরা শুরু করব। আমি বাধ্য হয়ে বিরক্তি নিয়েই অ্যাকশন বললাম। আমি অ্যাকশন বলার সঙ্গে সঙ্গে দুই মহিলা কোমর, শরীর কাঁপিয়ে-ঝাঁকিয়ে যেভাবে নাচ শুরু করলেন, আমি অবাক হয়ে হাঁ করে রইলাম। খেয়াল করে দেখলাম আশপাশে ইতিমধ্যে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। তারা সবাই মজা করে এই দুই টিকটক পাগলের পাগলামি দেখছে। রেকর্ডিং শেষ হতেই আশপাশের অনেকে ছুটে এলেন। তারা সবাই ময়নার মাকে ঘিরে ধরলেন সেলফি তোলার জন্য। এদের মধ্যে অনেকেই ময়নার মাকে চিনতে পারলেন। যাঁরা চিনতে পারলেন, তাঁরা উনাকে ‘ম্যাডাম ময়না কুইন’ বলে সম্বোধন করতে লাগলেন। খেয়াল করে দেখলাম, ময়নার মায়ের চেহারার মধ্যে একটা সেলিব্রিটি ভাব ফুটে উঠেছে। আমি বোকার মতো খালার ফোনটি হাতে নিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। খালা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ঈর্ষার দৃষ্টিতে ময়নার মাকে দেখতে লাগলেন। একটু পর উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, —রানা দেখিছ, একদিন আমিও এ রকম একজন সেলিব্রিটি হব। তখন সবাই আমার নাম ধরে এভাবে ডাকবে। আর আমার সঙ্গে সেলফি তুলবে। আমিও খালার মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত কণ্ঠে বললাম, —খালা, তোমার টিকটক নাম কী? মানে পাবলিক তোমাকে কী নামে ডাকবে? খালা গলার আওয়াজে একটু মাদকতা মাখিয়ে বললেন, —আমার নাম ম্যাডাম হট কুইন।
আমি আস্তে আস্তে আমার ঘাড় বাঁকা করে পাশে দাঁড়ানো খালার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। আর মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ তুমি এদের হেদায়েত করো।
বি.দ্রষ্টব্য: টিকটক করা খারাপ কিছু না। তবে সেটা আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে করা উচিত। তাহলে দেখবেন এটা মানুষের কাছে ততটা দৃষ্টিকটু লাগছে না।
বি. দ্রষ্টব্যের বি. দ্রষ্টব্য: ভাবছি একটা টিকটক অ্যাকাউন্ট খুলব। কিন্তু কী নাম দেব বুঝতে পারছি না। একটা খুবই আনকমন চটুল নাম দরকার।