টিউলিপ, বাইসাইকেল আর সেতুর দেশ নেদারল্যান্ডস–১

পবিত্র রমজান মাস শুরুর ঠিক আগেই আমরা কয়েকজন গেলাম এক বাসায় দাওয়াতে। সন্ধ্যায় সেই বাসা থেকে বেরিয়ে যখন সবাই যাঁর যাঁর বাসায় ফিরে যাব, ঠিক তখনই সৃষ্টি ভাবী বললেন, ‘চলেন সবাই আমাদের বাসায়, আড্ডা দিই।’ পরের দিন সোমবার, সবার অফিস বা স্কুল তো রয়েছেই, কিন্তু আমরা সবাই যারপরনাই আড্ডাপ্রিয়; তাই মনের মধ্যের দোনোমোনো ভাবটা চাপা দিয়েই আড্ডার প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। রাতে আড্ডা দিতে দিতেই জানতে পারলাম, সৃষ্টি ভাবীদের প্ল্যান হলো ইস্টারের বন্ধে নেদারল্যান্ডসের টিউলিপ গার্ডেনে ঘুরতে যাওয়ার। আমাদেরও ইস্টারের বন্ধ, কিন্তু রোজার কারণে যাব কি না, রোজা রেখে হাঁটতে পারব কি না, ভাবীর বানানো গরম গরম পেঁয়াজু খেতে খেতে এ রকম নানা আলোচনার পরে পাঁচ পরিবার মিলে যাওয়ার মনস্থির করে ফেললাম। ছেলে লিওনেলের স্কুল খোলা থাকলে, তখন চাইলেও স্কুল বাদ দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না; তাই ইস্টারের এ বন্ধই ছিল চট করে কাছের কোথাও থেকে ঘুরে আসার সুযোগ।

জার্মানির পাশের দেশই নেদারল্যান্ডস। ঠিক হলো সবাই মিলে যাঁর যাঁর গাড়িতে যাব। কিন্তু থাকার জন্য কোনো হোটেলই পাওয়া যাচ্ছিল না! কেন? কারণ, এই সময়ে সবারই বন্ধ এবং ইউরোপীয়ানরা অনেক আগে থেকেই এই সময়ের প্ল্যান করে রাখেন, এমনকি হোটেলও বুকিং করে রাখেন। এদিকে আমরা তো দুই সপ্তাহ আগে প্ল্যান করেছি, চাইলেই কি আর এখন হোটেল পাব? তবে কি উপায়? যাওয়াই কি হবে না তাহলে? কিন্তু এত সহজে হতাশ হব কেন? বিপুল উৎসাহের সঙ্গে খোঁজার পরে একটা দারুণ ক্যাম্পিং সাইটের খোঁজ মিলল। সেখানের ছবি আর সুযোগ-সুবিধার বহর দেখে আমরা যারপরনাই আপ্লুত। কারণ, যদি শুধু ওই ক্যাম্পিং সাইটেই আমরা চার দিন থাকি, তাহলে আমাদের, বিশেষ করে বাচ্চাদের কারও একঘেয়ে লাগার সুযোগই নেই। আমাদের প্রথম পছন্দ হলো সন্তানদের আনন্দ। তাই কালবিলম্ব না করেই বুকিং দিয়ে দিলাম। কে জানে এক মিনিট দেরি হলে কটেজই পাব না। দুটো কটেজ নেওয়া হলো। কটেজের ভেতরেই কিচেনসহ সবকিছু রয়েছে। তাই সবাই মিলে রান্না করব, আরও কি কি করব, প্ল্যান চলল যাওয়ার আগ পর্যন্ত ।

নেদারল্যান্ডস বলতে মনে পড়ে বাহারি টিউলিপ ফুলের সমুদ্র, নানা রকমের ‘চিজ’ আর সারি সারি বাইসাইকেল—সেই সঙ্গে আমস্টারডাম নামের একটি ছোট্ট, খালেঘেরা শহর!! ছোটরা তো বটেই, আমরা বড়রাও খুবই আনন্দিত। জার্মানিতে আমরা যেখানে থাকি, সেখান থেকে নেদারল্যান্ডসে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার মতো লাগবে। তবে সবার সঙ্গেই বাচ্চা থাকায় ঠিক হলো, নিজেদের মতো আস্তেধীরে ড্রাইভ করেই যাওয়া হোক। তাই প্রথম দিনটিতে আমরা অন্য কোনো প্ল্যান রাখলাম না। সকালে পুত্র লিওনেলের ডাকে ঘুম ভাঙল, ‘আম্মু আম্মু, তাড়াতাড়ি ওঠো, আমরা রওনা দেব না?’ যাত্রা শুরু করলাম।

বিকেলের দিকে পৌঁছে গেলাম নেদারল্যান্ডসে। আমি ভেবেছিলাম, অন্য দেশে যাচ্ছি, বর্ডারে বড় করে ডাচ্‌ ভাষায় লেখা থাকবে, ওয়েলকাম টু নেদারল্যান্ডস। কিন্তু হঠাৎ রাস্তার ভিন্ন চিহ্ন আর সাইনবোর্ডের ভিন্ন ভাষা দেখে বুঝতে পারলাম যে আমরা নেদারল্যান্ডসে প্রবেশ করে ফেলেছি!! জার্মানির সঙ্গে বেশ কিছু পার্থক্য চোখে পড়ল। যেমন, দেখলাম হাইওয়েজুড়ে প্রচুর লাইট! সবচেয়ে বিরক্তিকর হলো স্পিড লিমিট!! জার্মানিতে যেটা নেই বললেই চলে। রাস্তায় আমার বর বাবাই, কখনো ১০০ কখনো ৮০ কিংবা ৫০ এ ড্রাইভ করতে করতে মনে হচ্ছিল আমরা সবাই মিলে বোধকরি ঘুমিয়েই পড়ব!!! মনে হচ্ছিল যেন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি!! হলি কাউ!!

যা হোক, শেষ পর্যন্ত যখন ক্যাম্পিং সাইটে পৌঁছালাম তখন ঠিক গোধূলীর আগে আগে। মায়াময় আলোয় ভরে গিয়ে ক্যাম্পিং সাইটটা। ভেতরে কেউ সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ জগিং করছে, কেউ তাদের টেরাসে কিংবা ট্রাভেল গাড়ির সামনে ছাতা খুলে তার নিচে বই পড়ছে, আর বাচ্চারা খেলার জায়গাগুলোতে খেলছে, কেউ বা টেবিল টেনিস, কিংবা লন টেনিস। ভেতরের রেস্তোরাঁর বাইরের খাবার জায়গাতে বসে অনেকেই শেষ বিকেলের আলোয় কফি বা ওয়াইন নিয়ে রিল্যাক্স করছে!! আমাদের আরেক কটেজ-১ এর বাসিন্দা ইতু আর জেনিফার ভাবীরা আমাদের অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন।

তাঁরা সময়ের সদ্ব্যবহার করে আমরা পৌঁছাবার আগেই খিচুড়ি রান্না করে ফেলেছিলেন রাতের জন্য। সবাই মিলে ক্যাম্পিং সাইটে কিছুক্ষণ ঘুরে কটেজ-১ এ প্রবেশ করলাম, পুরো কটেজ খিচুড়ির সুবাসে মৌ মৌ করছিল। নেদারল্যান্ডেসের ইফতার রাত পৌনে নয়টার দিকে। তাই সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে খাবার আয়োজন করতে থাকলাম।

রাতের খাওয়া শেষ করে পরের দিনের প্ল্যান করতে বসলাম, সঙ্গে ইতু ভাবীর তৈরি করা মজাদার গরম ধোঁয়া ওঠা চা!! ঠিক হলো পরের দিন যাব, রাজধানী ও রাতজাগা শহর আমস্টারডামে। একে প্রচুরসংখ্যক খালের জন্য উত্তরের ভেনিসও বলা হয়ে থাকে৷ বলা হয়ে থাকে, আমস্টারডামের কেন্দ্র ডামপ্লাৎসেই এই শহরের জন্ম। জেলেরা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আমস্টেল নদীর তীরে বাস করা শুরু করে; পাশাপাশি প্রথম ‘ডাম' অথবা বাঁধটি তৈরি করেন। নেদারল্যান্ডসের রাজধানীর কিন্তু আরও একটি পরিচয় আছে: ইউরোপে আমস্টারডাম হলো সাইকেলচালকদের রাজধানী!! ২০০১ সালে আমস্টারডামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনের কাছে বিশ্বের প্রথম সাইকেল পার্কিং ব্লক তৈরি হয়েছিল! চলবে...