টরন্টোয় বাংলা টেলিভিশনের ব্যতিক্রমী আয়োজন সুরের ধারা

মঞ্চে সুব্রত পুরোহিত ও বীণা পুরোহিত
মঞ্চে সুব্রত পুরোহিত ও বীণা পুরোহিত

অনুষ্ঠানের ঘোষণা যখন হয়, তখনই টিকিট বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম, যাতে মিস না হয়। সুরের ধারা আমি কখনোই মিস করতে চাই না, করিওনি। টরন্টোপ্রবাসী কবি মানজু মান আরা এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানালেন সুরের ধারা নিয়ে। রিয়েলটর জয়ন্ত বণিক বললেন, মন দিয়ে গান শোনার একটা পরিবেশ পাওয়া যায় এই আয়োজনে। এখানে কেবল গানই শোনা যায়, গানের পরিবেশে কিছুটা সময় কাটানো যায়, সে জন্যই সুরের ধারার আয়োজনে গিয়েছি। টরন্টোর বাংলা টেলিভিশনের নিয়মিত মঞ্চ আয়োজন সুরের ধারা সম্পর্কে একবাক্যে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করেন দর্শক-শ্রোতারা।

১৯ নভেম্বর রোববার শহরের ফেয়ারভিউ থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে সুরের ধারা সিরিজের পঞ্চম পরিবেশনা। যেকোনো আয়োজনে শিল্পী বাছাই করা হয়, কিন্তু দর্শক-শ্রোতাও কী বাছাই করা হয়? সুরের ধারা আসলে বাছাই করা দর্শক শ্রোতাদের অনুষ্ঠান। সব দর্শকের জন্য নয়, মানসম্পন্ন দর্শকের জন্য গান—রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে এমন আয়োজন করে যাচ্ছে বাংলা টেলিভিশন।
সুরের ধারার এবারের পর্বে কণ্ঠশিল্পী মোনালিসা চৌধুরী পরিবেশন করেছেন রবীন্দ্রনাথের গান। অনন্যা শিলা শামসুদ্দীন গেয়েছেন নজরুলগীতি। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে পুরোনো দিনের বাংলা গান পরিবেশন করেছেন সুব্রত পুরোহিত ও বীণা পুরোহিত। যন্ত্রশিল্পীরা ছিলেন; তবলায় দোলন সিনহা ও সজীব চৌধুরী, কিবোর্ডে মামুন কায়সার ও মন্দিরায় অখিল রায়। বাংলা টেলিভিশন কানাডার বিশেষ অনুরোধে অনুষ্ঠানে গীত রবীন্দ্রসংগীতগুলোর সঙ্গে এসরাজ বাজিয়েছেন সুনীল গোমস। কেবলমাত্র আমন্ত্রিত ও পূর্ব নির্বাচিত দর্শকে পূর্ণ অডিটোরিয়ামে শত শত দর্শক পিনপতন নীরবতায় অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছেন।

মঞ্চে মোনালিসা চৌধুরী ও অনন্যা শিলা শামসুদ্দীন
মঞ্চে মোনালিসা চৌধুরী ও অনন্যা শিলা শামসুদ্দীন

অনুষ্ঠানের শুরুতেই মঞ্চে আসেন মোনালিসা চৌধুরী। পারিবারিক অনুকূল সাংস্কৃতিক আবহে চট্টগ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মোনালিসা চৌধুরীর সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু শাশ্বত ললিতকলা একাডেমীতে। ফুলকির সোনার তরীতে পাঁচ বছরের সংগীত কোর্স সম্পন্ন করেন তিনি। পরবর্তীতে শীলা মোমেনের তত্ত্বাবধানে রক্তকরবীতে রবীন্দ্রসংগীতের মূল চর্চা শুরু হয় তাঁর। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ আয়োজিত প্রতিযোগিতায় কিশোর ও সাধারণ দুই বিভাগে দুবার প্রথম মান অর্জনকারী মোনালিসা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রতিভা অন্বেষণ ও জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হন। সুরের ধারায় নয়টি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে তিনি দর্শক-শ্রোতাদের প্রশংসা কুড়ান।
এই পর্বেই নজরুলগীতি পরিবেশন করেন অনন্যা শিলা শামসুদ্দীন। অনন্যা শিলা চার বছর বয়সে বাড়িতে হীরালাল সাহার কাছে প্রথম উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেন। পরবর্তীতে মালেকা আজিমের প্রতিষ্ঠিত রাগিণী সংগীত বিদ্যায়তনে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ওস্তাদ আখতার সাদমানীর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেন অনন্যা। রুবিনা আহমেদের কাছেও ব্যক্তিগতভাবে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখেন তিনি। ১৯৯৪ সাল থেকে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনে নজরুল সংগীত বিভাগে শিক্ষা শুরু করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে স্নাতক হন। ছায়ানটের উচ্চাঙ্গ সংগীত বিভাগেও দুই বছর শিক্ষা গ্রহণ করে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত কর্মশালায় প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ শিল্পী ওস্তাদ মাশকুর আলী খার সান্নিধ্য লাভ করেন অনন্যা। নজরুল সংগীতে নীলুফার ইয়াসমিনের কাছে কিছু সময় তালিম নিয়েছেন তিনি। দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় অনন্যা শিলার নজরুল গীতির অ্যালবাম রিলিজ হয় ২০১৫ সালে। অনন্যার পরিবেশনা দর্শক শ্রোতাদের বিপুল প্রশংসা অর্জন করে।
২০ মিনিটের বিরতির পরে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চে আসেন সুব্রত পুরোহিত ও বীণা পুরোহিত। তাঁরা প্রত্যেকে পাঁচটি করে একক এবং চারটি দ্বৈত গান মিলিয়ে মোট চৌদ্দটি স্বর্ণযুগের বাংলা গান একটানা পরিবেশন করেন। তাঁদের পরিবেশিত চম্পা চামেলি গোলাপের বাগে, কে প্রথম কাছে এসেছি, যদি কাগজে লিখ নাম, সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান করো না, এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আগে, এখনো সারেঙ্গিটা বাজছে গানগুলো পিনপতন নীরবতায় দর্শকেরা উপভোগ করেছেন।

দর্শকদের একাংশ
দর্শকদের একাংশ

সুব্রত পুরোহিত আধুনিক বাংলা গান এবং বাংলা ও হিন্দি পুরাতন ফিল্মের গানের একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। এ ছাড়া তিনি ভজন, গজল, নজরুলগীতি, ক্ল্যাসিক্যাল ও সেমি-ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত পরিবেশন করে থাকেন। সুব্রত উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিয়েছেন কিরানা ঘরানার পণ্ডিত অলোক চট্টোপাধ্যায়; বেনারস ও লক্ষ্ণৌ ঘরানার পণ্ডিত দীননাথ মিশ্র এবং উস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের শিষ্যা কঙ্কণা ব্যানার্জির কাছে। সুব্রত পুরোহিতের স্বর্ণযুগের আধুনিক বাংলা গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে।
আর বীণা পুরোহিত প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ শিল্পী পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তীর কন্যা শ্রীলা চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের প্রাথমিক তালিম শুরু। পরবর্তীতে বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পণ্ডিত দীননাথ মিশ্র, কংকনা ব্যানার্জি ও পূর্ণিমা চৌধুরীর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন। বীণা আধুনিক গান ও নজরুলগীতি শেখেন জনপ্রিয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা, অনল চ্যাটার্জি ও পূরবী দত্তর কাছে। ১৯৯৭ সালে বীণার আধুনিক গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তিনি ভারত ও উত্তর আমেরিকায় অনেক পেশাদারি সংগীতায়োজনে অংশ নিয়েছেন। বীণা পুরোহিত বাংলা টেলিভিশন কানাডার সংগীতায়োজনে অনেক বছর ধরে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছেন।
পুরো অনুষ্ঠানটিই দর্শক শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শিল্পীদের গান শুনেছেন। বাছাই করা দর্শক বলেই হয়তোবা দর্শক শ্রোতাদেরও সংগতের প্রতি ছিল পুরোপুরি মনোযোগ। নির্দিষ্ট সময়ে শুরু, নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা সুরের ধারার বরাবরের বৈশিষ্ট্য। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। দর্শক-শ্রোতারা তৃপ্তি নিয়েই অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরেছেন।

সুরের ধারার শিল্পীরা
সুরের ধারার শিল্পীরা

বাংলা টিভিতে প্রচারের জন্য পুরো অনুষ্ঠানটির ভিডিও চিত্র পাঁচটি পৃথক ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে। ভিডিও চিত্র ধারণের দায়িত্বে ছিলেন বাংলা টিভির টেকনিক্যাল ডিরেক্টর গ্যাব্রিয়েল জি কোনজ ও জ্যানা হক। বাংলা টেলিভিশনের পক্ষে অনুষ্ঠানের স্টিল ফটোগ্রাফি করেছেন বন্যা রুনা লায়লা। শব্দযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও শব্দধারণে ছিলেন মার্স জিয়েমবার্কো। অডিটোরিয়ামের সাউন্ড সিস্টেমের কার্যকারিতার সর্বোচ্চ ব্যবহার দেখভাল করেন নন্দিতা গোমস। নেপথ্য থেকে অনুষ্ঠানটিকে সচল রেখেছিলেন হাফিজ আল আসাদ, রিয়াজ মাহমুদ, তাসলিমা জামাল, সুমু হক, বীণা এগনেস সাহা, নাজমা কাজী, স্নিগ্ধা চৌধুরী, পবিত্র মজুমদার, ফোরা শুচি, মমতাজ মমতা, শাহজাহান কামাল ও সাজ্জাদ আলী।
সুরের ধারার আয়োজন প্রসঙ্গে বাংলা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী সাজ্জাদ আলী বলেন, ভালো গান, তৃপ্ত শ্রোতা, শুদ্ধ সংস্কৃতি, বাংলা টিভির প্রতিশ্রুতি—এই লক্ষ্যে পথ চলায় আমরা সবার সহযোগিতা কামনা করি। শুদ্ধ সংগীতের চর্চা ও বিকাশে যাঁরা সহমত পোষণ করেন, বাংলা টেলিভিশন কানাডা তাঁদের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে। সাংস্কৃতিক সুস্থতা বিনির্মাণে আমরা সকলের সহযোগিতা চাই।