ঝগড়া রম্য

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ঝগড়া কী জিনিস? আভিধানিক সংজ্ঞামতে ক্রোধযুক্ত অমত অথবা তর্ককে বলা হয় ঝগড়া। বিশিষ্ট ঝগড়া বিশেষজ্ঞের (যিনি সম্প্রতি তার প্রথম বই প্রকাশ করেছেন) মতে দুজন মানুষের আবেগজনিত অবিবেচনাপ্রসূত আচরণের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ঝগড়া। ঝগড়া অনেক সময় একটি প্রলোভনের মতো। আপনি বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন সময় কেউ একজন লাইন ভেঙে এগিয়ে গেল আপনার সামনে। ঝগড়াঝাঁটির প্রচণ্ড প্রলোভন আছে ব্যাপারটার মধ্যে। এই অবস্থায় আপনি যদি আপত্তি প্রকাশ করেন তবে ঝগড়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ঝগড়ার বেশ কিছু প্রকার আছে। একতরফা ঝগড়া, দুতরফা ঝগড়া, বহু তরফের ঝগড়া, কেয়ামত থেকে কেয়ামত ঝগড়া (যুগ যুগ ধরে ঝগড়া), টি–টোয়েন্টি ঝগড়া (টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটের মতো ঝগড়া, হঠাৎ শুরু হয়ে শেষ), টেস্ট ম্যাচ ঝগড়া (প্রথম সেশনে তর্কাতর্কি, দ্বিতীয় সেশনে কান্নাকাটি, কথা বন্ধ, পঞ্চম দিনে খাওয়া বন্ধ, দেখাদেখি বন্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি), আগ্রাসী ঝগড়া (যে ঝগড়া মারামারিতে রূপ নেয়), নিঃশব্দ ঝগড়া (শব্দহীন ঝগড়াও আছে)। এ ছাড়া বর্তমান যুগে সামনাসামনি না থেকেও আরও কিছু ঝগড়া দেখা যায়। যেমন ফেসবুক ঝগড়া (পাল্টাপাল্টি মন্তব্য, লাইক বর্জন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে খোঁচা দানকারী স্ট্যাটাস ইত্যাদি), ইমেইল ঝগড়া, ফোনে ঝগড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই বহুরকম ঝগড়ার মধ্যে একতরফা ঝগড়া বড়ই কষ্টদায়ক। একজন কম ঝগড়াটে ব্যক্তি এই ঝগড়ার শিকার হতে পারেন। এক হাতে তালি বাজার মতো ব্যাপার এই ঝগড়া। একজন চরম ঝগড়ার মুডে আছে আর অন্যজন একদম সেই মুডে নেই। সেই অবস্থায়ও এ ঝগড়া হতে পারে। এক পরিচিত একবার গল্পোচ্ছলে বলেছিলেন, তার স্বামী নাকি ঝগড়া শুরু হতে না হতে ঘুমিয়ে পড়েন। এতে তার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। ঝগড়ার প্রতি এত বড় অপমান কী সহ্য করা যায়! তখন তিনি ঘুম থেকে তাঁকে জাগিয়ে ঝগড়া করেন।

দুতরফার ঝগড়াতে দুজনে কথা বলেন। অনেক ক্ষেত্রে এরা একটা সিস্টেমের মধ্যে থেকে ঝগড়া করেন। একজনের কথা শেষ হলে আরেকজন শুরু করেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় দুজনেই একই সঙ্গে কথা বলছেন (পড়ুন ঝগড়া করছেন) এবং প্রকৃতপক্ষে কেউ কারও কথা শুনছেন না। আর বহু তরফের ঝগড়া বেশ মজার। এই ক্ষেত্রে দুজন ঝগড়া শুরু করেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তৃতীয় অথবা আরও অনেক মানুষ এই ঝগড়ায় যোগদান করেন। পরবর্তীতে তা বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে দুজন ঝগড়া শুরু করেছেন তারা বন্ধু হয়ে গেছেন, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাকি পার্টি তখনো চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

টি–টোয়েন্টি ঝগড়া ব্যাপারটা বেশ মর্মান্তিক। স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই ঝগড়া বেশ বিদ্যমান। দেখা গেল সুন্দর সময় কাটছে স্বামী-স্ত্রী দুজনের। হঠাৎ বলা নাই কওয়া নেই শুরু হয়ে গেল ঝগড়া। এই ঝগড়ার সূত্রপাতের জন্য বেশি কিছু লাগে না। অল্প স্বল্প কোনো অসংবেদনশীল বাক্য বা শব্দতেই অনেক সময় শুরু হয়ে যায়। ঝগড়ার স্থায়িত্ব অতি অল্প সময় সব সময় নাও হতে পারে, এই ঝগড়া ধীরে ধীরে টেস্ট ম্যাচ ঝগড়ায় রূপ নিতে পারে।
ঝগড়ার একক (ইউনিট) কী? আবেগের ইউনিট হয় না এটা জানা কথা। তারপরও যদি ঝগড়ার জন্য একধরনের ইউনিট থাকত তাহলে ভালো হতো। পাত্র বা পাত্রীর বায়োডাটার মধ্যে ডাক্তার কর্তৃক সার্টিফায়েড সেই ইউনিট দেওয়া থাকত। ০.৫ ইউনিটের নিচে থাকলে কম ঝগড়াটে হিসেবে সেই পাত্র বা পাত্রী বিবেচিত হতো। ঝগড়ার ইউনিট না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে ঝগড়াটে খ্যাতি বা অখ্যাতি সমস্যা তৈরি করে। একবার এক পাত্রীর ব্যাপারে খোঁজ–খবর করতে গিয়ে আমার এক পরিচিত জানলেন, মেয়ে ভয়াবহ ঝগড়াটে। সেই বিয়ের সম্পর্ক আর আগায়নি। অনেককে মেয়ে বা ছেলের ঠোঁটের পুরুত্ব অনুসারে কেমন ঝগড়াটে হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে শুনেছি। আমাদের গ্রামের দিকে প্রচলিত আছে, ঠোঁট পাতলা বউ ঝগড়াটে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আরও একটা সাংঘাতিক জিনিস প্রচলিত আছে। সেটা হচ্ছে কিছু কিছু জেলার মানুষ নাকি ভয়ংকর ঝগড়াটে। অনেকে শুধু এই কারণে সেই সব জেলার ছেলে-মেয়ে বিয়ে করতে চান না।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমরা ছোটবেলা থেকে যখন বড় হই তখন অনেক কিছুই শিখি। কিন্তু যে জিনিসটা শেখা হয় না সেটা হচ্ছে কীভাবে সংসার করতে হয়। শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষ হচ্ছে এই দিক থেকে নাদান বাচ্চা। একটা মজার লেখা পড়েছিলাম যেখানে লেখা ছিল, বিয়ের আগে টেক্সট মেসেজে থাকত লাভ ইউ, মিস ইউ, তুমি আমার জান আর বিয়ের পরে মেসেজ আসে আদা, রসুন, মরিচ, পেঁয়াজ, তেল, চাল। তার মানে অনেক দিন প্রেম করে বিয়ে করলেও সংসার ব্যাপারে দুজন মানুষের জ্ঞান তেমন একটা থাকে না আর অ্যারেঞ্জড বিয়ে বাদই দিলাম। তো এই সংসারে একটা বড় অনুসঙ্গ হচ্ছে ঝগড়া। যারা এখনো বিয়ে করেননি তাদের ভয় পাওয়াতে চাচ্ছি না (যেসব সংসারী মানুষ বিবাহিত জীবনে কখনো ঝগড়া করিনি বলেন তাদের জন্য আমার গভীর শ্রদ্ধা)। এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কোর্স নেই, সবই ‘অন দ্য জব’ শেখা। অবশ্যই এই বিষয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স থাকা উচিত। আমার হিসাব মতে কোর্সটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই থাকা উচিত।
ঝগড়া ১০১: বিবাহিত জীবনের প্রথম তিন বছরের ঝগড়া মডেল নিয়ে এই কোর্সটি সাজানো হবে। কী–কী কারণে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয় এবং কীভাবে এই ঝগড়া প্রশমিত করা যায় সেটা সেশনালসহ পড়ানো উচিত।
ঝগড়া ২০১: বিবাহিত জীবনের তিন থেকে দশ বছর। এই সময়টায় বেশির ভাগ মানুষ বাবা–মা হয়। সে সময় সন্তানের বড় হওয়া এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুঁটিনাটি ঝগড়া হওয়ার সময়ে কী করা উচিত সেটাই এই কোর্সের উদ্দেশ্য।
ঝগড়া ৩০১: বিবাহিত জীবনের দশ থেকে বিশ বছর। মিডলাইফ ক্রাইসিসের এই সময় ঝগড়ার কারণ ভিন্ন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কী করণীয় তাই হচ্ছে এই কোর্সের মূল উপজীব্য। পূর্বশর্ত: ঝগড়া ২০১ অথবা কম পক্ষে পাঁচ বছর বিবাহিত থাকার অভিজ্ঞতা।
ঝগড়া ৪০১: বিবাহিত জীবনের ২০ থেকে ৪০ বছর। এই অংশে কী পড়ানো হবে তা লেখকের জানা নেই। তবে এই কোর্স থাকা দরকার। পূর্বশর্ত: পনেরো বছরের বিবাহিত থাকার অভিজ্ঞতা অথবা কোর্স ৩০১।
গ্র্যাজুয়েট লেভেল কোর্স ঝগড়া ৫০১: শুধু মাত্র যারা মনে করেন তাদের বিবাহিত জীবন চল্লিশ বছরের বেশি দীর্ঘায়িত হবে তারা এই কোর্স নিতে পারেন।
ঝগড়া ১০১ পরীক্ষার প্রশ্ন হিসেবে নিম্নলিখিত নিরীক্ষামূলক কথোপকথন দেওয়া হলো:
আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে সত্য উত্তর দেবে?
কি কথা।
আগে বল, সত্যিটা বলবে কি না।
কি জিজ্ঞাসা করবে সেটা সাপেক্ষে জানাব সত্যি বলব কি না?
হুম।
হুম মানে কি?
কিছু না। থাক, আমি আর জিজ্ঞাসা করব না।
কেন জিজ্ঞাসা করবে না?
আমার ইচ্ছে?
ঠিক আছে।
ঠিক থাকবে কেন?
বাহ রে, তুমিই তো বললে ইচ্ছে করছে না।
আমার ইচ্ছে করছে না বলে তোমার ইচ্ছে করবে না কেন শুনতে?
আচ্ছা ঠিক আছে, আমাকে বল। আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।
এই তো মিথ্যা বললে।
না মোটেও না। আসলেই শুনতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তোমাকে জোর করতে চাচ্ছিলাম না।
ঠিক আছে, বলছি।
বলো।
এভাবে বলো বললে কেন?
কীভাবে বললাম।
কেমন যেন আগ্রহহীনভাবে।
তাই বললাম বুঝি?
হ্যাঁ তাই তো।
তোমার বোঝার ভুল।
মোটেও না।
ধ্যাত, শুধু শুধু কথা-কাটাকাটি করো না তো।
ঠিক আছে, চুপ করলাম।
আরে আমি তাই বললাম নাকি?
(চারদিক নিশ্চুপ)
কি ব্যাপার কথা বলছ না কেন?
যাই, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
আরে বাবা, তোমার কথাটাই তো বললে না।
মুড নেই, পরে বলব।
রাগ করছ কেন কারণ ছাড়া।
ফাইন।
মানে কি?
মানে তোমার মাথা আর মুণ্ডু।
ধ্যাত তেরি ছাই।
(অতপর পিনপতনের নীরবতা)
প্রশ্ন: এমতাবস্থায় কী করা যায় তা নিজের কল্পনা শক্তি থেকে বের কর।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: কী–কী ধরনের কথায় এবং কাজে ঝগড়ার উৎপত্তি হতে পারে তা লিপিবদ্ধ কর। পরীক্ষার খাতার পৃষ্ঠা সংখ্যা সীমিত হওয়ার তালিকা বেশি দীর্ঘায়িত করা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেওয়া যাচ্ছে।
কোর্স ২০১–এর পরীক্ষার প্রশ্ন বিবাহিত জীবনের পাঁচ বছরের মাথায় ঝগড়া হওয়ার জন্য এত সময় লাগে না। দুই তিন লাইনের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। তাদের জন্য ঝগড়ার ‘এলগরদিম’ লেখা হলো:
আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে সত্য উত্তর দেবে?
কি কথা?
আগে বল, সত্যিটা বলবে কি না।
আমি কি মিথ্যা কথা বলি?
অবশ্যই বল। আমি অনেক উদাহরণ দিতে পারব।
তুমিও বল। আমার তো ধারণা তুমি কখনো সত্যিই বল না।
কি? কি বললে। এইরকম কথা তুমি বলতে পারলে?
যা সত্যি তাই বললাম। তুমি কষ্ট পেলে আমার কিছু করার নেই।
আমি মিথ্যা বললে, তোমার চৌদ্দগুষ্টির সবাই মিথ্যা বলে।
বাবা-মা নিয়ে কথা বলবে না।
না বলব না। তারা তো সাধু সন্ন্যাসী।
ধ্যাত, তুমি একটা প্রচণ্ড ঝগড়াটে মানুষ।
আহা, আর তুমি তো শান্তির পায়রা। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসাটাই ভুল হয়েছে।
যাও না, যেখানে ভালো লাগে সেখানে যাও।
তুমি না একটা খুব খারাপ মানুষ। তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে আমার জীবনটা একেবারে তেজপাতা হয়ে গেল।
আহা আমার জীবন তো একেবারে ফুলশয্যা হয়ে গেছে। যত সব।
(টু বি কন্টিনিউড)
প্রশ্ন: এমতাবস্থায় কী করতে হবে তা নিজের কল্পনা শক্তি থেকে লেখ।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: বাচ্চাকে বড় করার ব্যাপারে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর তর্ক-বিতর্ক সম্পর্কে একটি রচনা লেখ।
কোর্স ৩০১–এর প্রশ্ন
আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে সত্য উত্তর দেবে?
তুমি আমাকে সন্দেহ করছ?
সন্দেহর কথা উঠল কেন? চোরের মন পুলিশ পুলিশ।
তোমাকে আমি চিনি না! গত পনেরো বছরে তোমার নাড়ি নক্ষত্র আমার চেনা হয়ে গেছে।
হালুম।
হালুম।
ইত্যাদি।
ইত্যাদি।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত


প্রশ্ন: এমতাবস্থায় কী করতে হবে তা নিজের কল্পনা শক্তি থেকে লেখ। লিখতে না পারলে সমস্যা নেই। বসে বসে চিন্তা কর।
কোর্স ৪০১ ও কোর্স ৫০১–এর প্রশ্নপত্র এখনো তৈরি হয়নি। তাই দেওয়া গেল না।
ঝগড়া কী কেবলই খারাপ? একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। এক দম্পতির গল্প। স্বামী ৩০ মাইলের রাস্তায় ৪৫ মাইলে গাড়ি চালিয়ে পুলিশের কাছে ধরা খেয়েছেন। পুলিশ তাকে টিকিট দেওয়ার জন্য এসে দেখে স্ত্রী সমানে স্বামীকে ঝেড়ে যাচ্ছেন কেন এই ধরনের ড্রাইভিং করলেন। পুরুষ পুলিশ স্বামীর প্রতি বেদনা বোধ করে টিকিট না দিয়ে তাদের ছেড়ে দিল। তাই ঝগড়াকে সামান্য ভাববেন না। এর অনেক ভালো দিক আছে।
শেষ কথা ঝগড়াঝাঁটি শব্দটার মধ্যে ঝাঁটি শব্দটির অর্থ কী? কেউ জানলে একটু জানাবেন। অনুমান করে মনে হচ্ছে অতীতকালে ঝগড়ার শেষে ঝাঁটা দিয়ে পিটানো হতো বলে ঝাঁটি শব্দটি যোগ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।