জয়-পরাজয় ও জীবনের গল্প

ক্যাম্পাস জীবনে খুব নিষ্ঠুর মনে হতো মরহুম খেতাবটি। কোনো কারণে কেউ ফেল করল, ব্যস বছর তো একটা নষ্ট হলোই, উপরি হিসেবে পাওয়া যাবে মরহুম খেতাব। সবার মুখে মুখে শুনে ক্যানটিনের নতুন ছেলেটাও ভাববে এটাই নাম। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে বলবে মরহুম মিজান স্যার আপনারও কি রং চা? কী নিষ্ঠুর, কী নির্মম।
আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পিএল-এর মাঝামাঝি। গভীর রাত হলেও হলের সিংহভাগ ছাত্রই পড়াশোনায় ব্যস্ত। মান্নান ভাইয়ের দোকান থেকে চা-কেক খেয়ে রুমে ফেরার পথে টিটি রুমে উঁকি দিলাম। দেখি এক মরহুম বড় ভাই একা একাই বল পেটাচ্ছেন। আমাকে দেখেই বললেন, আসো আসো টিটু, বেস্ট অব থ্রি একটা ম্যাচ হয়ে যাক। খেলা শুরু করি। প্রথম গেমটা জিতে যাই। দ্বিতীয় গেমে দুজনই খুব সিরিয়াসলি খেলছি। এমন সময় হইহই করে আরও কিছু বড় ভাই টিটি রুমে আসেন।
কিরে তুই এত রাতে টিটি খেলস। তুই তো নিশ্চিত ফেল করবি। শুরু হয়ে যায় বড় ভাইকে উদ্দেশ্য করে তার বন্ধুদের টিটকারি। বড় ভাই কিছু বলেন না। চুপচাপ খেলতে থাকেন।
ক্লাস টেস্টে পঁচিশে পাইছস পাঁচ। বিপাশার নাটক মিস করস না। আবার এখন টিটি খেলতাছস। তোরে তো ক্রেন দিয়াও পাস করানো যাইব না। আর এক ভাই ফোড়ন কাটেন।
জানি, জানি। আমি একবার ফেল করছি আমার সবকিছুতেই দোষ। আমি টিটি খেললে দোষ, টিভি দেখলে দোষ, এক বছরে একটা সিনেমা দেখলে সেইটাও মহা দোষের। স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে বড়ভাই রাগে ফেটে পড়েন।
চ্যাতস ক্যান। আমরা তো তোর ভালোর জন্যই বলি।
রাখ, রাখ। দুর্বলের ভালো সে ছাড়া সবাই বেশি বোঝে। এই যে অমুক। তোরাই ক, ও কিনা করে? টিভি দেখে, টিটি ক্যারম নিয়া পইড়া থাকে, সিনেমা একটাও মিস করে না, তার ওপর সারা রাত লিপ্পু (তাস) খেলে। কিন্তু তারপরও তার কোনো দোষই দোষ নাই। কারণ সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।
এটাই তো আসলে জগতের গল্প। আকাশে ওড়ার কারিগর হিসেবে সবাই রাইট ভাইদের নাম জানে। কিন্তু ইসমাইল ইবনে হাম্মাদের নাম কয়জনে জানে। তারও তো ছিল আকাশে ওড়ার স্বপ্ন। নিজের হাতের সঙ্গে কাঠের পাখা তৈরি করে সেও তো উড়তে চেয়েছিল। হোক না তার করুন মৃত্যু। তার স্বপ্নের যে মৃত্যু হয় নাই সে তো আমরা এখন সবাই জানি। পৃথিবী এমনই। পরীক্ষায় ভালো করেননি, ভালো চাকরি করেন না, অনেক টাকা আয় করেন না …আপনার গল্প কে শুনতে চায়?
কিন্তু তারপরও গল্প তৈরি হয় …।

সদ্য এলপিআরে যাওয়া বয়স্ক বাবা, ছোট ছোট ভাইবোন, ডায়াবেটিস রোগী মা, একটা চাকরি জোটাতে না পারলে সব ভেসে যাবে…যেতে পারে…। বিশতম ইন্টারভিউতে যায় যুবক এবং জগতের নিয়মে আবারও প্রত্যাখ্যাত হয়। কিছু হলো? পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী এই প্রশ্নটা এড়াতে অর্থহীন জীবনের অর্থহীন সময় হেলাভরে এখানে সেখানে বিলিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফেরে যুবক। ফিরেই চমকে ওঠে। খাবার টেবিলে মা-বাবা দুজনই বসা।
আজকে তোর বাবা বাজার থেকে এক জোড়া বড় ইলিশ এনেছে। সরষে ইলিশ করেছি। হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি আয়। মা খুশি খুশি ভাবে বলেন।
বুঝলি এত সস্তায় এত বড় ইলিশ অনেক দিন দেখিনি। আর তোর মার রান্নাও যা হয়েছে। দেখি আমাকেও একটা প্লেট দাও তো। টেবিলে বসতেই বাবাও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলেন।
লেখালেখি কি একদম বন্ধ করে দিলি? খেতে খেতেই বাবা হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন। যুবক কিছু বলে না। মাথা নিচু করে থাকে।
আমাদের বড় সাহেবের মেয়ে তোদের কলেজে পড়ত। তোদের কলেজ ম্যাগাজিনে তোর একটা লেখা নিয়ে স্যার কী যে প্রশংসা করল। সংসারের চাপে তোদের ঠিকমতো যত্ন নিতে পারলাম না। না হলে…। কথা শেষ করেন না বাবা। যুবকের মাথা আরও একটু নিচু হয়ে যায়।
এসব ঘোরাঘুরির চাকরি আমার একদম অপছন্দ। আমরা তো পানিতে পড়ি নাই। ভালো একটা কিছু হবেই। মা যেন নিজের মনেই কথা বলেন। যুবকের চিবুক আরও নত হয়…এতোটাই যে, চোখের জলের ফোটাগুলো দেখা যায় না।
অতঃপর এভাবেই পরাজয়ের গল্পের মাঝে জীবনের গল্প তৈরি হয়। ভিন্নরূপে ভিন্ন ভাবে যে গল্প আসলে আমারই গল্প, হয়তো আপনারও কিংবা মনুষ্যত্বের গল্প।
I decline to accept the end of man...I refuse to accept this. I believe that man will not merely endure: he will prevail. He is immortal, not because he alone among the creatures has an inexhaustible voice, but because he has a soul, a spirit capable of compassion and sacrifice and endurance. —William Faulkner