জ্যোৎস্না সমুদ্র

নদী ভাঙনে আমাদের আগের বাড়ি ও জমিজমা সব প্রমত্তা পদ্মা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। পরে নদীতে চর জেগে ওঠে। প্রতিবছরই একটা নির্দিষ্ট সময় চর জেগে উঠত। আমাদের আত্মীয়স্বজনেরা সেখানে অস্থায়ী ঘরবাড়ি করে চরের জেগে ওঠা জমিতে চাষাবাদ করতেন। আমি যখন খুবই ছোট তখন আমাদের সকল কিছু পদ্মা নদী গ্রাস করে নিয়েছিল। একটু বড় হওয়ার পর যখন সেখানে চাষাবাদের জন্য লোক যেত আমি বায়না ধরতাম তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু প্রতিবারই বাড়ির সবাই একবাক্যে না করে দিতেন।
একবার কুদ্দুস কাকু গরুগুলো নিয়ে নদীর চরে যাবেন। তখন আমি তার সঙ্গে চরে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলাম। সেদিন আমি কোনো কিছুই শুনতে রাজি ছিলাম না। ভীষণ কান্না জুড়ে দিলাম। অবশেষে মা রাজি হলেন আমাকে একা ছাড়তে। কিন্তু কুদ্দুস কাকুকে বারবার করে সাবধান করে দিলেন আমাকে যেন চোখের আড়াল না করেন।
কুদ্দুস কাকুর পেছনে পেছনে গরু খেদিয়ে নিয়ে গেলাম সারা রাস্তা। কিন্তু মুশকিল হলো নদীর পাড়ে এসে। নদী শুকিয়ে গেলেও খালের মতো কিছু কিছু জায়গায় পানি থাকে। সেগুলো বাঁচিয়ে যেতে গেলে অনেক দুর ঘুরে যেতে হবে আর দেরিও হয়ে যাবে অনেক। তাই গরুগুলোকে সরাসরি সেই পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। গরুগুলো সাঁতরে অন্য পারে চলে যায় আর পেছনে পেছনে মানুষগুলোও সাঁতার কেটে পার হয়ে যান। কুদ্দুস কাকু সাঁতার জানেন। কিন্তু মুশকিলে পড়লেন আমাকে নিয়ে। তিনি আমাকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিলেন। পানিতে নামার আগ মুহূর্তে একটা গরুর লেজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, অবস্থা যাই হোক তুমি লেজ ছাড়বা না। আমি অনেক শক্ত করে লেজ ধরে রাখলাম। গরুটা সাঁতরে নদী পার হয়ে অন্য পাড়ে গেল আর সেই সঙ্গে আমাকেও নিয়ে গেল অপর পাড়ে। এইভাবে নদী পার হওয়া যায় সেটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম বিস্ময়। সাঁতার না জেনেও অবলীলায় নদী পার হয়ে গেলাম কোনো প্রকার পরিশ্রম ছাড়াই।
কিন্তু আমার জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময় তখনো অপেক্ষা করছিল। নদীর চরে সারা দিন তেমন কোনো কাজ ছিল না। কুদ্দুস কাকুর সঙ্গে ঘুরেফিরে বেড়ালাম। নতুন ধান উঠেছে সেগুলো খেত থেকে এনে গরু দিয়ে মাড়াই করে, পরিষ্কার করে বস্তায় ভরা হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। কারণ নদীর পানি বাড়তির দিকে। আবার গত কদিন ধরে পশ্চিমের মেঘ ডেকে চলেছে। পশ্চিমের মেঘ ডাকলে নাকি নদীর পানি দ্রুত বেড়ে যায়। আবার বেশ কদিন ধরে আকাশটাও মেঘলা হয়ে আছে, কখন জানি ঢল নামবে। তাই পাকা, আধপাকা সব ধান কেটে মাড়াইয়ের জন্য খোলায় এনে ফেলা হচ্ছে।

সারা দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। কারণ খুব ভোরে উঠে আবার সবাইকে কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু খাবার পর কুদ্দুস কাকু আমাকে নিয়ে বের হয়ে খোলার ওপরে নিয়ে আসলেন। পূর্ণিমা রাত হওয়াতে আর কেউ কিছু বললেন না। আমি আসলে বুঝতেই পারছিলাম না, সন্ধ্যা হয়ে রাত হয়ে গেছে। চরের এই সব অস্থায়ী বাড়িতে তেমন একটা গাছপালা লাগানো হয় না। কারণ কয়েক মাসের ব্যবধানে আবার এই বাড়ি ভাংতে হবে। তবে অনেকেই বাড়ির কোনা–কানচিতে ভেলনার বীজ ফেলে দিতেন। ভেলনার যেহেতু কোনো যত্ন লাগে না তাই ভেলনায় এই কয় মাসের জন্য সবচেয়ে উপযোগী গাছ। গাছের ছায়াগুলো সাধারণত রাতের বেলায় বেশ অন্ধকার থাকে। তাই সেটা দেখতে না পেয়ে আমি কুদ্দুস কাকুকে বললাম, আমার কাছে তো মনে হচ্ছে এখনো দিন।
তিনি বললেন, তুমি এখনো আসল জিনসটাই দেখ নাই। সেটা দেখলে তুমি সারা জীবন মনে রাখবা। আমি আসলে তার কাছ থেকেই জীবনের সকল কিছুর প্রথম পাঠ নিয়েছি। খেতের মধ্যে গামছা বিছিয়ে তাস খেলা। মাটি দিয়ে হাউই বানানো। প্রথমে এঁটেল মাটি দিয়ে একটা লম্বা ডিমের মতো আকার বানানো হতো। তারপর সেটার গায়ে ঝাটার খিল দিয়ে ছোট ছোট ছিদ্র করা হতো। আর একদিকে একটু খোলা রাখা হতো। তারপর সেটাকে রোদে শুকিয়ে মাটির চুলার ছাইয়ের আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করা হতো। এরপর কোনো একদিন সন্ধ্যার পর আমাদের নিয়ে তিনি বাড়ির বাইরে ধান মাড়াইয়ের খোলায় হাজির হতেন। তার এক হাতে হাউই অন্য হাতে একটা পাত্রে চুলার আগুনের ছাই। তিনি খুব সাবধানে আগুনটা হাউইয়ের খোলা মুখ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করিয়ে কাচা মাটি দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিতেন। এরপর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটাকে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতেন। তখনই আমরা সবাই অবাক হয়ে আসল জাদুটা দেখতাম। হাউইটা বাতাসের মধ্যে উঠে যায় আর তার গায়ের ছিদ্র দিয়ে আগুনের ফুলকিগুলো বেড়িয়ে দ্রুতই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আবার নিচে নামার সময়েও একই ঘটনা ঘটে। দেখে মনে হয় যেন একপাল জোনাকি পোকা বাতাসের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। তখন আমাদের এলাকায় ইলেকট্রিসিটি না থাকাতে সভ্যতার অগ্রযাত্রার তেমন কোনো খবরই আমরা রাখতাম না। সুবিধাভোগতো অনেক দূরের ব্যাপার। তাই এই সহজ সরল মজাগুলোই অনেক বেশি আনন্দ দিত।
আসল কথায় ফিরে আসি। কুদ্দুস কাকু যখন বললেন তোমাকে এইবার আসল মজাটা দেখাব। শুনে আমি খুবই উৎসাহী হলাম। তিনি আমার সামনে এসে বসে বললেন, আমার কাঁধে চড়ে বস। আমি তার কাঁধে চড়ে খুব শক্ত করে ওনার চুলগুলো ধরে রাখলাম। তিনি আমাকে বললেন সামনে দেখ। আমি বিস্ফোরিত দৃষ্টি দিয়ে সামনে দেখতে লাগলাম। অবারিত কাশবন ফুলে ফুলে ভরে গেছে। আর তার ওপর জ্যোৎস্না পড়ে এক অতি প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা করেছে। অন্য জায়গার তুলনায় কাশফুলের জায়গাগুলোকে অনেক বেশি আলোকিত মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছে যেন এটা একটা ফেনিল নদী। আর যেই একটু হাওয়া লাগছিল তার মধ্যে ঢেউ খেলা করছিল। এ যেন ফেনিল একটা নদীতে বাতাসের বেগে ঢেউয়ের সৃষ্টি। আমি তখন পর্যন্ত সমুদ্র দেখি নাই তাই সবকিছুকে নদীর সঙ্গে তুলনা করছিলাম। কিন্তু সেটার বিশালতা ছিল আসলে সমুদ্রের মতো। তাই সেটাকে জ্যোৎস্না নদী না বলে জ্যোৎস্না সমুদ্র বলাই শ্রেয়।

এরপর থেকেই জ্যোৎস্না রাত এলে আমার ভালো ঘুম হয় না। এমনকি এখন পর্যন্ত জ্যোৎস্না রাতে এমনিতেই ঘুম ভেঙে যায়। জানালার পর্দার ফাঁক গলে জ্যোৎস্নার ফালি ঘরে ঢুকে পড়ে। তার তীব্রতার মাত্রা দেখে বোঝার চেষ্টা করি আজ পূর্ণিমা কিনা। দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ একা বসে থাকি। তখন মনের কোণে কুদ্দুস কাকার সঙ্গে দেখা সেই প্রথম জ্যোৎস্না সমুদ্র থেকে হাউই ছোড়াসহ কত ঘটনা ভিড় করে। জ্যোৎস্না সমুদ্র দেখার অনেক পরে এসে একজন লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার লেখার মাধ্যমে। যার সৃষ্ট চরিত্ররাও জ্যোৎস্নাকে অনেক ভালোবাসে এবং উপভোগ করে। কিছুদিন আগে সেই প্রিয় লেখকের জন্মদিন ছিল তাই ভাবলাম ফেসবুকের কভারে ওনার একটা ছবি দিই। কিন্তু সেটা শুধু ছবি থাকবে না সঙ্গে আরও কিছু। খুঁজতে খুঁজতে নিচের ছবিটা পেয়ে গেলাম আর বিলম্ব না করে কভারে জুড়ে দিলাম। আর আধো একবার চোখের সামনে কুদ্দুস কাকু, হাউই, জ্যোৎস্না সমুদ্র দেখতে পেলাম। ভালো থাকবেন হে স্বপ্নের পূজারি। আপনার মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পেরেছি দৈনন্দিন জীবনেই ভালো থাকার জন্য রয়েছে কত উপাদান।
মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।