জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে

কিংস কাউন্টি ন্যাশনাল ফরেস্ট
ছবি: সংগৃহীত

ঝোঁকের মাথায় ৭ দিন ছুটি নিয়ে নিল ফারিহা। সবাই ক্যাম্পিংয়ে যায়। সে–ও যাবে। ফারিহা কাজ করে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে একটা অফিসে। কলিগরা প্রায়ই এদিক–ওদিক বেড়াতে যায়। গত কয়েকটা দিন সবার সাথে কথা বলে প্রস্তুতি নিয়েছে ও। ওয়ালমার্ট বলে একটা দোকানে গিয়ে হারিকেন, তাঁবু, ইনসেক্ট রিপেলেন্টসহ সবকিছু নিয়েছে ও। কলিগ রায়ান শুধু মৃদু আপত্তি করেছিল ‘একা একা এতদূর গিয়ে থাকবে ফারিহা? তুমি একটু নরম মনের মেয়ে, যদি ভয় পাও?’ ফারিহা হেসে উড়িয়েছে সব কথা। সে সেকোয়া ন্যাশনাল পার্ক দেখবে আর কিংস কাউন্টি ন্যাশনাল পার্কে ক্যাম্পিং করবে।

লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে মোটামুটি ৬ ঘণ্টার ড্রাইভ। খুব ভোরে রওনা হয়ে গেল সে। পাহাড় আর সমুদ্রের পাশঘেঁষে ফ্রিওয়ে। নাম অজানা কত বুনো ফুল ফুটে আছে। মাঝে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। গাড়িতে সারাউন্ড সিস্টেমে গান বেজে চলেছে ‘বল না কেন তুমি বহুদূর, কেন আমি একা, হৃদয়ে ভাঙচুর...দেয়ালে দেয়ালে, খেয়ালে খেয়ালে, ফিরে তুমি আর আসবে না বুঝি’ কেন যেন ফারিহার মনে হলো পাশে খুব প্রিয় কেউ বসে থাকলে মনে হয় খুব ভালো লাগত।

লাঞ্চে পৌঁছে গেল ও সেকোয়া ন্যাশনাল পার্কে। ক্রিস্টাল কেভ বলে গুহা দেখবে ও। আগেই টিকিট করা ছিল। লিফটে বহু তলা নেমে গাইডের সঙ্গে গুহায় ঢুকল ৮ জনের ট্যুরিস্ট দলটি। ফারিহার প্রথমে একটু ভয় লাগলেও পরে সবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে প্রাকৃতিক কৃস্টাল দেখতে মন্দ লাগল না। একটা সেকশনে এসে হঠাৎ ওরা সব বাতি নিভিয়ে দিল পুরো ঘুটঘুটে আঁধারের রূপ দেখতে। ট্যুর শেষ করে ওপরে এসে ফারিহা বিশাল ওক বনের মাঝে ড্রাইভ করে ওর লজ খুঁজে নিল। বিকেলটা কাটাল হাইকিং করে, একটু বিশ্রাম নিল ঝরনার পাশে। হালকা মিস্ট ছুঁয়ে গেল ওকে, লজে এসে দেখল টিভি নেই, ইন্টারনেট নেই। কিছু অজানা বনের শব্দে ঘুমিয়ে গেল ও।

পরদিন কিংস কাউন্টি ন্যাশনাল পার্কে ড্রাইভ করে যাবে ও। গাড়ির তেল নিতে গহিন বনে যেতে হলো। এখনো এখানে মানুষ সাহায্য করে তেল নিতে, শহুরে ব্যস্ততায় সবকিছু অটো হয়ে যায়নি। বিশাল লাল ওক বনের মাঝে সুনসান নীরবতা। গাড়ি চালিয়ে দেড় ঘণ্টায় ক্যাম্প গ্রাউন্ডে পৌঁছাল ও। নদীর পাশে ও জায়গা বেছে নিয়েছিল অনলাইনে। তাঁবু খাটাতে খুব বেশি কষ্ট হলো না ওর। খাবারগুলো লক করে রাখতে বলে গেল লোকাল রেনজার। নয়তো ভালুক আক্রমণ করতে পারে। নিজের শুকনা খাবার লক করে এসে নদীর পাড়ে ছিপ নিয়ে বসল ফারিহা, মাছ ধরে বারবিকিউ করবে। লক্ষ করল ছোট বাচ্চাসহ ৫ জনের একটা পরিবার তাঁবু খাটিয়েছে ওর পেছনেই। হাসিখুশি পরিবারটিও মাছ ধরছে। হাসি হাসি মুখে হাত নাড়ল। ওরা বেশ কয়েকটা মাছ ধরে ফেলল এর মাঝে। ফারিহা একটাও পেল না। বড়শি গুটিয়ে উঠে যাবে এমন সময় ১০ বছরের বাচ্চা ছেলেটি দৌড়ে এসে একটা মাছ দিয়ে গেল ওকে। বলল মা বলেছে এত মাছ তো খেতে পারব না আমরা, এটা উঠেছে তুমি খাবে বলে। একটু হেসে ফারিহা মাছ পরিষ্কার করে বারবিকিউ করল। কিছু বাদাম আর চিপস নিয়ে পাশের তাঁবুতে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এল।

সেকোয়া ন্যাশনাল পার্কে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

রাতে তাঁবুতে শুয়ে দেখল উথালপাতাল জোছনা। গান শুনল উদাস মনে, এত একা লাগছে কেন ওর? একটু কাঁদল গানটা শুনে ‘আমি তোমাকেই বলে দেব, কী যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে, আমি তোমাকেই বলে দেব সেই ভুলে ভরা গল্প, কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়, ছুঁয়ে কান্নার রং, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া’।

পরদিন হালকা কিছু খেয়ে বের হলো দেখতে ওক বন, বিশাল গুঁড়ির মাঝে গাড়ি চলে যায়, মানুষ হাঁটে। নদীটা এত খরস্রোতা। সারা দিন পর বিকেলে ফিরল তাঁবুতে ফারিহা। আজকেও মাছ পেল উপহার ওই হৃদয়বান পরিবার থেকে। হালকা গল্প হলো। ওরা নাকি প্রতিবছর আসে এখানে। ক্যাম্পিং করতে এসেই পরিচয় দুজনের। তারপর থেকে ১৫ বছর একসঙ্গে। শারমিন ওক বনে প্রোপোজ করেছিল স্বামী ও বউকে।

কফি হাতে সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে বসে রইল অনেকক্ষণ ফারিহা। উথালপাতাল জোছনা দেখল, নদীর রং পরিবর্তন দেখল, তারপর তাঁবুতে ফিরে এল। স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে ঘুমাতে চেষ্টা করল অনেকক্ষণ। কেন যেন একটু একটু গা ছমছম করছে আজকে ওর।

একটু চোখ লেগে আসতেই মনে হলো খুব কাছে ভালুকের বিকট গর্জন, বাচ্চার চিৎকার আর গুলির শব্দ। পেছনের তাঁবুতে অনেক মানুষের ছায়া। প্রচণ্ড ভয় পেল ফারিহা। যেন অনন্তকাল পরে শুনল ওর তাঁবুর বাইরে ওর নাম ধরে কেউ ডাকছে। বুঝল প্রচণ্ড ভয়ে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ওর। তবু তাঁবু থেকে বের হলো ও। দেখল রায়ান দাঁড়িয়ে আছে। কোনো পূর্ণিমা রাত এত সুন্দর লাগেনি ওর। রায়ানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফারিহা। কাঁপুনি থামতে বলল, ‘রায়ান, তুমি এখানে? কীভাবে? আমাকে পাশের তাঁবুতে নিয়ে চল, ওরা ঠিক আছে?’ রায়ান হাত ধরে বসাল ওকে। বলল, কয়েক দিন ধরে ফারিহার আশপাশেই আছে ও। যদি ওর কিছু লাগে। আজকে বোধ হয় পিছের তাঁবুর বাচ্চাটা সব খাবার লক করে আসেনি। ভালুকের হেঁটে যেতে দেখে রায়ান পিছু নিয়েছিল। ওই তাঁবুতে ঢুকবে জেনে লাঠি ছুড়ে মেরেছে, চিৎকার করেছে, বাচ্চার বাবা ভালো শিকারি, সময়মতো গুলি করাতে ভালুক কারও কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।
তারপর রায়ান বলল, ফারিহাকে সে ভালোবাসে। কোনো কিছুর আশায় না। ফারিহা শুনল। তারপর সারা রাত রায়ানের কাঁধে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করল। সকালে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আগে বলে গেল, ছোট্ট একটা জীবন রায়ানের সঙ্গেই সে কাটাবে। রায়ানের ভালোবাসায় আর্দ্র চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল ও।

জোছনাপাগল প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ, শুভ জন্মদিন গেল গতকাল শুক্রবার। সব সময় আপনার লেখার অপেক্ষায় থাকি। মৃত্যু আপনাকে কেড়ে নিতে পারেনি।