সকাল ঠিক সাড়ে সাতটা, ট্রেনের হুইসিল বেজে উঠেছে, ধীরগতিতে চাকাগুলোও ঘুরতে শুরু করেছে। কিন্তু ঠিক তখনই প্রচণ্ড গতিতে দুটো মোটরসাইকেল একেবারে প্রথম প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল। প্রথমটায় একটা ছেলে ও একটা মেয়ে। দ্বিতীয়টায় দুই হাতের মাঝখানে একটা বড় আকারের ভ্রমণব্যাগ নিয়ে একটা ছেলে। ততক্ষণে ট্রেন গতি বাড়াতে শুরু করেছে, প্রথম সাইকেলের ছেলেটা কোনো রকম মোটরসাইকেল বন্ধ করে নেমেই লাফ দিয়ে ট্রেনের কামরায় উঠে গেল যে দরজাটায় টিটি বা ট্রেন কর্তৃপক্ষের কেউ ফ্ল্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন সেটাতে। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করে উঠল! কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে চেইন টানল, ট্রেন থামল। উৎসুক যাত্রীদের মধ্যে খানিক কৌতূহল, কী হলো, ছাড়তে ছাড়তে কেন ট্রেন চলা বন্ধ! মাথা বাড়িয়ে সবাই দেখল ২০-২২ বয়সের দুটো ছেলে একটা মেয়েকে ট্রেনে উঠিয়ে দিচ্ছে এবং তিনজনের মুখেই এক বিজয়ের হাসি, যেন রাজ্যজয় হলো। না, এটা কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়। কেউ কাউকে নিয়ে পালিয়েও যাচ্ছে না, এটা বাস্তব জীবনেরই সাধারণ এক দৃশ্য।
‘পাতা হ্যায়, লাইফমে মেরা একভি ট্রেন নেহি ছুটা, থ্যাংকস বাবাজি আপনে মেরা মান রাখলিয়া’ যার মানে হলো, ‘জানো, জীবনে আমার একটাও ট্রেন মিস হয়নি, ধন্যবাদ ওপরওয়ালাকে, আমার ইজ্জত রেখেছেন।’ দৌড়াতে দৌড়াতে একটা মেয়ে ট্রেনে উঠে গেছে, তাকে ট্রেনেরই এক যাত্রী সাহায্য করছে, মেয়েটা উঠেই হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলছিল। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। এটা হিন্দি যব উই মেট সিনেমার গীত নামের এক তরুণীর (কারিনা কাপুর) ডায়ালগ, যা অনেকখানি মিলে যায় ওই মেয়েটার সঙ্গে। দ্বিতীয় ডায়ালগ, তুমি ভাবতে পার, ‘ট্রেনই আমার দ্বিতীয় বাড়ি।’ এটা শুধু ওই মেয়েটা নয়, মফস্বল শহর থেকে বড় বড় শহরে পড়তে যাওয়া প্রতিটা তরুণ-তরুণীর গল্প। বাস, ট্রেন, লঞ্চ তাদের দ্বিতীয় বাড়ি। চলতে চলতে অচেনা যাত্রী, চাঞ্চল্যকর ঘটনা—সবকিছুর নীরব সাক্ষী হয়ে ওঠে এরা। দৌড়ে ছুটন্ত ট্রেনে উঠে যেতে যে অভ্যস্ত, এটার মূল্য সে-ই বুঝবে, যাকে ঘন ঘন এমন ট্রেনের পেছনে দৌড়াতে হয়। তাদের এই ছুটে চলা শুধু বাস, ট্রেনের পেছনে নয়, এই ছুটে চলা এক স্বপ্নের পেছনে। যেখানে ওরা তখনো জানে না জীবনের শেষ ট্রেনটা ধরা কত কঠিন, যেটা তাকে পৌঁছে দেবে জীবনের সঠিক গন্তব্যে। সময় যখন আসে, ওরা পরীক্ষার ভয়ংকর স্বপ্নের মতো শুধু দুঃস্বপ্ন দেখবে। ওরা ট্রেনের পেছনে দৌড়াচ্ছে, কিন্তু ট্রেন ছুটে চলেছে, ধরতে পারছে না, ধরেও ধরা যাচ্ছে না, হঠাৎ প্রচণ্ড কষ্টে ঘুম ভেঙে যাবে!
কারও ঘর বাঁধার স্বপ্ন, ভালোবাসার মানুষটিকে চিরতরে কাছে পাওয়ার স্বপ্ন, কারও একটা ভালো চাকরি পেয়ে মা-বাবার দুঃখ ঘোচানোর স্বপ্ন, কারও-বা চাকরি হলেও বেলা বোসের মতো প্রিয় প্রেমিকা হাতছাড়া হয়ে যাবে, ব্যর্থ প্রেমিক তখন আঁধার রাতে হয় শুনবে, না হয় গিটার হাতে নিয়ে গাইবে, ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ। এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না, হ্যালো.... এটাকি ১১২২৩৯’। বেলা বোসকে কেউ ডেকে দেবে না!
হায়! মনের মানুষটাকে তার জীবনের নির্দিষ্ট স্টেশনে পাবে না, তার আগেই কোনো ছুটন্ত রেলগাড়ি পৌঁছে দেবে অন্য ঠিকানায়। শুধু ব্যতিক্রম ছোটবেলার রেলগাড়িটা, পা পিছলে আলুর দমের মতো ঝিক ঝিক আনন্দে চলে। সেখানে কেউ না কেউ হাত বাড়িয়ে দিতে আসে, হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে সঙ্গের অগ্রজ দৌড়ে আসে, এ হলো পরিবার, ভাইবোন। কখনো একই তরির বাসিন্দারা একে অপরের হাত ধরে টেনে তোলে, যেমন তুলেছিল সেদিন দুই ভাই তাদের বোনকে।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকের ওই দিনটিতে সিনেমার হিরোর মতো দুই ভাই মামুন, কামরান ছুটে চলেছিল, যেন তাদের ইউনিভার্সিটি ফেরত বোনের ট্রেনটা মিস না হয়। সকালবেলা দেরি করে উঠেই হইচই, কান্না, পরদিনই মৌখিক পরীক্ষা। ভাইয়েরা ভরসা দিয়েছে, ‘পৌঁছে দেব, তুমি কাপড় পরে তৈরি হও।’ সিলেট রেলস্টেশনে ঢোকার পথে দেয়ালের অনেকখানি ভাঙা, প্রধান গেটের ভিড় ঠেকাতে যাত্রীরা প্রায়শ সেদিকটা ব্যবহার করে করে একটা পথ বলা যায় তৈরি করে দিয়েছে। এতে রেল কর্তৃপক্ষের আইনত কোনো সমস্যা চেকিংয়ে হয় কি না, জানা নেই। সেদিন জয়ন্তিকা ট্রেন ধরার জন্য ছুটে এসেছিল তারা এই পথ দিয়েই। স্টেশনে অনেকেই হইহই করে উঠেছিল—কী ঘটতে যাচ্ছে? মেয়েটা উঠেই যে কোচ পেল সেটায় বসল। টিটি এসে বিশাল কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই হিরো উনি কে? সে হেসে বলল, ‘হিরোটা আমার ছোট ভাই।’ লোকটা বাড়তি পঞ্চাশ টাকা চাইলে বলল, ‘আমি কেন দেব? আমার চেয়ার কোচের টিকিট কাটা আছে, সেখানে পৌঁছে দেন, এই ব্যাগ নিয়ে চলন্ত ট্রেনে একা যাওয়া সম্ভব নয়।’ টিটি বুঝলেন কথা বলে লাভ নেই, তাই চলে গেলেন। সেই দিন সে-ও বলেছে, আজকে তো রেকর্ড খারাপ হয়ে যেত, যদি ট্রেন ধরতে না পারত! সেদিন সে-ও হারতে হারতে জিতে গিয়েছিল দুই সহোদরের জন্য, তারও কখনো ট্রেন মিস হয়নি। কত সমস্যায় পড়তে হতো এক ট্রেনের জন্য। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে দীর্ঘদিন পর বাড়ি এসেছিল, ফিরে যাচ্ছিল, যাই হোক শেষ রক্ষা হলো। দিনে দিনে পৌঁছাতে না পারলে রাতের বেলায় হলে প্রবেশ হয়ে উঠত দুর্বিষহ।
জীবনের একটা সময়ে কেউ না কেউ থাকে হাত ধরে ওপরে তোলার জন্য। মা-বাবা, ভাইবোন, বন্ধু। এদের অনেকে আবার থেমে যায় মাঝপথে, কেউ ঝরে পড়ে রাজীবের মতো বাসের আঘাতে, কেউ চলে যায় দুষ্ট রাজনীতির ষড়যন্ত্রে এশাদের মতো, কেউ তুলে নেয় হাতে অস্ত্র, তখন এদের থামার জন্য থাকে না কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য। কারও-বা স্বপ্ন ভাঙে কঠিন কোনো আঘাতে। তবু সবাই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এর মাঝেই কোথাও না কোথাও সাফল্যের সূর্য লুকিয়ে থাকে, কেউ না কেউ তো ঝলসে ওঠে! এ জন্য থামলে হবে না, ছুটতে হবে। বয়স যত বাড়তে থাকে, কঠিন পথগুলো সবারই একা চলতে হয়, ছুটতে হয় জীবন নামের রেলগাড়ির পেছনে। এ জন্য আমার প্রায়ই একটা কথা মনে হয়, ‘Life is a Race’। সুতরাং দৌড়াও!