জীবনের গল্প

ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী মনে হয় সহজ একটি কাজ। কার পা থেকে কার পায়ে বল গেল এবং কোথায় গিয়ে শেষ হলো—যেমন গোল, ফাউল ইত্যাদি বর্ণনা করা। জীবনের অভিজ্ঞতা ধারাবিবরণী নয়। জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা কঠিন কাজ। গল্প-উপন্যাসের চেয়েও আরও কঠিন। গল্পে অথবা উপন্যাসে লেখক ইচ্ছা করলে যখন-তখন কোনো চরিত্রকে মেরে ফেলতে পারেন। আর তারা করেনও তাই। আপনি খুবই আগ্রহ নিয়ে একটি উপন্যাস পড়বেন অথবা নাটক দেখবেন। কিন্তু লেখকের হাতে যার জন্ম ও মৃত্যু তাকে আর কতক্ষণ পাবেন! কিন্তু বাস্তব হলো দুরূহ।

মানুষের জীবন বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত। কোনো অধ্যায় হয় সুখকর আবার কোনো কোনো অধ্যায় হতে পারে অসহনীয় নিরবধি দুঃখে রচিত। রচিত বলার কারণ, নিয়তিতে আমাদের হাত নেই (হয়তো বা আছে আমি নিশ্চিত নই)। কোনো অধ্যায় আবার এই দুই সুখ-দুঃখের অনুভূতির সংমিশ্রণে অনেক সময় ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে। একজন মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো অন্যদের জন্য আনন্দ অথবা দুঃখের দৃশ্য বয়ে নিয়ে আসে। অন্যের দুঃখে আমরা দুঃখিত হই আবার অন্যের আনন্দে আমরা আনন্দিতও হই।
একমাত্র মানুষ নামক প্রাণীই অন্যের সুখ দুঃখ ভাগ বণ্টন করতে পারে। আর কোনো প্রাণী করতে পারে না। অনেক সময় জীবনের ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো চোখের সামনে বাস্তবের মতো ভেসে ওঠে। আমরা শিহরিত হই অন্যজনের অভিজ্ঞতা শুনে। আবার কখনো এ রকম মনে হয় যে, বক্তা যত তাড়াতাড়ি গল্প বলা শেষ করবেন ততই ভালো; যেন হাফ ছেড়ে বাঁচি। জীবনের গল্পগুলো যেমন হয় রোমাঞ্চকর, তেমনি হয় রোমহর্ষক। একটি মুভি দেখেছিলাম—নাম ‘১৪০৮’। ইউটিউবে আছে আপনারা চাইলে দেখতে পারেন। এই সব সিনেমা দেখতে ইংরেজি ভাষা বোঝা জরুরি নয়। ভৌতিক সিনেমা। স্টিফেন কিংস-এর ছোটগল্পের ওপর ভিত্তি করে মুভিটি তৈরি করা হয়েছে ২০০৭ সালে।
সংক্ষেপে কাহিনি হলো—মাইক এনসলিন (জন কুসাক) একজন কমেডিয়ান, সংশয়বাদী লেখক ও কল্পিত গল্পের বইয়ের সমালোচক। যিনি তার স্ত্রী কটির (জেসমিন জেসিকা অ্যান্থনি) মৃত্যুর পর তার আরেক স্ত্রী লিলির থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। মাইক অলৌকিক বইয়ের অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলোর মূল্যায়ন করেন, যাতে তার কোনো বিশ্বাস নেই, তা সমালোচনা করেন। তাঁর সর্বশেষ বই প্রকাশ হওয়ার পর তিনি নিউইয়র্ক শহরের লেক্সিংটন অ্যাভিনিউতে এক অনুষ্ঠানে আসেন। সেখানে তাঁর নামে একটি বেনামি পোস্টকার্ড আসে। যার মাধ্যমে তিনি বার্তা পান—রুম নম্বর ১৪০৮-এ প্রবেশ করবেন না। এটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি। মাইক হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে ওই রুমে থাকার অনুমতি চান। হোটেলের ম্যানেজার জেরাল্ড অলিন (স্যামুয়েল এল জ্যাকসন) মাইককে ব্যাখ্যা করেন, কেউ ১৪০৮ নম্বর রুমে এক ঘণ্টার বেশি অবস্থান করলেই শুধু তার মৃতদেহই ফিরে আসে। গত ৯৫ বছরে সর্বশেষ গণনায় ৫৬ জন মারা গেছেন। এই ঘটনা কেভিন ওমাল্লি নামে একজন ধনী ব্যবসায়ী আত্মহত্যার মাধ্যমে শুরু হয়। যিনি দিনেরবেলায় ওই রুমে আত্মহত্যা করেন। তো মাইক অনেকটা জোর করেই ওই রুম চান। এই মুভিটি দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে কেন সময় এত লম্বা। মনে হয়েছে তাড়াতাড়ি মুভিটি যেন শেষ হয়। শেষ হওয়ার আগেই সিনেমা হল থেকে বের হতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মাইকের কী হলো, কী হবে এই ভেবে বের হতেও পারিনি। ইচ্ছে করলে আমি সিনেমা হল থেকে যদিও বেরিয়ে আসতে পারতাম। তেমনি বাস্তব জীবনের দুর্বিষহ ঘটনা থেকে ইচ্ছে করলেও বের হওয়া যায় না।
জীবনের গল্পগুলো হয় কখনো হররর মুভির মতো লোমহর্ষক আবার কখনো হয় রোমাঞ্চকর। কখনো সুখকর আবার কখনো ভয়ংকর। প্রতিটি মুহূর্ত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। অনেকটা বৃষ্টির ফোটার মতো। এখন আপনি যদি এক মাইল হাঁটেন তো কতটা ফোটা পড়বে চিন্তা করুন। আর কয়েক বছর যদি হাঁটেন? তাই এখানে ধারাবিবরণীর সুযোগ নেই। জীবনের গল্পগুলো জমাট বাঁধা রক্তের মতো। জটিল এক সমীকরণের মাধ্যমে রক্ত যেমন জমাট বাঁধে, অভিজ্ঞতাগুলো তেমনি মস্তিষ্ক নামক জায়গায় জমাকৃত হতে থাকে জটিল এক সমীকরণে।

লেখক
লেখক


দেশের বাইরে আমাদের উচ্চশিক্ষার্থে পড়তে আসার অনেক কারণ থাকে। কে চায় আপন দেশ ছেড়ে বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করতে! আসলে সবাই চায়। কিন্তু আমার মতো কেন সবাই চায়? বিরহেই কি মাতৃভূমি সুন্দর নাকি কোলেতে? মাতৃভূমি কি হৃদয়ের গহিনে পোষণ করাই যথেষ্ট নাকি প্রতিদিন চোখে চোখে রাখা অধিক সুন্দর। নাকি মাতৃভূমি থাকবে স্বপ্নে আত্মার স্বজন হয়ে। অনেক অবান্তর প্রশ্ন। কিন্তু কেউ না কেউ কখনো না কখনো এই প্রশ্নগুলো করবেই। আর্থসামাজিক কারণে আমরা বাইরে যেতে চাই। করুণ দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের দাদা, পর দাদারা প্রবাসে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ২০ হাজার বছর আগে আমেরিকা আবিষ্কার করেন তা আগের একটি পর্বে লিখেছিলাম (দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে তারা ভালোই করেছেন। আমি তাদের দোষারোপ করব না)। প্রশ্ন যদি করা হয়, কেন আমাদের দেশে সবাই ডাক্তারি অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়। আমরা সবাই এর উত্তর জানি। ওই বিষয়ে পড়লে ন্যূনতম উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করার নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কতজন শিক্ষার্থী এই রিষয়ে পড়ার সুযোগ পায়!

আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা কলেজজীবন থেকেই পড়ালেখা শেষ করে করবেটা কী, এ চিন্তায় অধৈর্য হয়ে পড়ে। কীভাবে তার নিজের সংসার করবে! কীভাবে বাবা-মা, ভাইবোনদের সাহায্য করবে, যারা কিনা নিজেরা না খেয়ে না পরে তাকে পড়াশোনা করাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে ছেলেমেয়েরা যে বিষয় পড়তে আনন্দ পায় শুধু সে বিষয়েই পড়তে চায়। কারণ তাদের পড়ালেখা শেষ করে কী করবে তা নিয়ে এত ভাবতে হয় না। এখানে ১৬ বছর বয়সের পর থেকে ছেলেমেয়েরা স্বনির্ভর হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা করেন পার্টটাইম কাজ। সিভিতে যখন স্টুডেন্ট লেখা থাকে তাদের এমপ্লয়াররাও দেন স্বল্প আয়ের সুযোগ। আমাদের দেশে চাইলেই কোনো শিক্ষার্থী পার্টটাইম কাজ করতে পারবেন না (ছাত্রীদের কথা তো আর বলবই না)। আবার কোনো কাজ পেলেও আত্মসম্মানের ভয়ে অনেকেই অনেক কাজ করেন না। আমি বিদেশে না এলে এ নিয়ে আমার ধারণাই পরিবর্তিত হতো না। আমি নিজেও অনেক কাজ করতে দ্বিধা করতাম আত্মসম্মান অথবা বংশ মর্যাদার ভয়ে। কিন্তু আমরা এই প্রথা কোথায় থেকে পেলাম তা আমার জানা নেই। এ আজব আত্মসম্মান, আজব চিন্তা ছাড়া আর কী হবে! কেন এই আত্মসম্মান। কাজ তো কাজই, তা যেকোনো কাজই হোক। আমাদের দেশে যত দিন পর্যন্ত এ প্রবণতা বন্ধ না হবে তত দিন পর্যন্ত আমি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা করি না। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবেন এবং পার্ট-টাইম কাজ করবেন। এটা স্বাভাবিক ও এই চিন্তা পোষণ করা উচিত। তা শুধু টিউশনিতে সীমাবদ্ধ থাকবে কেন?
পড়াশোনার জন্য আমরা বিদেশ কেন আসি? কারণ আমরা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পারি। পড়াশোনা শেষ করে কাজ পাই এবং কাজ করতে পারি। একজন পড়তে পারে ইতিহাস অথবা সমাজ বিজ্ঞান এবং কাজ করে নিজস্ব ক্ষেত্রে যোগ্যতার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হই।
আমাদের দেশে বাস্তবতা হলো ওই দুই বিষয় (ডাক্তারি অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং) নিয়ে পড়লে আপনি নিশ্চিত কিছু করে খেতে পারবেন এবং পাবেন সামাজিক মর্যাদা। আর অন্য কোনো বিষয়ে পড়লেই নিশ্চিত হবে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এখন অবশ্য আরও কিছু বিষয়ে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। আমি ছেলেবেলা থেকে লেখক হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যেদিন জানলাম কবি সুকান্ত ক্ষুধার জ্বালায় চাঁদ খেয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন (অন্তত কবিতায়), তখন প্রচণ্ড ধাক্কা খাই। মনে মনে চিন্তা করি, বাবা আর যা হোক কবি অথবা লেখক হওয়া যাবে না। ঢাকায় থাকতে লেখালেখি যখন করতাম তখন দেখেছি কত লেখককে নিরাশায় জর্জরিত হয়ে গাঁজা সেবন করতে। আবার বিসিএস নামক যে সোনার হরিণ তাতো সকলের ভাগ্যে জোটে না। তার ওপর ৩০ বৎসর বয়সের সীমারেখার মধ্যে আবার বিসিএস পাস করতে হয়। এ ব্যাপারে সুপ্রিয় পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। এই যে ৩০ বৎসর বয়সের মধ্যে বিসিএস পাস করার নিয়ম, এটা কি বৈষম্যমূলক নয়? এ নিয়ম পরিষ্কারভাবে বয়স্কদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক। এ দেশে হলে এত দিনে হাইকোর্টে এটা চ্যালেঞ্জ করা হয়ে যেত।
যা হোক, বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্তেই অনড় থাকলাম। তো ইন্টারমিডিয়েট পাস করে তো আর অক্সফোর্ড অথবা কেমব্রিজে দরখাস্ত করা যায় না। ইংল্যান্ডের অন্যান্য চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত পাঠালাম (UCAS-এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করা যেত এবং এখনো তাই)। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ স্বরূপ আইইএলটিএস (IELTS) স্কোরটা ভালোই ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই আমাকে রিজেক্ট করল। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার দয়াবশত উপরোধ করল যে, ইউকে নেরিকের (UK NARIC) সঙ্গে যোগাযোগ করতে (যারা বিভিন্ন দেশের শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনা করে এবং কোনটা ইউকের সমমানের তা নির্ণয় করে সার্টিফিকেট দেয়)।
এই ইউকে নেরিকের কথা জেনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা আমার এসএসসি পরীক্ষা ও এইচএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট ও মার্কশিট পাঠাতে পরামর্শ দিল। ওইগুলো দেখে তারা লিখল যে বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েশন হলো ইংল্যান্ডের এ লেভেলের সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা। তাই আমার বিদেশে পড়ালেখা করার সেই যে উচ্ছ্বাস তা আরও অধিক পানিতে নিমজ্জিত হতে লাগল। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। ভর্তির চেষ্টা করলাম স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ভর্তির চেষ্টা করলাম নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইডেন। প্রায় সবগুলো প্রতিষ্ঠান আমাকে ভর্তির অফার লেটার পাঠাল। যদিও ভর্তিগুলো ছিল শর্তযুক্ত। এই শর্তগুলো ছিল আমাকে দুই বছর তাদের ভাষা শিখতে হবে। নিজের মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষাই ঠিকমতো লিখতে পারি না, ইংরেজি আমাদের দ্বিতীয় ভাষা, কিন্তু আমরা সেই ভাষাতেই ঠিকমতো কমিউনিকেট করতে পারি না। কীভাবে নতুন ভাষা শিখে সেই ভাষায় পড়াশোনা করব। পৃথিবীটা এক বিচিত্র গ্রহ। এখানে মানব সন্তানদের চেহারা হয় ভিন্ন রঙের। মানব সন্তানেরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। সিলেটে যে ভাষায় কথা বলে চট্টগ্রামে গেলে সেটা সম্পূর্ণ রূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কেন সবাইকে বিধাতা এক ভাষা অথবা একই রং দিয়ে সৃষ্টি করলেন না! চিন্তার বিষয়! (চলবে)

লেখক: ব্যারিস্টার। ইংল্যান্ডে আইন পেশায় কর্মরত।
ফেসবুক: <www.facebook.com/shahid.shotabdi>

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: