জাহাজিরা যাবে আদার খোঁজে

লকডাউন যখন একটু ঢিলেঢালা হয়েছে তখনই সশরীরে সবজি বাজারে যেতে পেরে ভালো লাগল তার। সে একজন বাজার বিলাসী ব্যক্তি। করোনার দাপটে সেই যে অনলাইনে বাজার করা শুরু হলো তাতে দোকান ঘুরে তাজা তাজা শাকসবজি দেখার ও হাতে ধরে ধরে পছন্দমতো জিনিস তুলে আনার আনন্দটাই হারিয়ে গেল যেন। এই দূর প্রবাসেও করলা, কলমিশাক, পেঁপে থেকে পেয়ারা হেন জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না। ভিয়েতনামি ও চায়নিজদের বাজারে তো বরইও পাওয়া যায়, সঙ্গে পুঁটলিতে মরিচের গুঁড়া মেশানো লবণও দেয়।

যা–ই হোক লকডাউন কমাতে দোকান বাজারে গিয়ে দেখার ও কেনার আনন্দ এখন পাওয়া যাবে অন্তত। তাজা আদা কেনা তার অভ্যাস। এ দেশে সহজলভ্য প্রিজার্ভ করা বোতলের আদা-রসুন পেস্ট দিয়ে মাছ–মাংস রান্না করা যায়, খারাপও হয় না। সময় বাঁচাতে সবাই তাই ব্যবহার করে। তবে তাজা আদার স্বাদ আলাদা, বলা যায় অনন্য।

শোনা যাচ্ছে করোনা নাকি আদা ও লেবু–চায়ে কাবু হয়। তাই চায়ে আদা–লেবু খাওয়া এখন রুচি বা পছন্দের বিষয় নয়, এটা রোগ থেকে বাঁচার এক তরিকা। এ ছাড়া সরু চাল ও মুগ বা অন্য ডাল মিশিয়ে খিচুড়িতে আদাকুচি অপরিহার্য। এতে তাজা আদাকুচি না দিলে তার স্বাদ ঠিকমতো পাওয়া যায় না। ঘি দিয়ে যে ডালের সম্ভার হবে তাতে প্রথমেই আদা ও পেঁয়াজকুচি দিয়ে চুলায় ডাল চড়াতে হবে। তাই তাজা আদা তার প্রিয় একটি জিনিস। প্রতি সপ্তাহে কেনা না হলেও মাসে একবার তাজা আদা একটুখানি কেনা চাই–ই চাই। বেশি আদা কিনে রাখা যায় না, শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে যায়। সব সময় ঘরে তাজা আদা একটু রাখেই সে, তাই ফুরিয়ে গেলেই কিনতে হয়। তার সন্তানেরা তাকে বলে, ‘তুমি বোধ হয় কোনোভাবে জেমি অলিভারের বোন হও, ওরই মতো আদা ভালোবাসো।’

জেমি অলিভার স্বনামধন্য ব্রিটিশ বাবুর্চি, সে–ও রান্নাতে আদা দিতে পছন্দ করে। তবে তো ওর রান্না ভালো হওয়ারই কথা। লকডাউন শিথিল হলে বাজারে গিয়ে সব জিনিসের দাম বাড়তিই মনে হলো তার। দিন গড়াতে আদার দাম একটু বেশিই বাড়ল। যা–ই হোক আদা তো ভাত বা রুটি নয় যে গাদা গাদা লাগবে। আদা একটু কিনে নিলে হবে। তবে আজ একটু আদা নিলে হবে না। তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী এক খালার ও এক মাসির জন্যও আদা কিনবে সে ভেবে রেখেছে।

মাসি, খালা দুজনই একাকী থাকেন। মাসির একটিই মেয়ে। সে খুব ব্যস্ত শিক্ষকতা নিয়ে। নিত্যদিন মায়ের সব প্রয়োজন মেটানো ও সব বিষয় দেখভাল করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর খালার একমাত্র সন্তান ছেলেটি সে থাকে দূরের এক শহরে পরিবার নিয়ে। সে–ও জানে না তার মায়ের কী দরকার আর কী দরকার নয়। এই দুর্দিনে সামান্য আদা যে বয়স্ক মানুষের কোনো উপকারে লাগতে পারে, তা তাদের ধারণার অতীত। তার সঙ্গে মাসি-খালার মাঝেমাঝেই দেখা হয়, গল্প হয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে তাদের কী দরকার তা জানতে চেষ্টা করে। তাদের কোনো প্রত্যাশা নেই, তবে খোঁজখবর নিলে, সামান্য কথাবার্তা বললেও দুজন নিঃসঙ্গ মানুষ খুশি হন খুব। দুজনেই এ দেশের সরকারি সংস্থার নানা লোকের সাহায্য–সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। ঘরদুয়ার পরিষ্কার করার, বাজার–সওদা এনে দেওয়ার লোক আসে কাউন্সিল থেকে। এরা আসে মেশিনের মতো কাজ করে দিয়ে চলে যায়। এদের কাজকর্ম রোবটিক, হার্দিক নয়। যে কারণে দুজন তার জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। গিয়েই সে বলে—
-মাসি সব সময় তো নিজের চা নিজেই বানিয়ে নাও, আজ আমি করছি, দেখ কেমন হয়। নতুন চা এটা। আফ্রিকান রুইবাস ভ্যানিলা টি। এটা খেলে শরীরে সুস্থির আমেজ আসে।

দুকাপ চা বানিয়ে খেতে খেতে মাসির সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করে তবেই ওঠে। কিছু লাগবে কি না, প্রতিবারই সে জানতে চায়। মাসি কিছু চায় না, শুধু বলে
-পড়ার জন্য ভালো বইটই বা জার্নাল থাকলে এনে দিয়ো।
-ঠিক আছে, অবশ্যই আনতে চেষ্টা করব।

মাসির সঙ্গে পরিচয় পাড়ার লাইব্রেরিতে আর খালার সঙ্গে পরিচয় পার্কে। খালা পাখি ও কাঠবিড়ালিদের খাবার দিতে আসেন এখানে। কখনো বই থাকে হাতে, কখনো উলকাঁটা। তাদের সন্তানেরা জীবন ও জীবিকা নিয়ে মহাব্যস্ত। সন্তানদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই, আছে শুধু ভালোবাসা ও সমবেদনা। কোভিড কোয়ারেন্টিনের সময়ে ফোনেও সে মাসি, খালার খোঁজখবর নিয়েছে। সাহস ও পরামর্শ দিয়েছে। খালাকে বলল একদিন—
-শোনো, লেবু ও আদা দিয়ে লিকার চা খেয়ো।

-লেবু–আদা কোথায় পাব মা এখন?
তখনই মনস্থ করছে লকডাউন শেষে দুজনের জন্য আদা ও লেবু নিয়ে যাবে। কাউকে দামি জিনিস দিয়েও খুশি করা যায় না আর কেউ সামান্য আদা–লেবু পেয়েও আনন্দে ভেসে যায়।

নিজের গাছের লেবু সে প্রায় সময়ই এনে তাকে দিয়েছে। কোভিডের কারণে কাউকে দেওয়ার আর সুযোগ পায়নি। এবার লেবু দেবে তাদেরও। সামান্য একটু আদার জন্য ভালোই দাম দিতে হলো। সবাই নিশ্চয়ই আদা–চা খাওয়া শুরু করেছে, তাই দামটাও রকেটে চড়ে আকাশমুখী হয়েছে।

প্রবাদ আছে আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরের দরকার কি। তার কর্ম হচ্ছে মাটির নিচ থেকে তোলা আদা বাজারে নিয়ে বিক্রি করা। জাহাজ নিয়ে আদার খোঁজে বের হওয়া তার কাজ নয়। জাহাজিরা দামি পণ্য নিয়ে ঘোরে।

প্রথম সপ্তাহে সহনীয় দামে তিন শ গ্রাম আদা কিনেছিল। এর মাঝে রোজার মাস শুরু হলে তো কাঁচা ছোলার ওপর আদা, কাঁচা মরিচ কুচিয়ে না দিলে হবে না। মাসি ও খালার সঙ্গে ওই আদাটুকু ভাগ করে নিল।

পরেরবার শপিংয়ে গিয়ে আরও দাম দিয়ে আদা কিনতে হলো। এক বান্ধবীকে আদার দামের কথা বলতেই শুনতে হলো—
-বড়লোকদের বাজারে ঘোরাঘুরি কেন করো?
-গরিবদের বাজারে কি আদা সস্তা?
-ওদের আদার দরকারই পড়ে না।
-ওহ তাই!

উনি জানেন না যে গরিবদের বাজারেও আদা আছে, তারাও সাধ্যমতো আদা কেনে বা এমনও হতে পারে উনি হয়তো তাজা আদা কেনেন না কখনো।

আরেকজন বললেন—
-কতটুকু আদাই বা খাও যে দাম নিয়ে অনুযোগ করছ।

বেচারি তাকে আর খুলে বলল না যে সে শুধু নিজের জন্যও নয় একটু আদা অন্যদেরও দিতে চাইছে, যাতে তারাও এই কোভিডের অতিমারির সময়ে একটু আদা, লেবুর চা খেতে পারেন। তা ছাড়া নিজের হয়ে গেলে অন্যদের সমস্যা নিয়ে কথা বলা যাবে না এ নীতিতে সে বিশ্বাসী নয়। কে বলেছিল ‘রাজ্য যাক ঝুড়ি বেঁচে খাক, আমার তাতে কি’। সবাই এ রকম নীতি নিয়ে চললে সমাজ–সংসার রসাতলে যেত।