জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক: বাংলাদেশ নিউজ প্রসঙ্গ

বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরকালে সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুয়েই তানাকা (১৯৭৩)
বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরকালে সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুয়েই তানাকা (১৯৭৩)

(গতকালের পর)

ওই ম্যাগাজিনে চমৎকার একটি স্মৃতিকথা লিখছিলেন ওয়াতাশি তো বানগুরাদেশু অর্থাৎ আমি এবং বাংলাদেশ শিরোনামে তাকেনাকা কিনইচি, তার বাংলাদেশের স্মৃতি (২) পর্বের তিন নম্বর অধ্যায় অর্থনৈতিক সমস্যা ও জাপানের ভূমিকায়। মনে হচ্ছে এক ও দুই নম্বরটি আগের সংস্করণে মুদ্রিত হয়েছে। এই অধ্যায়টি তিনি ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীন পাকিস্তান দিয়ে শুরু করেছেন। সেই অজানা ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, বিশ্ব শ্রেষ্ঠ সোনালি আঁশ তথা পাটের উৎপাদনস্থল পূর্ব পাকিস্তান যখন ভারী শিল্প, কলকারখানাবহুল পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে গেল, তখন এই দেশেও কলকারখানা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। পাটকল, সুতোর কল ও ম্যাচ (দেশলাই)—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প জাপানের কাঁচামাল ও প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কারিগরিতে দক্ষ প্রযুক্তিবিদ না থাকায় জাপানের খ্যাতিমান প্রযুক্তিবিদ যিনি এর আগে কলকাতায় কাজ করেছেন তাকে পাকিস্তান সরকার সরকারের কারিগরি দপ্তরের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। তার নাম নাকাতা ইচিও। টোকিওর তৎকালীন মিত্রবাহিনী প্রধান আমেরিকার জেনারেল হেডকোয়ার্টারের (GHQ) শীর্ষ প্রশাসক জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারের অনুমোদন নিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে ঢাকায় যান নাকাতা। এই নিয়ে পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। তিন বছর সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেন নাকাতা। তিনি তখন ঢাকায় জাপানি নাগরিক সমিতির সভাপতিও ছিলেন। আরেকজন জাপানির কথাও তাকেনাকা কিনইচি জানাচ্ছেন। তিনি কাতাগাতা গেনহাচি (?)। ১৯ বছর বয়সে এই কাচ প্রস্তুতকারী প্রযুক্তিবিদ ঢাকায় গিয়ে এক হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তির কাচ ব্যবসার ব্যবস্থাপক হিসেবে ৫০ বছর কাজ করেছেন। সুতরাং বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) বড় শিল্প কলকারখানা স্থাপনে এই দুজন জাপানির অবদান কত যে গুরুত্বপূর্ণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখানেই থেমে থাকেনি জাপানি সহযোগিতা; স্বাধীনতার পর কৃষি উন্নয়ন, মৎস্যচাষ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও অসংখ্য ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রকল্পে জাপান সরকার বিভিন্ন সময় বিশেষজ্ঞদের যেমন প্রেরণ করেছেন তেমনি আর্থিক অনুদানও দিয়েছেন।

ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দনরত তানাকা মাসাআকি (১৯৭২)
ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দনরত তানাকা মাসাআকি (১৯৭২)

লেখাটির শেষ দিকে তাকেনাকা জানান: ওডিএ লোন ও কিস্তি পরিশোধযোগ্য ছোট ও বড় প্রকল্পের বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সূচনাসংখ্যায় তুলে ধরা হয়েছে। যদিও পাকিস্তানকে প্রদত্ত সমস্ত অর্থ সাহায্যের তিন ভাগের দুভাগ বাংলাদেশে কলকারখানা স্থাপনে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই আমাদের দেশের আধুনিক কারিগরি শক্তি অন্যান্য দাতা দেশসমূহের তুলনায় এই দেশে (বাংলাদেশে) বিশালাকারে ফুল ফোটানোর মতোই যা আমাদের বড় গৌরবের বিষয়। এরপরও অন্যান্য দেশের প্রতি জাপানের বিপুল সহযোগিতার সম্ভাবনা বিদ্যমান।
উল্লেখ্য যে, তাকেনাকা কিনইচি ঢাকায় জাপানি কনস্যুলেট প্রধান ও তোওয়োও ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির উপদেষ্টা ছিলেন। পরবর্তীকালে জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের উচ্চ ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হন।
ম্যাগাজিনে উল্লেখযোগ্য একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তিন পৃষ্ঠাব্যাপী বেনগারু নো রেকিশি গাইকান বা বাংলার ইতিহাস: একটি রূপরেখা শিরোনামে। মূলত প্রবন্ধটি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরের মহাপরিচালক ড. এফ এ খান (আহমাদ নবী খান) রচিত আর্কিটেকচার অ্যান্ড আর্ট ট্রেজার্স ইন পাকিস্তান গ্রন্থ থেকে গৃহীত সংক্ষিপ্ত জাপানি অনুবাদ বিশেষ। এতে প্রাগৈতিহাসিক, প্রাচীন, বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগের স্থাপত্য ও শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা আছে আর আছে বাংলা নামটি কেমন করে হলো তার একটি সম্ভাব্য ধারণা। নিঃসন্দেহে অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সম্পর্কে জাপানের জনগণকে একটা ধারণা দেবার জন্য যথোপযুক্ত এই তথ্যভিত্তিক প্রবন্ধটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যদিও বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগেই অবিভক্ত বাংলা অঞ্চল সম্পর্কে জাপান-ভারত অ্যাসোসিয়েশন তাদের একাধিক বুলেটিনে তথ্যাদি প্রকাশ করেছে।
এরপর সংযুক্ত হয়েছে জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের কিছু কার্যক্রমের সংবাদ। সংবাদের নিচে অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা সভায় জাপান সরকার কর্তৃক যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করা হয়: যেমন ১. যমুনা সেতু (শান্তি ও মৈত্রীর সেতু) নির্মাণের কাজ। ২. বাংলাদেশের যুদ্ধ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য নিঃশর্ত সাহায্যের পরিমাণকে বাড়ানো। ৩. চিকিৎসা, কৃষি প্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রেরিত প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞদের সারিতে জাপান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় বিশেষজ্ঞ বিনিময় জোরদার করা।

বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ও ভক্ত তাদামাসা ফুকিউরার সঙ্গে গ্রন্থ বিনিময় করছেন লেখক
বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ও ভক্ত তাদামাসা ফুকিউরার সঙ্গে গ্রন্থ বিনিময় করছেন লেখক

জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী পরিষদ তুলে ধরা হয়েছে ম্যাগাজিনের শেষদিকে। সমিতির সভাপতি ছিলেন হায়াকাওয়া তাকাশি। কর্মসচিব ছিলেন ইতোও কেইসুকে। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, চাল নেই চুলো নেই, তলাবিহীন ঝুরি বলে আখ্যায়িত সদ্য স্বাধীন দেশটিকে নিয়ে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টারা ছিলেন জাপানের রাজনীতি ও ব্যবসাজগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। যেমন, শিন নিহোন তেৎসুদোও কোম্পানির চেয়ারম্যান নাগানো শিগেও, তোওকিয়োও শিবাউরা দেনকি কোম্পানি তথা তোশিবার প্রেসিডেন্ট দোকোও তোশিও, কোওবে সেইতেৎসুজো কোম্পানি তথা কোবে স্টিলের প্রেসিডেন্ট তোশিমা কেনকিচি, নিহোন কোওগিয়োও গিনকোও সোওদানইয়াকু তথা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংক অব জাপানের উপদেষ্টা নাকায়ামা সোহেই, আজিয়া গাইকোও কোনদানকাই তথা এশিয়া কূটনীতি বিনিময় সংস্থার উপদেশক নাকাতানি তাকেয়ো, সেইজি হিয়োরনকা তথা রাজনীতি সমালোচক তোগাওয়া ইসামু, কানসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ৎসুরুশিমা সেৎসুরেই ও টোকিও বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ৎসুয়োশি নারা।
সহসভাপতি ছিলেন মিৎসুবিশি শোওজি কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ফুজিনো চুউজিরোও, মিৎসুই বুৎসুসান কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ওয়াকাসুগি মিউকি, নিশশোইওয়াই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ৎসুজি য়োশিও ও নিহোন কোওয়েই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট কুবোতো ইউতাকা।
উচ্চ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তাকেনাকা কিনইচি।
পরিচালকবৃন্দ সাংসদ আকিতা দাইসুকে, সাংসদ হাসেগাওয়া তাকাশি, সাংসদ কান তারোও, সাংসদ কাসাওকা তাকাশি, সাংসদ ইয়ামাউচি ইচিরোও, বোওয়েই কিয়োকাই তথা প্রতিরক্ষা পরিষদের মহাপরিচালক ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, ওওবায়াশিগুমি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ওওবায়াশি য়োশিগোরোও, শিমিজু কনস্ট্রাকশন কোম্পানির প্রেসিডেন্ট য়োশিকাওয়া সেইইচি, তোওয়োও ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির প্রেসিডেন্ট নাইতোও মাসায়োশি, আসাহি কাসে (কেমিক্যাল) কোম্পানির প্রেসিডেন্ট মিয়াজাকি কাগাইয়াকি, ওওৎসুকা সেইইয়াকু (ওষুধ) কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ওওৎসুকা মাসাহিতো, হিতাচি (হিটাচি) জোওছেন (জাহাজ) প্রস্তুতকারী কোম্পানির প্রেসিডেন্ট নাগাতা তাকাও, হিনো জিদোওশা (মোটর) প্রস্তুতকারী কোম্পানির প্রেসিডেন্ট মাৎসুকাতা মাসানোবু, ইসুজু জিদোওশা (মোটর) প্রস্তুতকারী কোম্পানির প্রেসিডেন্ট আরামাকি তোরাও, মারুবেনি কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিয়ামা হিরো, ইতোওচুউ শোওজি (করপোরেশন) কোম্পানির প্রেসিডেন্ট এচিগো মাসাকাজু, সুমিতোমো শোওজি (করপোরেশন) কোম্পানির প্রেসিডেন্ট শিবায়ামা মায়ুকিও, কানেমাৎসু কোওশোও (করপোরেশন) কোম্পানির প্রেসিডেন্ট মাচিদা গিয়োতা, টোকিও কাইজোও কাসাই হোকেন (মেরিন ইনস্যুরেন্স) কোম্পানির প্রেসিডেন্ট কিকুচি মিনোরু প্রমুখ।
সমিতির পরিদর্শক ছিলেন নিহোন দেনকি (NEC Corporation) কোম্পানির প্রেসিডেন্ট কোবায়াশি কোজি ও তাইহে ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ৎসুয়েজাকি ওয়াতারু।
কার্যকরী পরিষদের নিচেই রয়েছে এই সংস্থার কর্মসূচিসমূহ। যেমন:
লক্ষ্য: এই সংস্থা জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক বিনিময় সম্পর্ককে জোরদার করে অবদান রাখবে।
কার্যক্রমসমূহ:
১. বিজ্ঞান-সংস্কৃতিবিষয়ক ব্যক্তিদের বাংলাদেশে প্রেরণ, সরকারি প্রতিনিধি প্রেরণ, বাংলাদেশ থেকে আগত ব্যবসায়ীদের সহযোগিতাকরণ ও বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণার্থী অনুমোদনে উদ্যোগ গ্রহণ।
২. সেমিনার, গবেষণা ও মতবিনিময় সমাবেশের আয়োজন। বুলেটিন ও বুদ্ধিতাত্ত্বিক প্রকাশনা প্রকাশ।
৩. সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে অভিমতপত্র দাখিল।
৪. লক্ষ পরিপূরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
সদস্য নির্বাচন: ১. প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য, ২. সাধারণ সদস্য, ৩. বিশেষ সদস্য ও ৪. সাম্মানিক সদস্য।
চাঁদার হার: প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য মাসে ১০ হাজার ইয়েন। সাধারণ মাসে পাঁচ শ ইয়েন।
প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য প্রবেশমূল্য এক লাখ ইয়েন। সাধারণ সদস্য প্রবেশমূল্য অপ্রয়োজনীয়।
পরিচালনা পরিষদ: সভাপতি (চেয়ারম্যান) একজন। সহসভাপতি অনধিক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন। পরিচালক অনধিক। পরিদর্শক দুজন।
উপদেষ্টা নিয়োগ: বর্তমান সংস্থা পরিচালকবৃন্দের নীতিনির্ধারণী সভায় অনধিক উপদেষ্টা নির্বাচন করতে পারবে। উপদেষ্টারা পরিচালকবৃন্দের নীতিনির্ধারণী সভা অতিক্রম করে সভাপতির বিশ্বস্ততা অর্জন করবেন।
কর্মসচিব নিয়োগ: এই সংস্থায় কর্মসচিব একজন প্রয়োজন। গুরুত্ব অনুযায়ী একাধিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া যাবে। প্রধান কর্মসচিব সভাপতির অধীনে কাজ করবেন।
নতুন সদস্য আহ্বান: যারা এই সংস্থার সদস্য হতে আগ্রহী তাদের আবেদনপত্র পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। ছয় মাসের অগ্রিম চাঁদা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সহজ নির্দিষ্ট অর্থ প্রেরণ আবেদনপত্র ব্যবহার করাই হবে শ্রেয়। সেমিনার, গবেষণা, মতবিনিময় সভার তথ্যাদি ছাড়াও বাংলাদেশের খবরাখবর ও সংস্থার মাসিক মুখপত্র বিনা মূল্যে পাঠানো হবে।
যারা সদস্যপদ ছাড়া মাসিক মুখপত্র পেতে আগ্রহী তাদের এক বছরে তিন হাজার ইয়েন এবং যারা ছয় মাসের গ্রাহক হতে চান দেড় হাজার ইয়েন পাঠাতে হবে।
ম্যাগাজিনের শেষ দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কলাম: বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আগমন-নির্গমন।
ক. জুলাই মাসের ২৪ তারিখে সাংসদ তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও কৃষি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের প্রধান এস লতিফ প্রমুখরা ইউনিসেফ আয়োজিত প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষাবিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য জাপান আগমন করেন। এই মাসেরই ২৯ তারিখে জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের উচ্চ ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকেনাকা ও কর্মসচিব ইতোও শিবা পার্ক হোটেলে তাদের সম্মানে এক প্রীতিসমাবেশের আয়োজন করেন। পুনরায় আগস্ট মাসে জাপান ভ্রমণের সময় গ্রাম পরিদর্শনকল্পে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন অতিথিদ্বয়।
খ. অ্যাসোসিয়েশনের ট্রাস্টি সদস্য ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাজুও আজুমা আগস্ট মাসের ১ তারিখ থেকে চার দিনের এক সফরে ঢাকার উদ্দেশে হানেদা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে রবীন্দ্রগবেষক হিসেবে এবার তিনি বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্য মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিনিময়ে ভূমিকা রাখা ও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ফিরে আসবেন।
গ. আগস্ট মাসের ১৩ তারিখে জাপান সরকারের সচিব মুরাকামি কাজুও ঢাকার জাপানি দূতাবাসে নিয়োগপ্রাপ্তিতে হানেদা ত্যাগ করেন। ঢাকা যাওয়ার পূর্বে ৮ তারিখে ওকুরা হোটেলে জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হায়াকাওয়ার আয়োজনে এক সভায় সচিবের পরিকল্পনা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াবিষয়ক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মোতেকিসহ অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানবৃন্দ, উচ্চ ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকেনাকা ও কর্মসচিব ইতো উপস্থিত ছিলেন।
ঘ. গত মার্চ মাসের শেষ থেকে ৫০ জনের একটি দলের নেতা কৃষি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান তাকামি তোশিহিরো (জাপান খ্রিষ্টান কাউন্সিলের স্বেচ্ছাসেবী বিভাগের সহপরিচালক) সম্প্রতি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছেন। জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হায়াকাওয়া আগস্ট মাসের ১১ তারিখে উক্ত দলপ্রধান তাকামি ও সহপ্রধান কিকুচিকে এক মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানান এবং বাংলাদেশের অবস্থা অবগত হন।
ঙ. রাষ্ট্রদূত মনোরঞ্জন ধর জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে আগস্ট মাসের ১১ তারিখে প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুকুদা তাকেওর (পরবর্তীকালে ১৯৭৬-৭৮ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দূত হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থানরত জাপান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রেরিত সহমর্মিতা ও সহযোগিতার কথা স্মরণ করে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানান।
বুলেটিনের শেষ পৃষ্ঠায় লিখিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে: এবার ২৭তম ১৫ আগস্ট (১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়কে স্মরণে রেখে)। সেই সময়কার (যুদ্ধে পরাজয়ের পরবর্তী বছরগুলো স্মরণে) খাদ্যসংকট, আবাসনসংকট, এতিম শিশু সমস্যা, বেকার সমস্যা, যোগাযোগ সমস্যা, পণ্যসামগ্রীর অভাব ও মূল্যবৃদ্ধি তথা বিধ্বস্ত দেশভূমি জুড়ে সামাজিক বিপর্যয়, ঘাত-প্রতিঘাত, সশস্ত্র-সন্ত্রাস, চোরাচালানি, বাজার শূন্য করা, ঘুষ-উৎকোচ, প্রতারণা, কর ফাঁকি ইত্যাদি নানা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে এখনকার জাপান প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এই দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে গোড়াতেই সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমস্যার বিপরীতে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের এই যাত্রা লগ্নকে এখন থেকে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত না করলে নয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরবর্তী বিপর্যয় ও দারিদ্র্যকে স্মরণে রেখে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমাদের অনুধাবন, সহমর্মিতা প্রকাশ ও সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে সমস্যা নিরসনে কীভাবে কাজ করা যায় এই বিষয়ে উক্ত বাংলাদেশে সাহায্য কীভাবে সম্ভব শীর্ষক আলোচনা-বৈঠকের আয়োজন করেছি। এই সংখ্যায় পুরো আলোচনাটি পত্রস্থ করা যায়নি বলে দুঃখিত, পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে। বৈঠকে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতা কামনা করছি।
ম্যাগাজিনের তৃতীয় প্রচ্ছদে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র তুলে ধরে দেখানো হয়েছে কোথায় কোথায় গ্যাস ক্ষেত্র আছে। প্রচার উপলক্ষেÿএটা মুদ্রিত হয়েছে যাতে করে জাপানি তেল সন্ধানী কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করে বলে মনে হয়।
উপসংহার: ইতিহাস যদি নানা উৎস ও দলিলপত্রের গ্রন্থিত রূপ হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তুলে আত্মপরিচয় নির্ধারণে, জোগায় পরস্পর মানবিক-সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্ককে জোরদার করার অনুপ্রেরণা, সর্বোপরি আঞ্চলিক ভাতৃত্ববোধকে জাগ্রত করে উন্নত জীবন ও সময় নির্মাণ তাহলে সামান্য উৎস হলেও এই বাংলাদেশ নিউজ ম্যাগাজিন/বুলেটিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এ রকম আরও প্রকাশনা যে জাপানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, এগুলোকে সংগ্রহ করার দায়িত্ব জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসের। দূতাবাস কি এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ বিগত চার দশকে গ্রহণ করেছে, মনে হয় না। (শেষ)।

প্রবীর বিকাশ সরকার: জাপানপ্রবাসী লেখক ও গবেষক।

অারও পড়ুন :-