জাপানে বাংলাদেশের সবজি চাষ

সাগর সিকদারের চাষ করা বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি সবজি
সাগর সিকদারের চাষ করা বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি সবজি


জাপানের সাইতামা অঞ্চলের শিন মিসাতো স্টেশন। লালাপট ও কোসটোকো নামের বিশাল সুপার মলের গাঁ ঘেঁষে এককালের ছোট নদী এখন শীর্ণ খাল। সেখানেই অনাদরে বেড়ে ওঠা গাছগাছালির মাঝখানে পরম মমতায় মাটি কুপিয়ে তৈরি করা হয়েছে এক চিলতে আবাদি জমি। গত পাঁচ বছর ধরে সেখানে বাংলাদেশের নানান ধরনের সবজি আবাদ করছেন প্রবাসী সাগর সিকদার। নেশা একটাই, কাজের অবসরে যে সময়টুকু হাতে থাকে তার পুরোটাই সেই খেতে নানান জাতের বাংলাদেশি সবজি চাষ করা আর তা প্রবাসীদের মাঝে বিলানো।

সাগর সিকদারের চাষ করা বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি সবজি
সাগর সিকদারের চাষ করা বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি সবজি


কী নেই সাগরের সবজি বাগানে। সব ধরনের শাক, নানান জাতের মরিচ, দেশি আলু, বেগুন, কাঁকরোল, ঝিঙা, পটল, বরবটি, চিচিঙ্গা, শসা ও টমেটোর নানা জাত। চাষ করতে গিয়ে এখন যেন নিজেই চাষ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। চাল কুমড়া কেন এত বড় হচ্ছে, একই মরিচ অর্ধেক সবুজ, অর্ধেক কালো, কিছু দেশি শাক এখানে রং বদলে যাচ্ছে, বারবার লাগিয়েও ফসল হচ্ছে না। পরে বোঝা গেল এরা পুরুষ গোত্রের, কিছু শংকর ফলনও করা যাচ্ছে।
কীভাবে শুরুটা হয়েছিল জানতে চাইলে সাগর জানালেন, তখন আমি ভাড়া বাড়িতে থাকি। দেশ থেকে ধনে পাতার বীজ এনেছিলাম। নিজের একচিলতে জমি নেই। প্রতিদিন কাজে যেতে আসতে এই জায়গাটা দেখি। জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সামান্য জায়গার জঙ্গল পরিষ্কার করে ধনে বুনে দিলাম। কয়েক সপ্তাহ পরে দেখি ধনে গাছ ডগডগিয়ে উঠছে। কী যে আনন্দ হলো। মায়া জমে গেল বাংলাদেশের বীজ জাপানে বড় হচ্ছে।

সাগর সিকদারের সঙ্গে লেখক
সাগর সিকদারের সঙ্গে লেখক

সপ্তাহে একদিন যাই, পানি দিই, আগাছা পরিষ্কার করি। লকলকে বড় হয়ে ওঠা পাতা নিজে খাই, বন্ধুদের দিই। পরের বছর আরও বেশি করে চাষ করি। বাংলাদেশ থেকে যেই আসেন তাকে দিয়ে নানান বীজ-চারা আনাই। এক অদ্ভুত নেশায় পেয়ে বসে। পানির মিনি পাম্প কিনে আনি। সরকারি জায়গা, কিছু না ভেবেই হালকাভাবে ঘিরে দিই। ছুটির পুরো সময় ওই জমিতে কাটাই। বন্ধুরাও উৎসাহ দেন। অনেকে আসেন। নিজের হাতে সবজি তোলেন। আমি ব্যাগ ভর্তি করে দিই। বন্ধু, ভাই-ভাবিদের চোখে মুখে যে আনন্দের ঝলক দেখি তাতে মন জুড়িয়ে যায়। অনুপ্রেরণা পাই। কয়েক দিন আগে আমার জমির সবজি দিয়ে শতাধিক প্রবাসীর সঙ্গে আমরা বড় হলে গান-বাজনা করে খাওয়া দাওয়া করেছি।
সাগর জানালেন, আমার জাপানি স্ত্রী। আমাকে কয়েকবার সে বলেছে অনুমতি ছাড়া সরকারি জমি আবাদ করছি, এটা ঠিক নয়। বারবার বলাতে ওকে সঙ্গে নিয়ে একদিন ওয়ার্ড অফিসে যাই। ওরা আমার পাগলামির কথা শুনে তামাশা করে বলেন, সারা জাপানের বেশির ভাগই তো বন জঙ্গল। পারলে আপনি পুরোটাই আবাদ করেন। তবে অনুমতি দেওয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আপনি চালিয়ে যান। ওয়ার্ড অফিস, কৃষি বিভাগের লোকজন, প্রতিবেশী জাপানিরা সাগ্রহে আমার বাগানে আসেন, বাংলাদেশের সবজি দেখেন, কেউ কেউ নিয়ে যান। রান্না করে খান। তারা এই সবজির মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানছেন এটাই আমার আনন্দ। এই একচিলতে জমি আমাকে মায়ায় বন্দী করেছে। এর মায়ায় আমি কাছাকাছি বাড়ি কিনেছি।

সাগর সিকদারের চাষ করা বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি সবজি
সাগর সিকদারের চাষ করা বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি সবজি


কোনো খারাপ অনুভূতি আছে কিনা প্রশ্ন করলে সাগর জানালেন, যত্ন করে চাষ করেও ফলন না হলে, অতি আগ্রহে অনেকে জমির কচি চারা পা দিয়ে মাড়ালে, টানাহেঁচড়া করে গাছ থেকে ছিঁড়তে গিয়ে গাছকে ব্যথা দিলে কষ্ট পাই। তবে সেটা মনে মনে, কাউকে বলি না।
এ বছর ১৯-২৩ সেপ্টেম্বর জাপানে নতুন করে চালু হওয়া সিলভার হলিডের (ব্যঙ্গ করে অনেকে এটাকে তিন শতাংশ কনজামশন ট্যাক্স বাড়ানো আবে সরকারের ট্যাক্স বোনাস বলেন) একটি দিন আমি হঠাৎ​ সাগরের জমিতে হাজির হয়েছিলাম তার এই অভিনব শখ স্বচক্ষে দেখার অভিপ্রায়ে।
কি দেখলাম? প্রবাসে মানুষের দেশপ্রেম কতভাবে বিকশিত হয় তা বোধ হয় ঠাওর করা যায় না দেশে থেকে।
ফেরার সময় ব্যাগ ভর্তি সাগরের পরিশ্রম আর ভালোবাসার ফসল বাংলাদেশের নানান সবজি। দুইবার ব্যাগ ছিঁড়ল। বুকে ধরে আছি ১০-১২ কেজি মালামাল। ট্রেনের যাত্রীরা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছেন। আমি সজাগ একটি পাতাও যেন না পড়ে। কারণ এ আমার বাংলাদেশ।
যাওয়ার সময় ভাবি, একা থাকি, এত দিয়ে কী করব। এক বন্ধুকে ফোনে সবজির কথা বলি। তিনি গভীর রাতে এক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে এসে নিয়ে যান আর পরের রোববার তার বাসায় গিয়ে ভূঁড়ি ভোজনের দাওয়াত কবুল করি।