জাপানের হানামি বা চেরি ফুলের উৎসব

চেরি ফুল
চেরি ফুল

‘ওগো বিদেশিনি তোমার চেরি ফুল দাও, আমার শিউলি নাও, এসো দুজনে প্রেমে হই ঋণী’—এই গানটি শুনেছেন নিশ্চয়! ছাত্রজীবনে যখন গানটি শুনি তখন চেরি ফুল চিনতাম না। যখন জানলাম এটি জাপানের ঐতিহ্যবাহী একটি ফুল, তখন থেকেই চেরি ফুল কাছে থেকে দেখার খুব ইচ্ছে করত। সৃষ্টিকর্তা আমার সেই ইচ্ছা পূরণ করে দিলেন, চেরি ফুলের দেশে চলে এলাম। গত বছর আমি যখন জাপানে এলাম, তখন থেকেই গাছগুলো শ্রীহীন রিক্ত অর্থাৎ ন্যাড়া রূপ ধারণ করে আছে। অপেক্ষায় আছি কখন চেরি ফুল দেখব। দিন যায়, মাস যায়, বাংলাদেশে শীত-বসন্ত শেষ হয়ে বৈশাখ আসি আসি করে কিন্তু এখানে শীত যেন শেষ হতেই চায় না এবং চেরির দেখাও মেলে না। জাপানে এ বছর শীতের তীব্রতা মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলেছে। এরপর কয়েক দিন কিছুটা গরম পড়তেই রুক্ষ চেরি গাছগুলোর কাণ্ড ভেদ করে কুঁড়ি বের হতে দেখলাম। মজার ব্যাপার হলো শীতের প্রকোপ না কমলে কুঁড়িগুলো এই অবস্থাতেই থাকে। জাপানের আবহাওয়া অফিস হিসাব করে বলে দেয় জাপানের কোথায় কবে চেরির দেখা পাওয়া যাবে। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিলে সাধারণত চেরি ফুল অতি অল্প সময়ের জন্য ফোটে। এ বছর সিজুওকাতে সেটা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফোঁটার কথা, অবশেষে অনেক প্রতীক্ষার অবসান হলো, চেরি ব্লসমের দেখা মিলল।

চেরি ফুল ফোটার পর পার্কে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়
চেরি ফুল ফোটার পর পার্কে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়

এ বছর ৩ এপ্রিল চেরি ফুলকে ঘিরে যে উৎসব হয় সেটা দেখার জন্য আমরা সিজুওকা স্টেশনের পাশের শুনপুঞ্জ পার্কে গেলাম। যে পার্ক সারা বছর প্রায় জনশূন্য থাকে সেখানে আজ সব বয়সী মানুষের ভিড়। সপরিবারে অথবা বন্ধুবান্ধব মিলে খাবার, ড্রিংকস নিয়ে চেরি গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে বসে গল্প করছে, কেউবা কার্ড খেলছে, কেউ আবার ঘুমাচ্ছে। এ যেন অন্য রকম এক উন্মাদনা। যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর! অন্যদিকে পার্কের মাঠে মেলার মতো স্টল নানা রকমের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে আছে এবং যার যেটা পছন্দ কিনে খাচ্ছে। চেরিকে নিয়ে সারা বিশ্বেই চলে ব্যাপক উন্মাদনা। নিজেদের জাতীয় ফুল বলে জাপান এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। প্রায় ১৩ শ বছর ধরে জাপানিরা এই ফুলটিকে নিয়ে বিভিন্ন উৎসব পালন করে আসছে, যার মধ্যে ‘হানামি’ অন্যতম। হানামি জাপানি শব্দ, এর অর্থ ফুল দেখা বা ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করা। অনিন্দ্য সুন্দর এ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে জাপানিরা এ উৎসবের আয়োজন করে। উৎসবের দিনটি জাপানিদের কাছে এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। আমার ল্যাবের পক্ষ থেকে আগে থেকেই অধ্যাপক হানামির তারিখ ঠিক করে রেখেছিলেন (৮ এপ্রিল, ২০১৬)। আমরা ভার্সিটির সামনের পার্কে হানামি উদ্‌যাপন করলাম। সাধারণ ভাষায় যা চেরি গাছের নিচে বসে পিকনিক করা আর চেরির সৌন্দর্য উপভোগ করা।
জাপানের জনপ্রিয় হানামির ইতিহাস এক হাজার বছরের বেশি। ওই সময়কার মানুষ বিশ্বাস করত, ঈশ্বরের অবস্থান উদ্ভিদের ভেতর। আর সে বিশ্বাস থেকেই তারা গাছের পূজা করত ও চেরি গাছের কাছে মানত রাখত। জাপানিরা চেরির এই সৌন্দর্য উপভোগের জন্য চেরি গাছের নিচে সারা দিন অবস্থান করেন, পছন্দের আহার পানীয় গ্রহণের পাশাপাশি তারা চেরির অপরূপ শোভা অবলোকন করেন। হয়তো ভাবছেন, গাছের নিচে বসে সৌন্দর্য দেখার কী মানে হয়? এর কারণ হলো—চেরির সৌন্দর্য অল্প কয়েক দিনের, তিন-চার দিনের মাথায় পাপড়িগুলো ঝরে পড়ে। মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনে সব সময় সুন্দর থাকার চেষ্টা করা, এই দর্শন জাপানিরা নাকি চেরির কাছ থেকেই পেয়েছেন। জাপানের সাহিত্য কর্মে প্রাণবন্ত জীবনের প্রতীক রূপে চেরিকে তুলে ধরা হয়।

শিযুওকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চেরি ফুলের গাছের নিচে শিক্ষার্থীরা
শিযুওকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চেরি ফুলের গাছের নিচে শিক্ষার্থীরা

প্রায় তিন শ বছর আগে টোকিও শহর নতুন করে নির্মাণের সময় সুপরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছিল অসংখ্য চেরি গাছ। গড়ে তোলা হয়েছিল চেরি উদ্যান। অতি যত্ন করে লাগানো গাছগুলো প্রতি বসন্তে শোভা ছড়িয়ে প্রতিদান দিয়ে চলছে। নদীর কিনার ঘেঁষে রোপিত চেরি গাছগুলোর পুষ্পশোভিত শাখাপ্রশাখা প্রবহমান জলের মধ্যে তৈরি করছে প্রতিবিম্ব। আজকের এই আধুনিক উন্নত জাপান তো তিন শ বছর আগে ছিল না, কিন্তু সুন্দরের প্রতি ভালোবাসা, সুন্দরকে লালন করা, নিজের সত্তার মধ্যে ধারণ করা এই বোধটুকু তখনো ছিল, আর এটাই জাপানিদের সহজাত বৈশিষ্ট্য বলে মনে হয়। চেরির এই শোভা দেখার পর থেকে আমার সোনার বাংলার বর্ণিল শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে যায়। আমার মতে, আমাদের কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য চেরির চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু আমরা একে নিয়ে কোনো উৎসব পালন করি না। ঢাকা শহরে অনেক কৃষ্ণচূড়া গাছ নীরবে জন্ম নিয়ে সৌন্দর্য দিয়ে আমাদের মন প্রাণ ভরিয়ে দেয়, কিন্তু পরিকল্পিতভাবে সেই সুন্দরের মর্যাদা, তাকে লালন কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ, অথবা মন-প্রাণ ভরে উপভোগ, সেই দর্শন আমাদের নেই। আমরা কী পারি না নিজেদের ঐতিহ্য লালন করতে? শরতের শিউলি, বকুল, বর্ষার কদম কী একদিন হারিয়ে যাবে?

শিযুওকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চেরি ফুলের গাছের নিচে শিক্ষার্থীরা
শিযুওকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চেরি ফুলের গাছের নিচে শিক্ষার্থীরা

যাই হোক, ফিরে আসি আবারও চেরি প্রসঙ্গে। সাকুরা বা চেরি উৎসব এখন জাপান ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পালিত হয়। দেশগুলো হচ্ছে—তাইওয়ান, কোরিয়া, ফিলিপাইন, ম্যাকাও, জর্জিয়া, ফিনল্যান্ড ও আমেরিকা। শত বছর আগে ১৯১২ সালে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে জাপানিরা আমেরিকাকে ৩০০০ সাকুরা গাছের চারা উপহার দেয়। এরপর ওয়াশিংটন ডিসিতে দুই দেশের বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে গাছগুলো শোভা পেতে থাকে। ১৯৬৫ সালে আরও ৩৮০০ চারা উপহার হিসেবে পাঠানো হয় জাপানের পক্ষ থেকে। ফলে এটি এখন আমেরিকানদের কাছেও বেশ মোহনীয় একটি ফুল। নিউইয়র্কের ব্রুকলিতে প্রতি বছর মে মাসের মাঝামাঝি সাকুরা ফেস্টিভ্যাল পালিত হয়। ব্রুকলি বোটানিক্যাল গার্ডেন আয়োজিত উৎসবগুলোর মধ্যে সাকুরা উৎসব খুবই জনপ্রিয় একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে।
পত্রিকায় দেখলাম, বাংলাদেশে চেরি গাছ লাগানো হয়েছে। হয়তো দেখা যাবে কয়েক বছর পর বাংলাদেশে হানামি বা চেরি ফুল দেখা উৎসব পালন শুরু হয়ে যাবে!

(লেখক পিএইচডি গবেষক, শিযুওকা ইউনিভার্সিটি, জাপান)