জানতে হলে পড়তে হবে

ফাইল ছবি

এখন বিশ্বায়নের যুগ। বিশ্বায়নের এই যুগে নিজেকে পাল্টে বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠা খুবই দরকার। আর বিশ্ব নাগরিক হতে হলে ভালোবাসার সেতু তৈরি করতে হবে। তার জন্য দরকার সহযোগিতা, সৃজনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ-সম্পন্ন ভালোবাসা ও বোধশক্তি।
‘এ কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি, মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়’—গানের কথা, মনের কথা, পরের কথা, কিছু নতুন কথা এবং ভালোবাসার কথা, সঙ্গে হবে আজ কিছু বাস্তব জীবনের কথা।

প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী এক হন ভালোবাসার বন্ধনে, গড়ে ওঠে এক নতুন জীবন মায়ের গর্ভে। শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক নতুন সেতু, ভালোবাসার সেতু।

আজ বিশ্লেষণ করব বিশ্বের চারটি দেশকে নিয়ে। তাদের মানসিকতা, চিন্তাধারা, সামাজিকতা, স্নেহ-মমতাসহ বিশেষ কিছু দিক, যা আশা করি ভালো লাগবে সবার। কিছু কথা থাকবে, কিছু রিফ্লেকশন থাকবে। থাকবে একটি সদ্যোজাত শিশুর সঙ্গে তার মায়ের প্রাথমিক সম্পর্ক। সঙ্গে আরও কিছু নতুন চিন্তাধারার সংযোজন, যা প্রয়োজন হবে যখন শুরু হবে আমাদের বিশ্ব ভ্রমণ।
যে চারটি দেশ বেছে নিয়েছি তার মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, জাপান, সুইডেন ও বাংলাদেশ।

বর্তমানে এসব দেশের সব বাচ্চাই হাসপাতালে প্রসব হচ্ছে, তবে বাংলাদেশের হাসপাতালের প্রসবের সংখ্যা এখনো শতভাগের অনেক নিচে। তারপর অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিক অপ্রয়োজনীয় সিজার করে। অন্যদিকে এটাও সত্য যে অনেক মা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা চান না যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রসূতি মায়ের ব্যথা-বেদনায় খুব বেশি কষ্ট হোক। তার চেয়ে অস্ত্রোপচারই ভালো। কিন্তু অনেকেই ভেবে দেখেন না অস্ত্রোপচারের চেয়ে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া শিশু অনেক বেশি ভালো থাকে।

তারপর করোনাকালে চিকিৎসক-নার্সদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলছে হাসপাতালে নষ্ট, অব্যবহৃত যন্ত্রের দীর্ঘ তালিকা। যন্ত্র অচল ও অব্যবহৃত থাকার ঘটনাগুলো নতুন নয়। ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক ড. মান্নান মৃধা WHO-এর হয়ে বাংলাদেশের হাসপাতাল অডিট করে একটি রিপোর্ট কর্তৃপক্ষকে দিয়েছিলেন, সেখানে জেনেছিলাম দেশের প্রায় সব হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে নানা যন্ত্র অচল ও অব্যবহৃত পড়ে আছে। এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি, যা নজরে পড়ল প্রথম আলোর রিপোর্টে। বৈদ্যুতিক সংযোগ না থাকার কারণে যন্ত্র পড়ে থাকে, টেকনিশিয়ান না থাকার কারণে যন্ত্র চিকিৎসার কাজে লাগে না। কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্মকর্তাদের আন্তরিক উদ্যোগের অভাবে এমন ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও পাওয়া যায়। তবে বেসরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি অচল বা অব্যবহৃত থাকতে দেখা যায় না। সরকারি হাসপাতালে এমন ঘটে উদ্যোগের অভাবে, আন্তরিকতার অভাবে, সমন্বয়ের অভাবে। গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্য খাতে যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে, তার পরিণতিতে রোগীর চিকিৎসায় না লেগে বছরের পর বছর যন্ত্রপাতি অচল ও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে।

যাহোক, আমেরিকায় শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ধাত্রী প্রাথমিক পর্যায়ে বাচ্চার দেখাশোনা করেন। বাচ্চার মায়ের বিশ্রাম নেওয়া, তাঁর হরমোনের এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে যা যা দরকার সেসব সুযোগ-সুবিধা তাঁরা পেয়ে থাকেন হাসপাতালে থাকাকালে। মাঝেমধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য বাচ্চাকে মায়ের কাছে আনা হয়। মজার ব্যাপার, মা এ সময় দিব্যি তাঁর শিশুর সঙ্গে কথোপকথন করেন যেন একজন প্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। শিশুর মা ভাবেন না যে এতটুকু বাচ্চা সে তো কিছুই বুঝতে পারছে না।

জাপান, সুইডেন বা বাংলাদেশে বিষয়টি বেশ অন্য রকম। এরা বাচ্চাকে হাত বোলানো, বুকের ওপর রাখা, আদর করা, গানের সুরে কিছু বলা এমন আচরণ সচরাচর বাচ্চার সঙ্গে করে থাকে। মূলকথা, পুরো বাচ্চার দায়িত্ব তারা নিজেরা নিয়ে থাকে, যাতে কোনো ব্যতিক্রম না ঘটে। জন্মের শুরুতেই শিশু অণুকরণ এবং অনুসরণ করতে শুরু করে, সঙ্গে সৃষ্টি হয় মিথস্ক্রিয়ার এবং গড়ে উঠতে শুরু করে ভালোবাসার সেতু।

ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সুইডেনের সঙ্গে জাপানের যেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় তেমনটি হয় না আমেরিকানদের সঙ্গে। আমেরিকানদের প্রভাবশালী আচরণ, প্যাকেজিং, কথা বলার রং-ঢং, সুইডিশ বা জাপানিজদের কাছে খুব একটা প্রশংসনীয় নয়। এ বিষয় নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা হয়েছে এবং এমনটি প্রমাণিত হয়েছে যে এই পার্থক্যের কারণ জন্মের শুরু থেকে একটি শিশুর সময়গুলো কীভাবে অভিযোজন ও মনিটরিং করা হয়েছে তার ওপর।

একইভাবে বিশ্বের কিছু জাতি কথা বলে বেশি তুলনামূলকভাবে অন্য জাতির চেয়ে। ঘনবসতিপূর্ণ জাতি কথা বলে বেশি তুলনামূলকভাবে। যেমন ইতালি বা ফ্রান্সের মানুষ বেশি কথা বলে সুইডিশদের তুলনায়।

দারিদ্র্য, কুশিক্ষা, সাংস্কৃতিক মূল্য বা না জানার কারণ প্রভাব বিস্তার করে বা করতে পারে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের ওপর।

কয়েকটি উদাহরণ
ভারতের (কলকাতা ছাড়া) বেশির ভাগ রাজ্যে তারা হ্যাঁ বা না যেটাই উত্তর করুক না কেন পুরো মাথা তারা নাড়াবেই। অনেক সুইডিশ এদের সঙ্গে ব্যবসা করতে এসে পড়েছে বিশৃঙ্খলার মধ্যে।

জাপানে কেউ যদি ব্যবসার কার্ড পরিচয়পত্র হিসেবে দেয়, তা চট করে পকেটে ঢোকালে চলবে না, সেটাকে তার সামনে জোরে জোরে পড়তে হবে, যাতে সে বুঝতে পারে তাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, নইলে ব্যবসা করা সম্ভব হবে না।

আমেরিকানরা তাদের প্রথম পরিচয়ে হ্যান্ডশেক করে এবং তা খুব জোরালোভাবে। কারণ, তারা বোঝাতে চায় আমি তোমার সঙ্গে আছি।
সুইডিশরা চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পছন্দ করে, কারণ তারা মনে করে চোখ মনের কথা বলে ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের মানুষ বেশি কথা বলে, বেশি বেশি তেল মারতে অভ্যস্ত, পারলে মিথ্যা কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে না। যেমন এক ভদ্রলোক বিদেশি বসের বাসায় ইলিশ মাছ এনে বলছে, স্যার, নিজের পুকুরের মাছ আপনার জন্য এনেছি। জাতির এই গুণগত অভ্যাস হয়তো থেকেই যাবে আজীবন। মানুষের সাংস্কৃতিক আচরণ বিশাল আকারে প্রভাব বিস্তার করছে জীবনের পদে পদে।

ওপরের বিষয়গুলো বর্ণনার কারণ এই যে পারস্পরিক আন্তরিকতা বা মনুষ্যত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার নির্ভর করছে মানুষের ভেতর ও বাইরের পারিপার্শ্বিকতার ওপর। সিঙ্ক্রোনাইজেশন, ইন্টিগ্রেশন, মাইগ্রেশন, অভিযোজন, গ্লোবালাইজেশন, মাল্টিক্যালচার, জনসংখ্যা বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং জলবায়ু এসব বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু একজন বিশ্ব নাগরিকের জন্য। ডিজিটালাইজেশনের যুগে শুধু পুরোনো পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করলে বর্তমান পৃথিবীর নাগরিক হওয়া সম্ভব নয়। স্কুল–কলেজের পড়াশোনার সঙ্গে ‘স্ট্রিট স্মার্ট’ হতে হবে।

একটি ওয়ার্কশপ দিয়ে লেখাটা শেষ করি, বিশেষ করে যারা ডাক্তারি পড়ছে, তাদের নিয়ে। রোগী এসেছে, রোগীর প্রোস্টেট ক্যানসার। রোগী সেটা জানে এবং তার চিকিৎসা চলছে। রোগী অনেকটা ভালোর পথে।

ক্লাসে ওয়ার্কশপে একদিকে এক গ্রুপ শিক্ষক অন্যদিকে এক গ্রুপ ছাত্রছাত্রী। উভয় গ্রুপ আলাদা এবং যৌথভাবে শুনছে রোগীর উপসর্গ এবং প্রশ্ন করছে রোগীকে নানা বিষয়ে। পরে উভয় গ্রুপ ঐক্যবদ্ধভাবে একটা সিদ্ধান্ত নেবে এবং সবশেষে সেটা প্রকাশ করবে শ্রেণিকক্ষে।

যদি দুই পক্ষ একই সিদ্ধান্তে আসে এবং রোগীর রোগের সিমটমের সঙ্গে একমত হয়, তবে খুব ভালো। এখন একমত হলেও প্রশ্ন হতে পারে কেন একমত হলো এবং তার কারণ কী? কী শিক্ষা? কী সেই শিখন পদ্ধতি? একমত না হলে কারণ কী? কেন একমত না? তাহলে কি যোগ্যতার অভাব? নাকি অন্য কিছু, ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবেই পরস্পর পরস্পর থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। মানে যারা জানে তাদের থেকে শেখা। এমন ধরনের মন–মানসিকতা তৈরি করতে হবে বা জানতে হলে পড়তে হবে। হচ্ছে কি বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এমনটি প্রশিক্ষণ!

বিশ্ব নাগরিক হতে হলে জানতে হবে, জানতে হলে পড়তে হবে, পড়তে হলে কৌতূহলী হতে হবে, জানার আগ্রহ বাড়াতে হবে এবং অন্যকে উৎসাহিত করতে হবে।
সৃজনশীল শিক্ষক, বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবার দিতে পারে এ ধরনের সমাধান এবং সাবধানই একমাত্র সুশিক্ষার পথ। সচেতন জাতি খুঁজে বের করে সমাধান, অজুহাত নয়।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন