ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা

সেই ভোর রাত থেকে জাল বেয়ে চলেছে খগেন। একটাও মাছের দেখা নাই। পুবের আকাশ লাল হয়ে গেছে, সূর্য উঠবে। নাহ, আর কত! শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না খগেনের কদিন হলো। সুরবালা বলেছিল আজকে পানিতে না নামতে। সকালে ধরপর করে উঠেই খগেন জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু সুরবালা তা করতে দেয়নি। কিছু না খেয়ে খগেনকে কখনোই সুরবালা বের হতে দেয়নি। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
কাল নগেন এসেছিল অনেক দিন পর। নগেন খগেনের ছোট ভাই। বোয়ালিয়ার চরে থাকে। সেই যে বছর পাঁচেক আগে ফুলজোর নদীতে ভাঙন ধরল, অনেকের বাড়ি রক্ষা হলেও নগেনের বাড়িটিকে টেকানো যায়নি। কার সাধ্য নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকবে। খগেন চেয়েছিল ওরই উঠোনেই আরেকটা ঘর তুলে নগেন থাকুক। নগেন তা চায়নি। সদ্যবিবাহিত নগেন অনেক ভেবে চিনতে শেষে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠেছে। আসলে আরতো কোনো উপায় ছিল না। তবে নগেনের শ্বশুর খুব ভালো মানুষ। সুরবালাদের আত্মীয়। সুরবালাই অনেক বলে কয়ে দেবরের সঙ্গে তাঁর দূর সম্পর্কের মামাতো বোনের বিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে ছিল দুই বোন একসঙ্গে থাকবে, তা আর হয়নি।
বোয়ালিয়ার চর খুব একটা দূরে না। নৌকা পথে ঘণ্টা দুই লাগে। ওই জেলে পাড়াটা অনেক বড়। এখনো অনেকে দিব্যি কষ্ট করে হলেও নিজেদের পেশাটাকে টিকিয়ে রেখেছে। এখানে অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয়নি। সর্বনাশা ফুলজোর সব ভেঙে নিয়ে গেছে। নগেন আসার সময় চিড়া, মুড়ি, নারকেলের নাড়ু, মোটকা পিঠা আরও কত কী এনেছে। নগেনের বউটা খুব ভালো। সুরবালার সঙ্গে গলায়-গলায় মিল। দুই বোনে গল্প করতে বসলে আর কথা ফুরায় না। নগেনের শাশুড়ি সুরবালাকে অনেক পছন্দ করেন। বছরে এক-দুইবার এসব পাঠান। তবে পয়লা বৈশাখের আগে কিছু পাঠাতে তার কখনোই ভুল হয় না।
সুরবালা ঘুম ঘুম চোখে খগেনকে দুটা নারকেলের নাড়ু আর এক গ্লাস পানি দিয়েছিল। তাই খেয়ে খগেন জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। প্রায় দুই ঘণ্টার ওপরে জাল টানার পরেও খগেনের জালে একটা মাছও জুটল না। আসলে নদীটাও ছোট হয়ে এসেছে। কবে যে নতুন পানি আসবে, তখন হয়তো দুই-একটা মাছ পাওয়া যাবে। নদীর অনেক অংশই শুকিয়ে গেছে। টুকটাক একটু আধটু পানি দেখে দেখে জাল ফেলছে খগেন।
মাছ না পেয়ে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে খগেনের। জাল আর খালই রেখে আলো আঁধারিতে নদীর ধারে ঘাসের ওপরে বসে পড়ে খগেন। মাথাটা কেমন টনটন করতে থাকে। আজকে মুরাদপুরের মেলা। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে মুরাদপুরে মেলা হয়। খগেন প্রতিবছর মেলায় মাছ বিক্রি করে। মেলাতে বেশ চড়া দামে মাছ বিক্রি হয়। গ্রাহকেরা কোনো দরদাম করেই না। সবাই কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। যা দাম চায় তাই দিয়ে নিয়ে যায়।
এবারই প্রথম খগেন কোনো মাছ ধরতে পারেনি মেলার দিনে। ঘরে তো কোনো জমানো টাকাও নাই। মাছের যা আকাল পড়েছে কয়েক মাস হলো, দিন এনে দিন খাওয়াই জটিল হয়ে পড়েছে। যতিন তিন দিন হলো বায়না ধরেছে এবারের মেলায় তাকে চশমা আর ঘড়ি কিনে দিতেই হবে। এবার তো শুধু যতিনকে দিলেই হবে না। মেয়ের জন্যও কিছু আনতে হবে। আর সুরবালা? সুরবালাকে সাদা শাড়ি লাল পারে সুন্দর মানায়। কত দিন সুরবালা বছরের পয়লা দিন সাদা শাড়ি লাল পাড় পড়েনি। ইচ্ছে ছিল এবার একটা কিনে দেবে। তা আর হলো কই।
নাহ খগেন আর ভাবতে পারছে না। এবার উঠতে হবে। বেলা উঠে যাচ্ছে। আহা কী সুন্দর নির্মল আকাশ। আজকে পুবের আকাশে কোনো মেঘ নেই। কী শীতল ঝিরঝির বাতাস। এখন সুরবালাকে নিয়ে হাঁটতে বের হলে ভালোই হতো। স্বল্পভাষী খগেন নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করে। সুরবালার মতো এমন লক্ষ্মী মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়েছে। কোথাও বের হলে সারাক্ষণ কথা বলতেই থাকে। খগেন ভাবে আচ্ছা সুরবালাও যদি ওর মতো কম কথা বলত, তাহলে তো সবকিছুই বিরক্তিকর লাগত।
খগেনের পৃথিবীটা খুবই ক্ষুদ্র। নিজের জীবনের বাইরে আরও তিনটে প্রাণী। এদের কাউকে ছাড়া খগেন কিছুই ভাবতে পারে না। একটুও না। আজকাল মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। খগেন ভাবে বিধাতা কেন মানুষকে সবকিছু দিয়ে পাঠান না। কেন এত অভাব দিয়ে বিধাতা মানুষকে দুনিয়াতে পাঠান। কিছুদিন আগেও খগেন স্বপ্ন দেখত, সে অনেক বড় হবে। বাড়িটা আরও বড় আর সুন্দর করবে। উঠোনটা বাড়বে। সেই উঠোনে ছোট ছোট পা ফেলে যতিন ঘুরে বেড়াবে আর যতিনের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে সুরবালা ক্লান্ত হয়ে যাবে। খগেনকে বলবে, ও যতিনের বাপ, তুমি এ কেমন পোলা দিলাগো, তার সাথে তো পারি না। তোমার বেটাক তুমি সামলাও।
তা কখনো হয়নি। ক্ষুদ্র উঠোন। দুই পা দিলেই বাহির বাড়ি আবার দুই পা দিলেই ঘর। খগেনের শোবার ঘরের পেছনে এক চিলতে সরু জায়গা। ওখানেই কত যত্ন করে সুরবালা কত রকমের সবজি লাগায়। খগেন ইচ্ছে করেই কখনো ঘরের পেছনের সবজির বাগান দেখতে যায় না। খগেন জানতে চায় না, সুরবালা আসলে ওখানে কী কী গাছ রেখেছে। কোন গাছে কোন সবজি ধরল। জানতে চায় না এই জন্য যে, সুরবালা মাঝে মাঝে খগেনকে অবাক করে দিয়ে কী সব তরকারি বাসনে উঠিয়ে দেয়। দিয়েই জিজ্ঞেস করে, ক্যা গ্যাদার বাপ কও তো কীসের তরকারি, কীসের ঝোল? খগেন জেনেও অভিনয় করে। এটা ওটা অন্যটা বলে। খগেন জানে এই যে সুরবালার ক্ষুদ্র আনন্দ এর কোনো মূল্য হয় না। এই আনন্দকে সে কোনোভাবেই নষ্ট করে দিতে চায় না।
এসব ভাবতে ভাবতে খগেন কখন বাড়ির উঠোনে এসে পৌঁছেছে বুঝতেই পারেনি। জাল আর খালই রেখে মাটিতেই বসে পড়ে। সুরবালা হাত মুখ ধুয়ে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিল। খগেনের দিকে এগিয়ে আসে। কিগো যতিনের বাপ মাছ পাও নাই? আমি জানিতো তুমি আইজকা মাছ পাইবা না, হের জন্যইতো না করছিলাম যাইতে। আমার কতাতো হুনো না। কেন গেলা? আইচ্ছা অইছে, হাত মুখ ধোও। এহন এল্লা গুমাও। খগেন বিড়বিড় করে বলে গুম কী আর এত সোজা। আমি কী আর এত সুখে আছি যে হুলেই গুম আসপো। খগেনের উত্তর না পেয়ে সুরবালা এগিয়ে আসে। একদম খগেনের গা ঘেঁষে বসে। কিগো, মন খারাপ কইরা কী অইবো। কপালে না থাইকলে তুমি আর আমি কি করবার পারুম কও। এত চিন্তা কইরো না খগেনের বাপ। যাও এল্লা গুমাও।
খগেন কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে পড়ে। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে যতিন আর হৈমবালা ঘুমুচ্ছে। হৈমবালা খগেনের মেয়ে। মাত্র এক বছর বয়স হলো। যতিনের বুকের ওপরে তাল পাতার পাখাটি। হয়তো সুরবালা বাতাস করতে করতে ছেলের বুকের ওপরেই রেখে গেছে। খগেন তালপাতার পাখাটি হাতে নেয়। একনিমেষেই অনেক দূর অতীতে ফিরে যায়। কত আগের এই পাখাটি। খগেনের মায়ের হাতের বানানো। তখন খগেনের মা তালপাতার পাখা বানাতো মেলায় বিক্রি করার জন্য। এখনো একটুও নষ্ট হয়নি পাখাটি। কত যত্ন করে মা পাখাটি বানিয়েছিল। পাখার চারদিকে লাল, নীল আর সবুজ সুতা দিয়ে মোড়ানো। রঙিন সুতার ভাঁজে ভাঁজে পাখি, ফুল আর গাছের ছবি।
সুরবালা শাশুড়ির হাতের জিনিসটাকে কত যত্ন করে রেখেছে। খুব মনে পড়ে। বৈশাখ মাসের দুপুরে গরমে গাছের ছায়ায় মায়ের কোলে মাথা রেখে নগেনের গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে খগেন শুয়ে পড়ত। মা তালপাতার পাখায় বাতাস করত। কী শান্তি ছিল সেই বাতাসে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ত বুঝতই না। মায়ের হাতের পাখা নড়তেই থাকত। প্রতিবার বৈশাখী মেলায় বাবা খগেন আর নগেনকে নিয়ে মেলায় যেত। একহাতে কাপড়ে মোড়ানো কয়েক ডজন তালপাতার পাখা। সেইসাথে নগেনকে বাবা কাঁধে নিত আর খগেন বাবার অন্য হাতের দুইটা আঙুল ধরে থাকত। তারপর সোজা মেলায়। কোনো কোনোদিন দুইবার যাওয়া হতো। সকালে বাবা সারা রাতের ধরা মাছ মেলায় নিয়ে বিক্রি করতেন। আবার দুপুরে ফিরে এসে মায়ের হাতের বানানো পাখা আর দুই ছেলেকে নিয়ে আবার মেলায় যেতেন। কত যে মজা ছিল। মেলার সুরেশ কাকার দোকানে বসে ধূলিমাখা রসগোল্লার কথা কী আর ভোলা যাবে। দুজনকে দুপাশে বসিয়ে বাবা সুরেশ কাকাকে বলতেন, দাদা খগেন আর নগেনকে রসগোল্লা দেন দেহি। খাওয়া শেষ হলে বাবা সংসারের খুঁটিনাটি কত কী কিনতেন। এরপর সারা গায়ে ধূলি মেখে বাড়ি ফিরত সবাই।
দিনে দিনে কত কী বদলাল। খগেন বিয়ে করল, বাবা-মা মারা গেল। চারপাশের অনেক কিছুই চোখের সামনে বদলাল। কিন্তু খগেনের ভাগ্য বদলাল না। খগেন ভাবে এই যে ভাগ্য না বদলানো, এর জন্য তো সে কাউকেই দায়ী করতে পারে না নিজেকে ছাড়া। আর নিজেরই বা কি করার ছিল। পড়ালেখাও তো করতে পারেনি বেশি দূর। সেইতো নাম সাক্ষর পর্যন্তই। আগে বাবাকে সবাই কার্তিক হালদার বলে ডাকত। জেলে পাড়াতেও নাম ডাক ছিল। ফুলজোর নদীতে বছরে একবার সব জেলেরা মিলে মাছ ধরত। তিন-চার দিন ধরে সেই মাছ ধরা হতো। পুরো নদী জুড়ে জাল ফেলা হতো। কত বড় বড় মাছ। দূর-দূরান্ত থেকে মাছের ব্যাপারীরা আসত। কয়েক গ্রামের মানুষ এসে সেই মাছগুলো কিনে নিয়ে যেত। মাছের একটা ভাগ কয়েক গ্রামের গণ্যমান্য লোকজনকে দেওয়া হতো। সবাই বলত ইজারার ভাগ। যদিও খগেন এখনো বোঝে না এই ইজারাটা আসলে কি। তারপরও অইদিন পুরো জেলে পাড়ায় কী এক আনন্দ বিরাজ করত।
এখন নদীতে আর সেভাবে মাছ ধরা হয় না। মাছই নাই, ধরবে কী। খগেনকে কেউ আর হালদার বলে ডাকে না শুধু একজন ছাড়া। পূর্বপাড়ার রমিজ মাস্টার। খগেনের এই যে নাম দস্তখত শেখা তাও ওই রমিজ মাস্টারের বদৌলতেই। রিটায়ার করেছে কবে কিন্তু এখনো দেখা হলেই বলে কীরে খগেন হালদার নিজেতো পড়ালেখা করলি না, পোলাডারেও জাইল্যা বানাইস না। খগেন মাথা নাড়ে। সত্যিই খগেন আর সুরবালা চায় না যতিন ওর বাপ দাদার পেশায় থাক। যদিও ভোটার লিস্টে তার নাম খগেন হালদার, কেউ ডাকে খগেন, কেউ খগেননা। সুরবালা অনেক মেধাবী ছিল বোঝা যায়। তাওতো ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। ইস সৃষ্টিকর্তা কেন যে এত ভালো একটা মানুষকে খগেনের এই অভাবী জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে দিল খগেন বুঝতে পারে না। সুরবালার তো আরও ভালো বিয়ে হতে পারত। ধ্যাৎ কী সব সব ভাবছে খগেন।
ভাগ্য বদলানোর জন্য খগেন আর সুরবালা যে চেষ্টা করেনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু যতবারই চেষ্টা করেছে ওদের ভেতরে বহুদিনের লালিত বাপ-দাদার পেশার প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা এই জেলে পেশাকে ছেড়ে আসতে দেয়নি। সাহা পাড়ার ফটিক সাহা কতবার বলেছিল জাল ফেলা ছেড়ে দিয়ে বাজারে গিয়ে তার দোকানে সাহায্য করতে। একবার গেছেও। মন টেকেনি। মাছ ধরার নেশা তাকে আবার টেনে নিয়ে এসেছে। বাপ-দাদার এই পেশাকে সে কোনোভাবেই হেলাফেলা করতে পারেনি। সুরবালাও একবারও সায় দেয়নি মাছ ধরা ছেড়ে অন্য কিছু করতে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? জীবনের চেয়ে বড় আর কিছু কি আর আছে। হয়তো একদিন সব ছেড়ে ছুড়ে অন্য কোনো পেশায় নেমে যেতে হবে। পেটে ভাত না জুটলে আবেগ আর ঐতিহ্য রক্ষার বৃথা চেষ্টায় তো জীবন চলবে না।
এরই মধ্যে সুরবালা ঘরে প্রবেশ করে। গ্যাদার বাপ তুমি এহনো মন খারাপ কইরা আছ? হোনো, একবার না অয় মেলায় যাইবা না। কিছু অইব না। ওপরওয়ালা কি আমাগোরে কোনো দিন না খাওয়ায়ে রাখছে কও। তার ওপরে ভরসা রাহো। ব্যবস্থা একটা অইবই। সুরবালা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে, আইচ্ছা গ্যাদার বাপ তুমি কেবা মানুষ কও দেহি।
খগেন সুরবালার দিকে তাকায়।
সুরবালা বলে, রইছ মোল্লার কাছ থাইকা টেহা গুনা আনবা না?
আরে হে দিলে তো, খগেন বিরক্তি সহকারে উত্তর দেয়।
টেহা চাইবাতো। যে দিন জোর কইরা অত বড় মাছটা নিয়া গেল আর দাম দেওনের নাম নাই। এল্লা যাও না, বছরের পয়লা দিন, দিবারতো পারে। কতোগুনা টেহা।
খগেন বলে, আর দিছে, হের মধ্যে তো তার মাও মইরা গ্যাছে। এহন কি টেহা চাওয়া ঠিক অইব?
কী জানি তোমার কতা আমি বুজিনা। তোমার টেহার দরকার, তুমি চাইবা না, সুরবালা বলে।
খগেন চুপ করে থাকে।
সুরবালা খগেনকে ডাকে। এই, আইস পান্তা খাও।
হঠাৎ বাইরে কারও গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। ক্যারে খগেন বাড়িত আছুৱে?
খগেন বলে, মনে ওয় মোল্লা সাবের গলা। আইছে মাছের খোঁজে। টেহা দেওনের নাম নাই, মাছ চায়!
খগেন দ্রুত পায়ে বের হয়ে যায়। সুরবালা মনে করিয়ে দেয়, হুনো মোল্লা সাবের কাছে টেহা চাওনের কতা বুইল না।
খগেন মাথা নাড়ে।
কীরে খগেন কেবা আছুৱে? বছরের পয়লা দিন, টেহা দিতে আইলাম। রইছ মোল্লা টাকা দিতে এসেছে। পকেট থেকে টাকা বের করে খগেনকে দেয়।
অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় খগেন একটু হকচকিয়ে যায়। কোনোভাবেই মেলাতে পারে না। মোল্লা সাব এভাবে টাকা দেবে বুঝতে পারে না। আস্তে হাত বাড়িয়ে টাকা নেয়। মোল্লা সাহেবকে বলে, এল্লা বইবেন্না? আহেন ভেতরে আহেন। বছরের পয়লা দিন এল্লা চিড়া মুড়ি মুহে দিয়া যান। মোল্লা সাহেব দ্রুত পায়ে যেতে থাকেন। নারে, বছরের পয়লা দিন মেলা কাম। খগেন কিছু মনে করিস না, টেহা সময় মতো দিবার পারি নাই।
খগেন কৃতজ্ঞতা ভরে মোল্লা সাহেবের দিকে তাকায়। কোনো কথা বলতে পারে না। খগেনের কাছে আজকে মোল্লা সাহেবকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ মনে হয়।
সুরবালা আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। খগেন ভেতরে ঢুকতেই খগেনের হাত জড়িয়ে ধরে। কীগো গ্যাদার বাপ কি অইল? কইছিলাম না, চিন্তার কিছু নাই। সবকিছু হে দেহে বুঝছ?
খগেন মাথা নাড়ে। কী এক আনন্দে খগেনের মনটা ভরে ওঠে। চোখ মুছতে মুছতে সদ্য ঘুম ভাঙা যতিন সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা, মেলাত যামু না? হ যামুরে বাপ, খগেন যতিনকে জড়িয়ে ধরে। চারটি প্রাণীর এই ছোট্ট গৃহকোণ অভূতপূর্ব এক আনন্দে ভরে ওঠে। সে আনন্দে ভেসে যেতে থাকে খগেন আর সুরবালা।
*নুরুল হুদা পলাশ: সাস্কাতুন, সাস্কাচেওয়ান, কানাডা।