ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের চিঠিগুলো যখন লেখা হয় তখন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন টগবগে তরুণ। ২৬ বছর বয়স থেকে এই চিঠিগুলো লেখা শুরু হয় এবং শেষ চিঠিটি যখন লেখা হয় তখন তাঁর বয়স ৩৫। এই সময়ের মধ্যে তাঁর মনভূমিও ভবিষ্যৎ সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের জন্য প্রস্তুত হয়। প্রমত্ত পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য, গ্রাম বাংলার প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর রূপ তাঁকে সুন্দর ও সত্যের কাছে যাওয়ার জন্য উজ্জীবিত করে তোলে।
ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোতে যে ভাব জগতের বার্তা পাই, সে বার্তা মূলত ভেসে এসেছিল স্রোতস্বিনী পদ্মার বুকের ভেতর থেকে, রবীন্দ্রনাথ কান পেতে সে বার্তাকে অন্তরে ধারণ করেছিলেন। পদ্মার ঢেউ তখন কবিতার ছন্দ তোলে, পদ্মার রূপ, লাবণ্য নয়ন মনোহারী, পদ্মা তখন দোর্দণ্ড প্রতাপে জনজীবনের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। আর বাংলার আকাশ, যে আকাশের অনির্বচনীয় রূপ সকাল, সন্ধ্যা, রাতে বৈচিত্র্যপূর্ণ রং এবং মেজাজে মানুষের সঙ্গে কথা বলে। সে কথা, সে রূপের মাধুর্য আবার ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে বদলে যায়। রবীন্দ্রনাথ বাংলার প্রকৃতির অন্তরের সঙ্গে মিশে যান, ছিন্নপত্রের প্রতিটি পত্রের অন্তর্গত বার্তা বাংলার মাটির গন্ধ থেকে উঠে আসে। রবীন্দ্র মানস ভাব ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান হয়ে যায়। মনভূমি তাঁর সুবর্ণ পলিতে ভরে যায়। সেই সুবর্ণ পলি তাঁকে মহামূল্যবান সৃষ্টির উপকরণ জোগায়। রবীন্দ্রনাথের কাব্য জ্যোতি প্রকাশিত হওয়ার জন্য ছিন্নপত্র লেখার এই দশকটি তাঁকে জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার সুযোগ করে দেয়। এই মিথস্ক্রিয়া তাঁকে জীবন ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের দর্শনকে বুঝতে সহায়তা করে। সত্যকে তিনি আবিষ্কার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তাঁর কাছে তখন সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য হয়ে ধরা দেয়। প্রকৃতির গভীরে অন্তর্দৃষ্টিকে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ। সে অন্তর্দৃষ্টির জন্য তিনি তাঁর ভাব সম্পদকে পাঠকের মনোজগতে প্রেরণ করতে সক্ষম হন।
রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র পড়তে হলে মানসিক প্রস্তুতি বড় জরুরি। যিনি পাঠ করছেন তাঁর অন্তর সুন্দরও সত্যের দ্যুতি গ্রহণ করার জন্য কতটুকু উপযোগী; ছিন্নপত্র পড়ার আগে এই প্রশ্নটি নিজেকে নিজে করে নিলে ছিন্নপত্রের বার্তা অনুধাবন করা সহজ হয়ে যায়। ছিন্নপত্র যেমন জগৎ সংসারের মলাট ধীরে ধীরে উন্মোচন করে, একই ভাবে বাংলার বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশের প্রকৃতির ভেতরের দর্শনকে সবার সামনে তুলে ধরে। ছিন্নপত্র পড়তে গিয়ে এ কথা আমার অন্তর্জগতে বারবার ধ্বনিত হয়েছে। রবীন্দ্র সংগীতের সেই অসাধারণ দার্শনিক কথার মতো, ‘ডাকব না, ডাকব না অমন করে বাইরে থেকে ডাকব না/পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাব, আনব ডেকে’, ছিন্নপত্র পড়ার তাগিদ অন্তর থেকে আসা উচিত। অন্তরের ডাকে ছিন্নপত্রকে উপলব্ধি করতে হবে। ছিন্নপত্র নিয়ে রবীন্দ্র গবেষক, বাংলা সাহিত্যের পণ্ডিতেরা প্রচুর লেখালেখি করেছেন, আরও বহুমাত্রিক লেখালেখি হবে। হীরক খণ্ডে সূর্য রশ্মি পড়ে চারদিকে যে দ্যুতি ছড়ায় সে দ্যুতিকে বর্ণনা, ব্যাখ্যা, উপলব্ধি, অনুধাবনের শেষ নেই। তাই ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে জীবনবোধ, জীবনের রহস্যকে বোঝার তৃষ্ণা বাঙালির কোনো দিন মিটবে বলে মনে হয় না। জগৎকে, বিশ্ব চরাচরকে ক্লান্তিহীন জানার প্রচেষ্টার নাম দর্শন। জগতের, জীবনের রহস্যকে জানার জন্য তাই অবিরত রবীন্দ্র পাঠ যেমন চলতে থাকবে, একই ভাবে রবীন্দ্রনাথের মানস চক্ষু দিয়ে জীবন দর্শন ও জগৎ দর্শনের জন্য ছিন্নপত্র বিশ্লেষণের প্রচেষ্টাও সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের বিরামহীনভাবে চালাতে থাকবেন। এ এক অনন্ত সৌন্দর্যের পথে যাওয়ার আনন্দ।
ছিন্নপত্র একটি পত্র-সংকলন হলেও এর সাহিত্যগুণ ও দার্শনিক-প্রভা এতই প্রবল যে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে এটি একটি অনিন্দ্য সুন্দর জীবন দর্শনের ব্যাখ্যা। এ কারণে ছিন্নপত্র রবীন্দ্র-অনুরাগী পাঠকদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দ লাভের এক অসাধারণ উপকরণ। ছিন্নপত্রের অধিকাংশ পত্রের রচনার স্থান শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসর। পত্রগুলোর রচনাকাল সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৮৯৫। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরাকে এ পত্রগুলো লিখেছিলেন। ইন্দিরা দেবী চিঠিগুলোর সারাংশ দুটি বাধানো খাতায় নকল করে রবি কাকাকে উপহার দেন। রবীন্দ্রনাথ কিছু চিঠির পুরোপুরি এবং কিছু চিঠির অংশবিশেষ বর্জন করে প্রয়োজন মতো ‘ভাষা ও ভাবগত সংস্কার’ করেন এবং ‘সর্বসাধারণের পাঠোপযোগী’ একটি ‘সাহিত্যিক’ রূপ দেন। এ পত্রগুলোর মধ্যে কতগুলো নিয়ে ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ১২ শ্রাবণ ‘ছিন্নপত্র’ প্রথম প্রকাশিত হয়। চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর আঁকা প্রচ্ছদে গ্রন্থটির প্রকাশক ছিলেন কবির কনিষ্ঠ জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত ১৫১টি পত্রের মধ্যে ইন্দিরা দেবীকে লেখা ১৪৩টি এবং কবিবন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা ৮টি পত্র ছিল। ছিন্নপত্রে প্রকৃতির বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত, দৃশ্যাবলি, ঘটনা এবং নিস্তরঙ্গ জীবনপ্রবাহ এমনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির গভীরতায় ও ভাষার সহজাত ভঙ্গিমায় শিল্পিত রূপ পেয়ে পত্রগুলো চিরকালের মানুষের জীবন ও জগৎ দর্শনের উপকরণ হয়ে পড়েছে।
ছিন্নপত্রের চিঠিগুলো লেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলাদেশে পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনার জন্য এসেছিলেন। শিলাইদহ-শাহজাদপুর ও পতিসরে অবস্থানকালে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে এ চিঠিগুলো লেখা হয়। প্রকৃত পক্ষে এ সময়েই তিনি প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশতে পেরেছিলেন, একই ভাবে বাংলার মানুষকেও তিনি আন্তরিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মানস জগতের যে জাদুকরী পরিবর্তন ঘটে সে পরিবর্তনের প্রধান প্রভাবক ছিলেন গ্রাম বাংলার অতি সাধারণ প্রান্তিক মানুষ। অকৃত্রিম এ মানুষগুলোর অন্তরের ছোঁয়ায় তাঁর হৃদয় জগতেও এক ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। রবীন্দ্রনাথের অবচেতনে আভিজাত্যের, অহমের কোনো ছিটেফোঁটা থাকলেও প্রকৃতি ও বাংলার অতি সাধারণ মানুষের জীবনের সহজিয়া প্রকৃতি তাঁকে পরিশুদ্ধ করে তোলে। মানুষ রবীন্দ্রনাথ তখন উজ্জ্বলতর রূপে আবির্ভূত হন। জমিদার সত্তাকে আড়ালে ফেলে সামনে চলে এলেন এক অসাধারণ মাটির মানুষ, যে মানুষ সব বাঙালির, যে মানুষ বাংলার ঐতিহ্যকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করেন। তাঁর হৃদয়ে তখন সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি হয়।
মানুষের বিপন্নতা তাঁকে অধীর করে তোলে। রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখতে পাই একজন ধ্যানমগ্ন জীবন অধ্যয়নকারী হিসেবে। যে অতীন্দ্রিয় মানুষ তাঁর মানস চক্ষু দিয়ে অন্তরে ধারণ করেন পদ্মার দুই তীরের অপরূপ দৃশ্যপট, হাট থেকে ফেরা মানুষের অভিব্যক্তি, শৈশব পার না হওয়া বধূর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, নদীতে স্নান করতে অথবা পানি নিতে আসা মেয়েদের কলধ্বনি অথবা প্রতিদিনের গল্প। নির্মোহ অবলোকনকারী হিসেবে তিনি এই গণমানুষদের বুঝতে চেষ্টা করেছেন, কল্পনার মানুষ ও বাস্তবের মানুষকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তিনি বাস্তবের মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। এ সময় আমরা দেখতে পাই গ্রাম বাংলার জনসমাজ, গ্রাম বাংলার প্রকৃতির সমন্বয়ে যে জীবন সে জীবনের গভীরের ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে তিনি উদ্গ্রীব। রবীন্দ্রনাথকে বাংলার প্রকৃতি তাঁর কাছে আসার বার্তা পাঠায়, সে বার্তা পেয়ে তিনি ফিরে চলেন মাটির টানে তাঁর সেই সংগীতের বাণীর মতো, ‘ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে/যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।’
রবীন্দ্রনাথ ‘অতি ক্ষুদ্র কর্তব্যের মধ্যেও তৃপ্তি এবং সম্পূর্ণতা আছে’ বলে বিশ্বাস করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বড় উদ্যোগ নয়, বড় কথা নয়, বড় কাজও নয়; বরং প্রতিদিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘কর্তব্য-সমাধা’ করা এবং সর্বোপরি সেই কর্তব্য সমাধায় নিজের সীমা লঙ্ঘন না করায় মানব সমাজে ‘যথাসম্ভব শোভা এবং শান্তি’ প্রতিষ্ঠা পায়। তাঁর এ দার্শনিক ভাবনা শিলাইদহ থেকে লেখা (১৬ জুন, ১৮৯২) ৫৬ সংখ্যক পত্রে প্রকাশ পেয়েছে—‘যতই একলা আপন মনে নদীর ওপরে কিংবা পাড়া গাঁয়ে কোনো খোলা জায়গায় থাকা যায়, ততই প্রতিদিন পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়, সহজভাবে আপনার জীবনের প্রাত্যহিক কাজ করে যাওয়ার চেয়ে সুন্দর এবং মহৎ আর কিছু হতে পারে না। মাঠের তৃণ থেকে আকাশের তারা পর্যন্ত তাই করছে; কেউ গায়ের জোরে আপনার সীমাকে অত্যন্ত বেশি অতিক্রম করার জন্য চেষ্টা করছে না বলেই প্রকৃতির মধ্যে এমন গভীর শান্তি এবং অপার সৌন্দর্য-অথচ প্রত্যেকে যেটুকু করছে সেটুকু বড় সামান্য নয়-ঘাস আপনার চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগ করে তবে ঘাস-রূপে টিকে থাকতে পারে, তার শিকড়ের শেষ প্রান্তটুকু দিয়ে তাকে রসাকর্ষণ করতে হয়। সে যে নিজের শক্তি লঙ্ঘন করে নিজের কাজ অবহেলা করে বটগাছ হওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করছে না, এ জন্যই পৃথিবী এমন সুন্দর শ্যামল হয়ে রয়েছে।’
ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথ ঋষি কিংবা দেবতা নন। জীবনের এই সময়টি রবীন্দ্রনাথকে মানবিকতার গুণে পরিপূর্ণ করে। আমরা তাঁকে বুঝতে পারি না। অতিরিক্ত আবেগে আমরা তাঁকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবতার মতো আরাধনা করতে থাকি। রবীন্দ্র জীবনের নির্মোহ বিশ্লেষণ শেষ পর্যন্ত তাঁকে মানুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করে। পদ্মা তীরের ধু ধু চর, আকাশের সঙ্গে নদীর মিলে যাওয়ার দৃশ্য, প্রান্তজনের বিপন্নতায় যার হৃদয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি করে তিনি তো আমাদের আপন মানুষ। আর যাই হোন না কেন তিনি দেবতা কিংবা ঋষি হতে পারেন না। কারণ দেবতা ও ঋষি মানুষের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন।