ছাত্রের তপস্যা অধ্যয়ন নাকি রাজনীতি

ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’, অর্থাৎ অধ্যয়ন একজন ছাত্রের তপস্যা ও ধ্যান। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য শুধু কোনো বিষয়ে দক্ষ লোক তৈরি করা নয়, ব্যক্তিত্ব ও মননে একজন সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করাও বটে। এ জন্য বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়েও শিক্ষার্থীরা জ্ঞান লাভ করে। এ ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরেও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গুণাবলি বিকাশের নানা রকম ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংগঠনিক কার্যকলাপ ও নেতৃত্ব বিকাশের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ছাত্র সংসদ জাতীয় কার্যক্রম, যেমন স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট সব বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে। কিন্তু এ সংসদ কোনো ক্ষেত্রেই জাতীয় কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড়বৃত্তি করে না। কিংবা ছাত্র সংসদের লক্ষ্য থাকে না প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, যৌক্তিক ও অযৌক্তিক যেকোনো দাবি আদায়ে আন্দোলন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। বরং শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশই থাকে এসব সাংগঠনিক কার্যক্রমের উদ্দেশ্য, যেখানে শিক্ষক ও প্রশাসন সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে এ ধরনের আন্তর্জাতিক আদর্শ মানের বিপরীতে আমাদের দেশে রয়েছে ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতির অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা আমরা প্রায়ই আলোচনা করি। ছাত্ররাই একমাত্র নিঃস্বার্থভাবে দেশের যেকোনো প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এবং অতীতে পড়েছেও। তাহলে তো ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আমাদের কোনো শঙ্কা থাকতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করবে, নাকি রাজনীতিসচেতন নাগরিক হবে—আমরা কোনটি চাই? যদি বলেন রাজনীতি, তবে প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে শিক্ষার্থীদের পেশা কী? রাজনীতি তো কোনো শখের চর্চা নয়, এটি রীতিমতো একটি পেশা। পেশা হলো সে কাজ, যার পেছনে একজন মানুষ সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে, কাজটির প্রতি একটি দায়বদ্ধতা থাকে এবং কাজ করার আগে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়। এ বিবেচনায় রাজনীতি যদি একজন শিক্ষার্থীর পেশা হয়ে থাকে, তবে অধ্যয়নের স্থান কোথায়? আমার সঙ্গে অনেকেই হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন। কারণ, আমাদের সমাজে রাজনীতিকে কেউ পৃথক পেশা হিসেবে বিবেচনা করে না। সে কারণেই শিক্ষক–শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সরকারি কর্মচারী—সমাজের সবাই রাজনীতি করে। বহির্বিশ্বে সবাই রাজনীতিসচেতন, অনেকেরই বিশেষ কোনো মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য রয়েছে। কিন্তু সে মতাদর্শ কোনোক্রমেই তার মূল পেশায় কখনো কোনো প্রভাব ফেলবে না। অথচ আমাদের সমাজে আমরা যে যে পেশায়ই থাকি না কেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় একে অন্যের এমনকি শত্রু পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াই। তা নাহলে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই আবাসিক হলের বাসিন্দা হয়েও শুধু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে কীভাবে একজন আরেকজনের মাথা ফাটায়? ছাত্রের হাতে ছাত্রের নিপীড়ন, মৃত্যু—এসব কোন চর্চার ফসল? বিশ্ববিদ্যালয় কি সচেতন নাগরিক তৈরি করছে, নাকি সন্ত্রাসীর জন্ম দিচ্ছে?
এরপর আরও একটি প্রশ্ন, এসব ছাত্রসংগঠন কার তত্ত্বাবধানে থাকে? একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে যেকোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু ছাত্রদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে। ছাত্রসংগঠনগুলো কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জবাবদিহি করে না, বরং উল্টো রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও কর্মচারী সবাই জিম্মি হয়ে থাকে বাইরের কোনো সংগঠনের হাতে। এরই নাম কি তবে প্রগতিশীল চর্চা? এ চর্চা থেকে শিক্ষার্থীরা কোনো মূল্যবোধ তো শিখছেই না, বরং শিখছে কী করে রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করে একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ম ভেঙে যেকোনো অযৌক্তিক দাবি আদায় করা যায়।
এখানে সমাজের অনেক বোদ্ধা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবেন, বিশ্ববিদ্যালয় কি তবে ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হবে? এখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হবে না? আমার উল্টো প্রশ্ন, ওপরের চর্চা কি আদৌ কোনো মুক্তচিন্তার সুযোগ দিচ্ছে? নাকি ছাত্রসমাজ প্রথাগত রাজনৈতিক ভাবনার মধ্যে আবদ্ধ থাকছে? কেন্দ্র থেকে যখন একটি সিদ্ধান্ত ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন কি কোনো শিক্ষার্থী এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে পারে? মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হলে শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনাকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির শিকল থেকে মুক্ত করতে হবে।
ছাত্ররাজনীতির ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কখনো কখনো আলোচনা হতে দেখা যায়। কিন্তু কোনো সমাধানের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে তারা বরং একে অন্যকে দোষারোপ করে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে। এ কথা মোটামুটি পরিষ্কার, রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করবে না। এর কারণ খুব সহজ, ছাত্রছাত্রীদের মতো এমন শিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল কর্মিবাহিনী তারা আর কোথায় পাবে? তারা তাদের আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্যই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম যে পথভ্রষ্ট হচ্ছে, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সংকটাপন্ন হচ্ছে, তাতে কারও মাথাব্যথা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখনই নতুন কোনো শিক্ষার্থী পদার্পণ করে, তখনই তার পেছনে এসব সংগঠনগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে মধুর বুলি ও আদর্শের তত্ত্ব দিয়ে তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা অর্থ উপার্জনের একটি পথ খুঁজে পায়। শুধু অর্থ নয়, সঙ্গে পান একধরনের ক্ষমতা। ছোট–বড় সবাই মান্য করে, শিক্ষক ও কর্মকর্তা সবাই সমীহ করে, এলাকার লোকজন ভয়ে কাঁপে। ছাত্রাবাসে একটি হল কর্তৃপক্ষ থাকলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ থাকে ছাত্রনেতাদের হাতে। হলে সিট পাওয়া থেকে শুরু করে যেকোনো আচার–অনুষ্ঠানে ছাত্রনেতাদের সেলামি না দিয়ে টেকা যায় না। কোনো সনদ বা দাপ্তরিক দায়িত্ব ছাড়াই এরূপ বিপুল ক্ষমতা শিক্ষার্থীদের মাথা স্বাভাবিকভাবেই ঘুরিয়ে দেয়। নিজেদের তখন মুকুটবিহীন সম্রাট মনে হতে থাকে। এ রকম একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে ছাত্রনেতাদের দিয়ে সমাজের কোনো কল্যাণ আশা করা বাতুলতা মাত্র।
এবার আসি ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস প্রসঙ্গে। আমাদের সামনে প্রায়ই একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের উদাহরণ তুলে ধরা হয়। আমার বরং প্রশ্ন, আমরা কেন শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতার অপরিসীম ক্ষমতাকে ভুলে যাই? কেন শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণের কথা বলি? আমরা কেন আরও বড় অর্জনের কথা বলি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো গবেষণায় সম্মান অর্জন করেছেন কিংবা একজন শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে? তরুণ সমাজ যেমন আন্দোলন করতে পারে, তেমনি অনেক কিছু সৃষ্টিও করতে পারে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই তরুণ সমাজ অনেক বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রয়োজন শুধু সঠিক নির্দেশনা ও পরিকল্পনা। তরুণ সমাজকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কী? আমরা কি চাই তারা শুধু আন্দোলন করুক? নাকি আমরা চাই তারা দেশ ও সমাজের যেকোনো প্রয়োজনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং যোগ্য ভূমিকা পালন করুক? আন্দোলনের জন্য তো কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয় চালু রাখার প্রয়োজন নেই। এর জন্য কিছু প্রশিক্ষণ একাডেমি থাকলেই চলে, যেমন সামরিক বাহিনী রয়েছে। আমাদের প্রয়োজন শিক্ষিত ও দক্ষ তরুণ সমাজ, যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর জন্য পাঠ্যবিষয় ও মানবিক অন্যান্য বিষয়ে তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি, যেটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর মুক্তিসংগ্রামের মতো জাতীয় প্রয়োজন যখন দেখা যাবে, তখন সচেতনতা বোধ থেকেই তারা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এর জন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড়বৃত্তির প্রয়োজন হবে না।
আমাদের অগোচরে ধীরে ধীরে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সব পদে নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, যেখানে যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি নবীন শিক্ষক নিয়োগও অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের মধ্যে এখন শিক্ষকতা ও গবেষণায় উৎকর্ষ সাধনের প্রতিযোগিতার চেয়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রতিযোগিতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। শিক্ষকদের কেউ কেউ আবার ছাত্রসংগঠনের নেপথ্য ভূমিকা পালন করেন, এমনকি নিজের প্রয়োজনে ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করেন।
আমাদের কি এখনো সময় হয়নি ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার? রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা হোক—এ কথা বলার জন্য আর কত রক্তপাতের প্রয়োজন? এ রক্ত আপনার, আমার সন্তানের। যাঁরা ছাত্ররাজনীতির পক্ষে সাফাই গাইছেন, তাঁদের সন্তান কিন্তু নিরাপদে রয়েছে। আমরা আমাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে কীভাবে নিশ্চিন্তে ঘরে বসে আছি? আমাদের আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে এ প্রশ্নের আজই মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন—একজন শিক্ষার্থীর তপস্যা কী হবে, অধ্যয়ন না রাজনীতি!
লেখক: শিক্ষক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র