ছবির চেয়েও বহু গুণ সুন্দর এক জগৎ

বরফে ঢাকা পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিংরত লেখক
বরফে ঢাকা পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিংরত লেখক

ছবিতে দেখা কিছু জিনিস। মনে হয়েছিল ছবিতেই দেখে যাব হয়তো আজীবন। কিন্তু না, শেষ অবধি বাস্তবে দেখা মিলল বহু প্রতীক্ষিত আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টির এক টুকরা অংশ। তবে ছবির চেয়েও বহু গুণ সুন্দর সেই জগৎ। মুসা কা মুসাল্লা! পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া (কেপিকে) প্রদেশের কাগান ভ্যালির সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া।

নামেই একগুচ্ছ গল্পের আভাস। সে সব গল্পের একটি হলো মুসা নামক এক স্থানীয় মেষপালক এই পর্বতের চূড়ায় নামাজ পড়তেন। সে থেকেই এর নাম হয়ে যায় মুসা কা মুসাল্লা অর্থাৎ মুসার জায়নামাজ। হিমালয় পর্বতমালার ৪০৮০ মিটার উচ্চতার এই সুউচ্চ পর্বতচূড়া পর্যটকবান্ধব অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের পর্বতপ্রেমীদের কাছে সুপরিচিত। প্রতি বছর হাজারো পর্যটক এখানে এসে হাজির হন ট্রেকিংয়ের রোমাঞ্চ উপভোগ করার জন্য। তাদের একটা অংশ আবার ভর শীত মৌসুমে তুষারপাতের মধ্যে ভ্রমণে আসেন অন্য রকম এক অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে। ভ্রমণ সংস্থাগুলো এর নাম দিয়েছে উইন্টার সারভাইভাল।

বরফে ঢাকা পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিংরত লেখক
বরফে ঢাকা পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিংরত লেখক

ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতাশূন্য আমার পক্ষে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিনই ছিল। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমার বাংলাদেশি সহপাঠীদের অনেক অনুরোধ-উপরোধ করেও সঙ্গী হিসেবে পেলাম না। ফলে অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকার্স নামের ভ্রমণ সংস্থার দ্বারস্থ হতে হলো। নির্ধারিত দিনে লাহোর থেকে পর্যটক নিয়ে আসা এই ভ্রমণ দলটি আমাকে ভোর চারটায় ইসলামাবাদ থেকে পিক করল।
বাসে উঠেই ঘুম। হরিপুর-অ্যাবোটাবাদ পার হয়ে মানসেহরা শহরে প্রবেশ করার পর ঘুম ভাঙল। বাস চলছিল ঐতিহাসিক কারাকোরাম হাইওয়ে ধরে। রাতের আঁধার কেটে যাওয়ার পর দেখলাম পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলছি আমরা। দেখতে দেখতেই ব্যাপক তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। নিমেষেই সাদা হয়ে গেল গাছপালা, ঘরবাড়ি সবকিছু। এরপর কিছু দুর যেতেই আটকা পড়লাম। বরফে রাস্তা বন্ধ। হাঁটা শুরু করল সবাই। গন্তব্য মান্ডা গুচ্চা নামক এক গ্রাম। অপরিচিত একদল মানুষের সঙ্গে পথ চলতে চলতে কিছু বাক্যের আদানপ্রদান, অতঃপর পরিচিতি।
মান্ডা গুচ্চাতে নাশতা সেরে ট্রেকিং শুরু হলো। দুইদিনের এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে ট্রেকিং এবং ক্যাম্পিংয়ের সরঞ্জাম নিয়ে যেন যুদ্ধযাত্রায় নামলাম আমরা। সহযোগী হিসেবে যোগ দিলেন পাহাড়ি কিছু পোর্টার। আর মালপত্রবাহী ঘোড়া। ঘণ্টাখানেক পর একটা ঝরনার মুখোমুখি হলাম। তবে হাতমোজা খুলে পানিতে হাত দেওয়ার দুঃসাহস হলো না। ইতিমধ্যে মাইনাস তাপমাত্রা, তার ওপর হাইকিংয়ে অনভ্যস্ততার দরুন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

বরফে ঢাকা পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিংরত লেখক
বরফে ঢাকা পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিংরত লেখক

হালকা বিশ্রামের পর এবার আসল চ্যালেঞ্জের পালা। তুষারপাত আগের মতোই বেগবান। হাঁটু সমান তুষারের মধ্যে দিয়ে আমরা ধীর লয়ে ওপরে উঠছি। আনুমানিক চার ঘণ্টা ট্রেকিংয়ের পর ধোড় নামক এলাকায় পৌঁছাল আমাদের পর্যটক দলটি। এখানেই আমাদের রাত্রিযাপনের জন্য ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো। জায়গাটার সৌন্দর্য সম্পর্কে যতই বলব, কম হবে। বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়ি এলাকায় একটা ছোট্ট সেতু। যেটার ওপাশে ২-৩টা ছোট ঘর। যা গ্রীষ্মকালে রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাড়িঘরের ছাদে বরফের স্তূপ পড়ে আছে।
দলের অগ্রদূত গাইড ও পোর্টাররা মিলে কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালাল। উষ্ণতার খোঁজে আমরা যে যেভাবে ছিলাম সেভাবেই আগুনকে ঘিরে বসলাম। ইতিমধ্যে তাঁবু স্থাপন করা হলো। রান্নাবাড়া অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটল। এদিকে বাইরে তখনো তুষারপাত থামেনি। আবহাওয়া ক্রমান্বয়ে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তুষারপাত মাত্রাতিরিক্ত হলে আমরা আটকা পরে যেতেও পারি এমনটাই ভাষ্য ছিল অনেকের। আনুমানিক মাইনাস ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার সেই রাতে শীতের সঙ্গে লড়াইটা হয়তো কোনো দিনও ভুলব না।

পর্যটক দলের সঙ্গে লেখক
পর্যটক দলের সঙ্গে লেখক

সকালে খুব স্বল্প সময়ের জন্য সূর্য উঁকি দেয়। কিন্তু অবিরাম তুষারপাতের ধারা অব্যাহত থাকে। আমরা প্রায় দুই হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছিলাম তখন। পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল খোড়ি ও গালি নামক এলাকা পার হয়ে মুসা কা মুসাল্লার চূড়ায় আরোহণ করা। কিন্তু অতিরিক্ত তুষারপাতের দরুন রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। গাইড ও পোর্টারেরা সংশয় প্রকাশ করলেন। অবশেষে তাদের কথাই সত্য হলো। কিছু পথ ওপরে উঠতেই দেখি বরফ প্রায় কোমর সমান উচ্চতায় দাঁড়িয়েছে। ফলে আবারও ধোড়ের ক্যাম্পে ফিরে আসতে হলো।
সন্ধ্যার পর আগুন ঘিরে সবাই বসলাম। সবাই নিজ নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। ভ্রমণের আনন্দটা এই অংশে বর্ধিত হয়েছিল বেশ। যখন পরিচয় দিলাম যে আমি বাংলাদেশি। তারা সবাই প্রথমে অবাক। তারপর নিজ নিজ কৌতূহল থেকে নানান প্রশ্ন করল। নিজেকে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছিল তখন। ভ্রমণ সঙ্গীদের প্রায় সবাই ছিল পাঞ্জাবি। ফলে সেই রাতে পেশোয়ারি রুটির বদলে অনেক দিন পর ডাল ভাত দিয়ে ভোজন করার সুযোগ পেলাম।
পরদিন সকালে সূর্য পুরোদমে দেখা দিল। সূর্যের কিরণমালা যখন গাছের ফাঁক গলিয়ে শুভ্র বরফের ওপর প্রতিফলিত হলো, তখন এক নিমেষেই যেন ভ্রমণের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মৃদু শীতল হাওয়া আর সূর্যের মিষ্টি কিরণের সমন্বয়ে যে কাব্যিক পরিবেশ, তাতে কবি হলে নিশ্চয় কোনো কালজয়ী কবিতার জন্ম হতো। সে এক অপরূপ অপূর্ব মুহূর্ত। মনে হচ্ছিল দেখতেই থাকি অনন্তকাল।
পাহাড়ের ঢালে বরফ ভেঙে নিরন্তর পথ চলা আর মাইনাস ঠান্ডায় তাঁবুতে দুই রাত অতিবাহিত করার পর এবার বাড়ি ফেরার পালা। সূর্যোদয়ের ফলে বেশ আরাম লাগছে তখন ট্রেকিং করতে। গন্তব্য সেই মান্ডা গুচ্চা। ফেরার পথে পাহাড়ি শিশুরা আমাদের দেখা মাত্রই কাছে এসে সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তাদের হাস্যোজ্জ্বল স্থিরদৃষ্টি হৃদয়ের গভীরে যেন তুষারের চেয়েও শীতলতর প্রশান্তির অনুভূতি দিল সেই ক্ষণে।
বরফ গলতে শুরু করেছে অনেক জায়গায়। ফলে তেমন বাধা ছাড়াই অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছালাম। বরফে ভিজে ভিজে পা দুটো ফুলে গিয়েছিল। অনভ্যস্ত শরীরেও তীব্র ব্যথা অনুভব করছিলাম। গাড়িতে উঠে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। মনে হচ্ছিল এখন চোখ বন্ধ করলে হয়তো মাসখানেকের আগে আর খুলবে না, এতটাই ক্লান্ত ছিলাম। এভাবেই শেষ হলো জীবনের প্রথম পাহাড়ি রোমাঞ্চের অধ্যায়টি। স্মৃতির পাতায় নিঃসন্দেহে অমলিন হয়ে থাকবে স্নো হাইকিং আর উইন্টার সারভাইভালের এই অসাধারণ অভিজ্ঞতাটি।

রাহিল আরশাদ: শিক্ষার্থী, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পেশোয়ার, পাকিস্তান।