চারুলতা, বাংলা ভাষা ও কিছু ভাবনা

আমার মেয়ে চারুলতা। ওর বয়স দেখতে দেখতে চার বছর হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মেয়েটার জন্ম হলেও নিউইয়র্কের আলো হাওয়াতেই সে মূলত বেড়ে উঠছে। বাবা বলুন অথবা ওর অভিভাবক বলুন, সব সময় আমার অন্তরাত্মায় একটা ভাবনা ওকে ঘিরে ঘোরাফেরা করত। মেয়েটি বড় হয়ে যদি আর বাংলা না বলে? অথবা ইংরেজিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়? অথবা ধীরে ধীরে সে বাংলা ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি থেকে ছিটকে পড়ে? বাবা হিসেবে এসব ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাবে, এই স্বাভাবিক। মেয়ে বলে কথা? তবে বলে রাখি, বাবা-মা হিসেবে মেয়েটার প্রতি আমরা সব সময় যে বিষয়টি নিয়ে খুব সচেতন, তা হলো সে যেন তার নিজের দেশ, সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে না যায়।
আমেরিকা মূলত একটি অভিবাসী দেশ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে আসা অভিবাসীরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের বুকেও নিজ দেশ থেকে নিয়ে আসা ভাষা ও সংস্কৃতির বীজটি ঠিক বুনে দিতে চায়। একজন চায়নিজ, মেক্সিকান, ইতালিয়ান, জাপানিজ, জার্মান, আরব অথবা যেকোনো দেশের মানুষ ইংরেজি ভাষাটা স্কুল বা দপ্তরের ভাষা হিসেবে চালিয়ে নেয় কিন্তু নিজেদের মধ্যে তারা তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকেই লালন-পালন করে। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তারা সবাই দেখভাল করে এ কারণেই যে, যাতে করে তার নিজের ঐতিহ্য ইতিহাসের গহ্বরে পরে হারিয়ে না যায়।
মেয়ে চারুলতার কথায় আবার ফিরে আসি। ওর বয়স যখন দু-তিন বছর, তখন থেকেই সে বাংলা ছড়া, কবিতা, গান রপ্ত করে ফেলেছিল। এ নিয়ে আমাদেরও আহ্লাদের সীমা নেই। মনে মনে বেশ একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। যাক বাবা, আর যা-ই হোক মেয়েটা বাংলা সংস্কৃতির আলো-হাওয়ায় বড় হচ্ছে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে ভুলটা যেন আমাদের ভাঙতে শুরু করেছে। চারুলতা ২০১৮ সালের ১০ মার্চ ঠিক চার বছর বয়সে পা রাখবে। এ বছরের আগস্ট মাসেই তার প্রি-কে স্কুলে যাওয়ার সব রকম আয়োজন শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে অবাক হয়ে লক্ষ করছি, ওর মুখের বাংলা ভাষাকে ইংরেজি ভাষাটা চর দখলের মতো দখল করে নিতে চলেছে। ওর সঙ্গে যখন বাংলায় কথা বলি, ঠিক তখন সে যেন কায়দা করে ইংরেজিতে এর উত্তর দিতে চায় অথবা বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই সে যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বিষয়টা নিয়ে এখন আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাহলে কি চারুলতাও ধীরে ধীরে ইংরেজির দিকে ঝুঁকে পড়বে? বাংলাটা ভুলে যাবে? এসব ভাবনা থেকেই সেদিন মন খারাপ করে কথা বলি নিউইয়র্কে আমার বন্ধু এবং এখানের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব সেমন্তী ওয়াহেদের সঙ্গে। সেমন্তী আমেরিকায় বড় হয়েছে, পড়াশোনা করেছে ঠিকই কিন্তু মনেপ্রাণে সে শতভাগ নিখাদ বাঙালি। বাংলা গান, নাচ, আবৃত্তি, উপস্থাপনা—সবকিছুতেই সে সমান পারদর্শী। সেমন্তী ওয়াহেদ আমার কথা খুব মন দিয়ে শুনে একটা বক্তব্য পেশ করল। ওর কথাগুলো ওর ভাষাতেই বলছি: ‘সব বাবা-মায়ের উচিত তার সন্তানদের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলা। দেখা যায়, অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে অহেতুক ইংরেজিতে কথা বলেন। এটা ভয়ানক রকম ভাবে ছেলেমেয়েদের ক্ষতি করে। তা ছাড়া একটা বাচ্চা পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই চার-পাঁচটা ভাষা একসাথে শিখতে পারে। বরং ছেলেবেলাতেই শিশুকে তার নিজের ভাষাটা শেখানো উচিত। দেখা যায়, বড় হওয়ার পর কোনো বাঙালি শিশু যখন আবিষ্কার করে তার কোনো মেক্সিকান বন্ধু অথবা ইতালিয়ান বন্ধু ঠিক ইংরেজির পাশাপাশি নিজের ভাষাতেও কথা বলতে পারছে, অথচ সে ইংরেজি ছাড়া তার নিজের ভাষা সম্পর্কে কিছুই জানছে না, তখন সে হীনম্মন্যতায় ভোগে। এর জন্য দায়ী বাবা-মা। বাবা-মাকেই তাঁর সন্তানকে গড়ে তুলতে হবে। ঘরোয়া পরিবেশে শিশুদের সাথে অবশ্যই বাংলায় কথা বলা উচিত।’
আমিও সেমন্তী ওয়াহেদের সঙ্গে একমত। ইদানীং চারুলতাকে আমরা এই বিষয়টাই বোঝাতে চেষ্টা করছি যে ইংরেজিতে তুমি অবশ্যই কথা বলবে। তবে ঘরে নয়। তুমি যখন স্কুলে যাবে, তোমার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশবে, তখন তুমি তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলবে। ঘরে বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে বলবে বাংলায়। কারণ, বাংলা আমার ভাষা। এই ভাষা আমার রক্তে বইছে যুগ যুগ ধরে। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। এই ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের অনেক আন্দোলন করতে হয়েছে। এই ভাষার জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাংলাদেশের ভাষা দিবস নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। গোটা পৃথিবীর অহংকার এই বাংলা ভাষা। আমি আমার মেয়ে চারুলতার ছোট আত্মায় এই বীজটিই ধীরে ধীরে বুনে দেওয়ার চেষ্টা করছি। বাংলা ভাষা যেন আমাদের প্রজন্মদের মুখ থেকে বিলুপ্ত হয়ে না পড়ে, যেন হারিয়ে না যায়, সেদিকে আমাদের সবার লক্ষ রাখতে হবে। চারুলতার মতো আমাদের নতুন প্রজন্ম যাতে তাদের রক্তের শিরা-উপশিরায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে অনেক ভালোবাসায় আর গর্বের সঙ্গে লালন করতে পারে, সে জন্য আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলা ভাষা গোটা পৃথিবীতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, এটাই একমাত্র প্রত্যাশা। বাংলা ভাষার জয় হোক।