চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে

রুপালি থালার মতো ‘সুপার মুন’। ছবি: প্রথম আলো
রুপালি থালার মতো ‘সুপার মুন’। ছবি: প্রথম আলো

শীতল হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে অরোরা হিলস। 

যামিনী গভীর। নীরব নিথর চারদিক। এরই মাঝে আকাশের কপালে কে যেন এঁকে দিয়েছে মস্ত বড় এক টিপ। দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে আমি বিভোর হয়ে তাকে দেখি। স্মৃতির ওপার থেকে ভেসে আসে সুর—আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা। আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাই নিচে। দুয়ার খুলে বেরিয়ে এলাম বাইরে।
এসে দাঁড়ালাম বাড়ির পেছন দিকের বাগানে। এই বাগানের গাছগুলো এখন প্রায় পত্রশূন্য। ফল বা হেমন্তের শেষ প্রহর চলছে। শিরশিরে হাওয়ায় ঝরে গেছে ফুল। ফলের লাল সোনালি পাতার আগুনও নিভু নিভু প্রায়। শুধু মাথা উঁচু করে হাসছে চিরসবুজ ঝাউ গাছগুলো।

লেখিকা
লেখিকা

ম্যাপল গাছের শুকনো ডালপালার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। অন্ধকার আকাশের মাঝখানে মস্ত বড় এক চাঁদ। আকাশের দিকে তাক করে আমার হাত ওপরে উঠছে। উঠছে হাতের মুঠোয় সেলফোনটাও। ছোট্ট একটা ক্লিক। ঝাঁপ দিয়ে ‘সুপার মুন’ নেমে এল স্মার্ট ফোনের পর্দায়।
আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে দেখি। শুকনো ডালপালার আড়ালে হাসছে ঝলমলে চাঁদ।
ঘটনাটা আজকের নয়। বেশ কয়েক দিন আগের। সেই যেদিন ‘সুপার মুন’ এসেছিল পৃথিবীর নীলিমায়। চৌদ্দ নভেম্বরের সন্ধ্যায়।
ঘরে ঢুকেই আমি ফেসবুকে চালান করে দিয়েছিলাম ছবিটা। ছবির ওপর ক্যাপশন ছিল, সুপার মুন লাইটস আপ নাইট স্কাই (ফ্রম মাই সুপার কোল্ড ব্যাকইয়ার্ড)।
পোস্ট করতে না করতেই ভার্জিনিয়া থেকে সোমা বোস কমেন্ট করল—বাঁশ বাগানের মাথার ওপর...(আহা! এই সুদূর আমেরিকায় বসেও আমরা বাঁশ বাগানের স্বপ্ন দেখি তাই না সোমা। এরই নাম শিকড়)।
আরেকটা কথা, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর আজও চাঁদ ওঠে ঠিকই কিন্তু শোলক বলা কাজলা দিদিরা হারিয়ে গেছে সেই কবে। শোলক অর্থ কি তাইতো আমরা ভুলে গেছি।
শোলক আর কাজলা দিদির কথা ভাবতে না ভাবতেই দেখি ঢাকার গুলশান থেকে নাসরীন আহমেদ লিখেছে—বাঁশ বাগানের মাথার উপর/ চাঁদ উঠেছে ওই/ এই ঠান্ডায় জমে হিম/ দেখবার সময় কই? (শিলু, তোমাকে চুপি চুপি বলি, আমি আসলেও জমে হিম হয়ে পালিয়ে এসেছিলাম বাগান থেকে। কিন্তু তুমি তা জানলে কেমন করে?)
একটু পরেই উত্তরা থেকে নিলুফার সুলতানা মন্তব্য করল—এখন চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যেতে পারে না, ছাদের কপালে দিয়েই পালিয়ে যায়।
আসলেইতো! ইটের আড়ালে হারিয়ে গেছে ঢাকার আকাশ। যেখানে যেদিকেই তাকাই না কেন চারদিকে শুধু হাইরাইজড বিল্ডিং। চাঁদ দেখার সুযোগ কই! শিশুর কপালে এখন আর কেউ চাঁদের টিপ পরায় না। সে যুগ হয়েছে বাসী। সুযোগও নাই। সময়ও নাই। শেলি, তুমি ঠিকই বলেছ, ছাদের কপালে টিপ দিয়েই তাই পালিয়ে যায় চাঁদ।
তবু ‘সুপার মুন’ বলে কথা।
দীর্ঘ ৬৮ বছর পর সে এসেছে। একে দেখার আনন্দে মেতে উঠেছেন বিশ্ববাসী। নেটের চারধারে ক্ষণে ক্ষণে উপচে পড়ছে চাঁদের ছবি। সঙ্গে আকর্ষণীয় মন্তব্য।
আমার ফেসবুকে দেখি, টরন্টো থেকে চাঁদের আলোয় উচ্ছ্বসিত লীনা চৌধুরী লিখেছে—আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।
তড়িঘড়ি করে ঢাকা থেকে সোনিরা রহমান প্রশ্ন করল—তুই কোন বনে?
চটজলদি লীনার উত্তর—কেন, টরন্টোর বনে।
ওয়াশিংটনে বসে আমি হাসতে হাসতে মরি। দুনিয়াটা কেমন হাতের মুঠোয়। আমরা তিন বান্ধবী পৃথিবীর তিন দেশে। অথচ একই সঙ্গে একে অপরের কথা শুনতে (দেখতে) পাচ্ছি অন্তরজালের পাতায়।
গ্রিসের এথেন্স শহরে শায়লা পারভিন তার ছবির মতো সাজানো বাড়ির ছাদে উঠে লিখলেন, টুক সুপার মুনস পিকচার ফ্রম দ্য সুপার কোল্ড টেরেইস।
ওদিকে আরেক বান্ধবী নাসরীন আহমেদ, ঢাকার আকাশে চাঁদ আসতে না আসতেই ফেসবুকের পাতায় ভাসিয়ে দিল অপূর্ব এক ছবি। ছবির ওপরে শিলুর ক্যাপশন—হোয়াট আ সেটিং টু নাইট।
ওর পোস্টের নিচে জমতে লাগল মজার মজার মন্তব্য।
লন্ডন থেকে নাজলি মোহাম্মদের কমেন্ট এল—চাঁদের বুড়িটাকে দেখতে পেয়েছ? এত কাছে চাঁদ। বুড়িটাকে খুঁজে বের কর।
উত্তরটা দিল শারমীন হুসেইন চট্টগ্রাম থেকে। ও লিখল—ঠিক বলেছ। আমার কাজের মেয়েটা আমাকে একটু আগে ডেকে বলেছে—খালাম্মা, ওই দেখেন, চান্দের বুড়াটা চুপ কইরা বইয়া রইছে। আপনে আসেন যদি দেখেন। হে কত্ত কাছে আইজ।
শারমীনের কমেন্টস পড়তে পড়তে চাঁদের বুড়ির কথা মনে পড়ে গেল।
কত দিন দেখিনি তাকে।
সেই কবে, যেন আরেক জনমে, আকাশে হাত তুলে মা একদিন বলেছিলেন, ওই দেখ, ওই ওখানে চাঁদের বুড়ি বসে বসে চরকা কাটছে।
আমার মা তখন এক সুদর্শনা তরুণী।
মায়ের কথা শুনে চাঁদের বুড়িটাকে শুরু হলো খোঁজা। বেশ অনেক কয়েকটা বছর জুড়েই খুঁজেছি। খুব সহজে পেয়েও যেতাম তাকে।
না পাওয়ার কারণও নেই। তখন আমাদের কচিকাঁচা জীবন। কল্পনার রাঙা ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া বয়স! ছোট্ট মনে বাস্তব আর স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার।
মেঘে মেঘে বেলা হলো। কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম। পেরিয়ে এলাম সাত সমুদ্র তেরো নদী।
এইমাত্র আমি আমার ছয় বছরের নাতনিকে জানালা দিয়ে চাঁদ দেখাতে দেখাতে বললাম—জান সামারা, চাঁদের ভেতরে না একটা বুড়ি বসে থাকে। সে না বসে বসে...।
ছোট্ট সামারা প্রশ্ন করল, বুড়ি কি?
আমি বললাম, ওল্ড ওম্যান।
সামারা বলল, বাট ও ওইখানে লিভ করতে পারবে না।
আমি বললাম, কেন পারবে না?
সামারা বলল, ওইখানে এয়ার নাই।
ঠিক এই রকম বেকুব বনে যাওয়া অবস্থায় সিলেটী ভাষায় একটা মজার স্বগতোক্তি করা হয়—খাইলায়নি!
আমি মনে মনে নিজেকেই বলি—খাইলায়নি?
কে জানত চুপিসারে পাল্টে গেছে যুগের হিসাব!