চাঁদের বুড়ি

সোসাইটিতে আর মুখ দেখাতে পারব না। যত্তসব!
—কি হয়েছে মিলা? এত সকালে কে ফোন করেছে?
—কেউ না! মিলা ক্ষোভে ফেটে পড়ছে! বাবুন সোনা তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করো, আমরা এখনই বের হব! বুয়া বাবুর টিফিন বক্স রেডি করেছ?
হুইল চেয়ারটা ঠেলে ফয়সাল মিলার মুখোমুখি এসে থামল।
—তোমাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করছিলাম মিলা!
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মিলা ফয়সালকে জিজ্ঞেস করল, কি?
—কে ফোন করেছে? আর তুমি কার সাথে কথা বলে এত ক্ষেপে গেলে? কি হয়েছে?
—আশ্চর্য! দেখছ আমি কত বিজি আর তুমি আছ কে ফোন করেছে তা নিয়ে। আছ তো বাসায় বসে, কি আর বুঝবে! তোমার বিজনেস, সংসার, বাচ্চা, আমার সমিতি সব মিলিয়ে আমার বেহাল অবস্থা!
মিলার কথাটা যেন বুকের বাম পাশে বড় একটা আঘাত করে বসল। আসলেই তো মিলার ওপর অনেক বেশি দায়িত্ব এসে ভর করে বসেছে। আজ তিনটি মাস অ্যাক্সিডেন্ট করে ঘরে বসা। এ পা হয়তো আর কোনো দিন ভালো হবে না! মিলা একাই এখন সব সামলাচ্ছে। ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!
ফয়সাল আর কিছু বলল না। নীরবে নিজের রুমের দিকে হুইল চেয়ার নিয়ে রওনা দিল।
কিছুক্ষণ পর মিলা রুমে এল।
—সরি ফয়সাল, আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি। তুমি কষ্ট পেয়েছ। আসলে এত কাজের চাপে আমার মাথা ঠিক নেই।
—না, না ঠিক আছে মিলা। আমি সব বুঝি।
—বুয়া সাহেবের ব্রেকফাস্ট রুমে দিয়ে যাও আর ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বের করতে। আমি যাচ্ছি! তুমি নিজের খেয়াল রেখো। টাইমলি ওষুধ খেয়ো। বাবুন সোনা। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। হারি আপ।
মিলা আর বাবুন চলে যাওয়ার পর পুরো ফ্ল্যাটটা যেন খাঁ খাঁ করতে থাকে। কিছুই ভালো লাগে না ফয়সালের। এতটা নিঃসঙ্গ, একাকী জীবন যেন কিছুতেই তাল মেলাত পারছে না ফয়সালের সঙ্গে।
কেন যে এত বড় ফ্ল্যাট নিতে গেলাম! এখন এই বিশাল ফ্ল্যাটে নিজেকে আরও বেশি অসহায় মনে হচ্ছে।
ফয়সাল হুইল চেয়ার ঠেলে একটা বদ্ধ রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় হাত দিতে গিয়েও পারল না। কোথায় যেন বাঁধল। বিবেকের চোখকে ফাঁকি দিতে খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করল ফয়সাল।
—আপনাদের কি কোনো রেসপনসিবিলিটি নেই? একটা জলজ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে গেল আর কেউ টের পেলেন না?
মিলা নিজের রাগকে কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারছে না। ইচ্ছে হচ্ছে হাতের মুঠোফোনটা এক আছাড়ে ভেঙে ফেলতে।
—আসব ম্যাডাম?
দরজার বাইরে থেকে রায়হান সাহেব হাতে কিছু ফাইল নিয়ে মিলার কাছে ভেতরে আসার অনুমতি চাইল।
রায়হান সাহেবের দিকে মিলা এক পলক তাকিয়ে তাকে ভেতরে আসতে বলে আবার ফোনে মনোনিবেশ করল।
—দেখুন আমি কোনো এক্সকিউজ শোনার জন্য ফোন দিইনি। আপনাদের দায়িত্বহীনতার জন্যই আজ এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। যাই হোক, আমার মনে হয় বিষয়টা থানায় জানানো উচিত। আমি আবার পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। উনি যদি ফিরে আসেন অবশ্যই জানাবেন।
—ম্যাডাম কোনো প্রবলেম?
রায়হান সাহেবকে এই মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না। যদিও তিনি অনেক বিশ্বস্ত কর্মচারী কিন্তু ব্যাপারটা পারিবারিক।
—তেমন কিছু না রায়হান সাহেব। ফাইলগুলো রেডি করেছেন?
—জি ম্যাডাম। আজ ক্লায়েন্টদের সঙ্গে মিটিং আছে।
—হুমম।
—ম্যাডাম, স্যার এখন কেমন আছেন?
খুব অসহায়ের মতো রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মিলা বলল, আগের মতোই।
—বুয়া বাবুন কি ফিরেছে?
—না খালু। মনে হয় রাস্তায় জাম।
বাবুন বাসায় থাকলে এতটা একা লাগে না। সময়টা কেন যে এত দীর্ঘ! পুরুষ মানুষের জন্য বাসায় থাকা আর জেলখানায় থাকা একই কথা। ফয়সালের প্রতিটা মুহূর্ত এখন অসহ্য লাগে।
—খালু টেবিলে খাবার দিছি।
—তুমি জানো না আমি দুপুরে বাবুনকে নিয়ে খাই। ও আসুক তারপর খাব।
একটু পরেই কলিং বেল বেজে উঠল। বাইরে থেকেই বাবুনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
—বুয়া তাড়াতাড়ি গেট খোল। আমার বাবুন সোনা এসেছে।
ফয়সাল ছোট শিশুর মতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে হুইলচেয়ার নিয়ে গেটের কাছে চলে এল।
—বাবা!
ফয়সালকে দেখেই বাবুন খুশিতে চিৎকার করে উঠল।
ফয়সাল ছেলেকে এত খুশি দেখে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? বাবুনকে খুব এক্সাইটেড মনে হচ্ছে।
—হুমম বাবা...কাল থেকে সামার ভ্যাকেশন শুরু।
ইয়ে...বাবা-ছেলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।
ফয়সাল বাবুনকে কোলে নিয়ে বলল, আমরা দুজন একসঙ্গে অনেক মজা করব।
—হুমম বাবা আমরা সারা দিন শুধু খেলব আর খেলব।
ফয়সাল ছেলের দিকে মৃদু হেসে বলল, না বাবা শুধু খেলা না, পড়াও হবে। আমি প্রতিদিন তোমাকে পড়াব।
—সত্যি বাবা?
—হুমম সত্যি।

—তাহলে খুব ভালো হবে। তুমি এখন যেমন আছ সারা জীবন তেমনই থেকো। আগে শুধু অফিসে চলে যেতে। আমার সঙ্গে খেলতে না, পড়াতে না। এখন তুমি আমার বন্ধু হয়ে গেছ, সে জন্য তোমার হুইল চেয়ারটাকে অনেক অনেক থ্যাঙ্কস।
বাবুনের কথায় হঠাৎ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল ফয়সালের। নিজের অক্ষম পায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের কোণে দুফোঁটা জল চলে এল। আসলেই তো ছেলেটাকে তো কখনো সময় দেওয়া হয়নি। এই তিন মাসে সে একটু একটু করে নিজের সন্তানকে চিনেছে।
—খালুজান, বাবুন সোনারে নিয়া খাইতে আসেন।
খাবার টেবিলে বাবা-ছেলে পাশাপাশি বসা। বাবুনের কাজ হচ্ছে খেতে বসে বাবাকে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করা যেন ওর বেশি খেতে না হয়। বাবুনের সবকিছু ভালো লাগে শুধু খেতে ভালো লাগে না।
—আচ্ছা বাবা তোমরা বাসার সবাই আমাকে বাবুন ডাকো কেন? আমার নাম তো অভ্র।
—তুমি যে আমাদের অনেক আদরের বাবু তাই তোমাকে আমরা আদর করে বাবুন সোনা ডাকি। কেন তোমার ভালো লাগে না?
—ভালো লাগে কিন্তু এখন আমি বড় হচ্ছি না? আর কতকাল বাবু থাকব?
বাবুনের কথায় হো হো করে হেসে উঠল ফয়সাল। ওরে আমার বড় ছেলেটারে। খাবার মুখে দিয়ে খুব বিরক্ত হয়ে ফয়সাল বুয়াকে ডাক দিল।
—বুয়া তরকারিতে এত তেল দিয়েছ কেন? তোমার রান্নার আর উন্নতি হলো না। তোমাকে না বলেছি রান্নার জন্য একটা বুয়া দেখতে?
—খালুজান রান্নার সময় আমি তাল পাই না। বয়স হইছে তাই সব ওলট-পালট হইয়া যায়। একজন বুড়া মহিলা কাম করার জন্য অনেক ধরছে। আমাগো দারোয়ানের খালা লাগে। গেরাম থেইক্কা আইছে।
—তাই নাকি? রেখে দাও। তোমার রান্না আর খাওয়া যাচ্ছে না। সারা দিন অফিস করে এসে মিলারও কি এসব ভালো লাগে?
—ঠিক আছে খালু, আমি আইজি কইতাছি।
দুই ঘণ্টা জ্যামে আটকে থেকে ভীষণ ক্লান্ত মিলা। চারিদিক থেকে এত চাপ! কোন অভিশাপে ফয়সাল আজ পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে? অভিশাপ! শব্দটা নিজের কানেই যেন ঢং ঢং করে বেজে উঠল। ক্লান্ত দুটি চোখ অপলক পথের দিকে চেয়ে আছে। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। মিলা দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছাড়ল। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল ফয়সাল। মিলা অবাক হয়ে গেল।
—কি ব্যাপার? তুমি গেটের কাছেই ছিলে নাকি? আসার সঙ্গে সঙ্গে খুলে দিলে?
মিলার জন্য ফয়সাল এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল কিন্তু কিছুই বলল না। শুধু জানতে চাইল, আজ এত দেরি হলো যে?
—আর বলো না প্রচুর জ্যাম। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বুয়া এক কাপ চা দিয়ে যাও। বাবুন সোনা কোথায়?
—কোথায় আবার? কাল থেকে সামার ভ্যাকেশন, তাই আজ শুধু খেলা আর খেলা।
রাত দশটা। আজকের খাবারের টেবিলটা সেজেছে ভিন্ন আমেজে। নানা পদের বাহারী খাবার! টেবিলে এত খাবারের আয়োজন দেখে ফয়সালের চোখ কপালে।
—আরে? আজ কি কোনো উৎসব? এত আয়োজন? বুয়া করেছ কি?
বুয়া হাসতে হাসতে বলল, আর বইলেন না, নতুন বুয়ারে কইলাম রাতের জন্য রানতে হইব। খালুজান আমার রান্না খাইয়া সেই রকম বিরক্ত। সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের আয়োজন শুরু কইরা দিল...।
মিলা বুয়ার কথায় খুব অবাক হয়ে গেল—নতুন বুয়া?
উত্তরটা ফয়সালই দিয়ে দিল।
—আমি বলেছিলাম। তাই বলে এটা ভাবিনি যে, এত তাড়াতাড়ি বুয়া পেয়ে যাব। যাই হোক, খাওয়া শুরু করো।
মিলা প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিল তাই আর কথা বাড়াল না।
-বাবুন তুমি কি নিজের হাতে খাবে না মা খাইয়ে দেব?
-নিজের হাতে খাব। আই অ্যাম এ বিগ বয়!
খাবার মুখে দিয়েই ফয়সাল মুগ্ধ হয়ে গেল।
-আরে অসাধারণ! অনেক দিন পর এমন সুস্বাদু খাবার খেলাম। গরুর মাংসের ভুনাটা দেখেছ মিলা কি চমৎকার হয়েছে? আর চিংড়ির দোপিঁয়াজা! স্বাদটা খুব চেনা, খুব আপন আপন লাগছে প্রতিটি খাবারের ঘ্রাণকে। ঠিক যেন আমার...।
-ওহ্ ফয়সাল! খাবার সময় এত কথা না বলে চুপচাপ খাওতো। সব তরকারি অনেক মজা হয়েছে। বাবুন খেতে পারছ তো!
-চিকেন কারিটা অনেক ইয়াম্মি...মামনি আমি আর একটা লেগপিস খাব।
-অবশ্যই খাবে বাবা...বলেই মিলা ছেলের প্লেটে আরেকটি লেগপিস তুলে দিল।
মিলা খুব আগ্রহের সঙ্গে বুয়াকে বলল, তো নতুন বুয়াকে ডাকো। অনেক দিন পর ভালো কিছু খেলাম!
-খালাম্মা হে তো চইলা গেছে। দারোয়ানের খালা লাগে। হে খালি আইসা রাইন্দা দিয়া যাইব।

-অনেক রাত হয়ে গেছে বাবুন সোনা! এবার ঘুমাও।
মিলা বিছানায় শুয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারাচ্ছে আর পাশেই বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে ফয়সাল বসে আছে। মনে মনে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে আর একটু পর পর ডান হাতটা নাকের কাছে এনে শুঁকছে। বিষয়টা মিলা এতক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল, এখন আর চুপ থাকতে পারল না।
-কি হয়েছে তোমার? কখন থেকে দেখছি তুমি বারবার হাত নাকের কাছে নিয়ে শুঁকছ? এনিথিং রং?
ফয়সাল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ইতস্তত করে বলল, না মানে! নতুন বুয়ার রান্নার হাত অসাধারণ!
মিলা উত্তেজিত হয়ে গেল, রান্না অসাধারণ বলে তুমি এমন ছেলেমানুষী শুরু করবে? আশ্চর্য!
-ছেলেমানুষীর কি দেখলে, আসলে ঘ্রাণটা...।
-জানো আম্মু? আজ আমি চাঁদের বুড়ির গল্প শুনেছি।
বাবুনের কথায় ফয়সাল আর নিজের কথাটা শেষ করতে পারল না। চুপ হয়ে গেল।
মিলা বাবুনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল। যে ছেলে সারা দিন কার্টুন দেখে সে চাঁদের বুড়ির গল্প শুনেছে?
-তাই নাকি? বাবা চাঁদের বুড়ির গল্প শুনিয়েছে? মিলা কৌতূহল নিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করল।
বাবুন ফিক করে হেসে দিল!
-বাবা গল্প বলতে পারে নাকি? ওই যে আজকে ইয়াম্মি ফুডগুলো যিনি রান্না করেছেন, উনি।
-নতুন বুয়া? সে কখন তোমাকে গল্প শোনাল?
-দুপুরে বাবা যখন ঘুমাচ্ছিল তখন। গল্প শুনতে শুনতে আমি কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম...।
ফয়সালের দিনগুলো এখন ভালোই কাটে। গেল তিন মাস বাসাটাকে জেলখানা মনে হতো। এখন আর তেমনটা মনে হয় না। বাবুনের ছুটি থাকার কারণে এখন আর নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় না। দুজনে হেসে-খেলে দিব্যি সারা দিন কাটিয়ে দেয়। খাবার সময় এখন আর বাবুন কোনো ঝামেলা করে না। নতুন বুয়ার মজার মজার রান্না খেয়ে বাবা-ছেলে মহা খুশি! বাবুন এখন আর কার্টুন দেখে না। প্রতিদিন বুয়ার কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। সে নতুন বুয়ার নাম দিয়েছে চাঁদের বুড়ি।
আসলেই নতুন বুয়াকে বুয়া ডাকতে ইচ্ছে হয় না। চাঁদের বুড়িই ঠিক আছে। মানুষটাকে সামনা-সামনি খুব দেখতে ইচ্ছে করে ফয়সালের। কিন্তু মহিলা এতই পর্দাশীল যে তার ছায়াটাও ফয়সাল দেখে না। মিলা আসার আগেই সে চলে যায় তাই মিলাও দেখেনি।
উহ্ পনেরোটা দিন আমার ওপর যা গেল! ছুটির দিনেও অফিস করেছি। সোফার ওপর বসে ফ্যানের দিকে মুখ করে দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল মিলা। পাশে ফয়সাল বসে ক্লান্ত মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে। এ কদিনের ধকলে মিলা বেশ শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচেও কালি পড়ে গেছে। মিলার দিকে তাকালে ফয়সালের নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়।
-এই নেন খালাম্মা ঠান্ডা পানি।
রহিমার মা মুখ গোমড়া করে গ্লাসটা মিলাকে এগিয়ে দিল।
-কি হয়েছে বুয়া?
-কি আর হইব? আমার তো এখন কোনো পাত্তা নাই। নতুন বুয়াই সব! আমি তাহলে চইলা যাই।
-চইলা যাই মানে?
মিলা হতবাক হয়ে গেল।
রহিমার মা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, যেই বুয়া আপনাদের চাঁদের বুড়ি হইছে, সেই বুয়া আসলে একটা দুশ্চরিত্রা। সে দুপুরবেলা আইসা রান্ধে আর খালি আপনাদের বেডরুমে উঁকি মারে। খালুজান ঘুমায় থাকে। হেই বদমাইশ বেটি খালুজানের মুখের দিকে চাইয়া থাকে। আমি অনেক দিন দেখছি কিন্তু বলার সাহস পাই নাই। দেখেন কোনো দিন আপনাদের জিনিসপত্র চুরি কইরা পালায়!
ফয়সাল এবার ক্ষেপে গেল। কি বলছ যা তা? মহিলাকে মোটেও আমার এমন মনে হয় না।
মিলা কিছু বুঝতে পারছে না। এত বছরের পুরোনো বুয়া কি মিথ্যা বলবে?
মিলা শান্ত স্বরে বলল, ঠিক আছে যাও বুয়াকে ডেকে নিয়ে আসো। তাকেই জিজ্ঞেস করি।
ফয়সালের ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। চাঁদের বুডির এত প্রশংসা করা হয় বলেই রহিমার মা হিংসায় এমন করছে।
ফয়সাল কিছুটা বিরক্ত হয়ে রহিমার মা কে বলল, যাও তো বুয়া! পরে দেখা যাবে!
রাত ১১টা। মিলা ওয়াশ রুম থেকে এসে সারা রুমে কিছু খুঁজছে।
মিলাকে এভাবে ছোটাছুটি করতে দেখে ফয়সাল জিজ্ঞেস করল, কি খুঁজছ মিলা?
-আর বলো না! আমার বিয়ের আংটিটা কোথাও পাচ্ছি না।
-কোথায় রেখেছিলে মিলা?
-ড্রেসিং টেবিলে। সকালে রেখেছিলাম। এখন দেখি নাই।
-কি বলো? ভালো করে খুঁজে দেখো!
মিলা নিরাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ল।
-ভালো করে খুঁজেছি ফয়সাল। কোথাও নেই! বুয়া? এই বুয়া?
মিলার চিৎকারে রহিমার মা দৌড়ে এল।
-কি হইছে খালাম্মা?
-বুয়া আমার আংটিটা পাচ্ছি না। দেখেছ কোথাও?
-না তো খালাম্মা! আমি এখনই খুঁজতাছি!
রহিমার মা পুরো বাসা তছনছ করে খুঁজে না পেয়ে মিলার কাছে এল।
-খালাম্মা। কোথাও পাইলাম না! আমার মনে হয় হেই বুয়ারে জিগাইলে আসল কথা বাইর হইব। হ্ আজকে তাড়াতাড়ি রাইন্দা চইল্লা গেছে...।
মিলা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গেল! এ বাসা থেকে এর আগে কখনো কিছু হারায়নি। এটা হয়তো ওই চাঁদের বুড়ির কাজ।
-যাও ডেকে নিয়ে আসো তাকে।
মিলার নির্দেশে রহিমার মা এক দৌড়ে বৃদ্ধাকে ডেকে নিয়ে এল।
ফয়সাল যে চাঁদের বুড়িকে এক নজর দেখার জন্য ছটফট করত সে আজ সামনে কিন্তু আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।
বৃদ্ধা লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
মিলা কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চাঁদের বুড়ির দিকে। বাবুনের আবদারের জন্য নতুন বুয়াকে তারা চাঁদের বুড়ি ডেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
মিলা গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমার বিয়ের আংটিটা দেখেছেন?
বৃদ্ধা না সূচক মাথা নাড়ল।
মিলা আবারও জিজ্ঞেস করল, দেখেছেন?
বৃদ্ধা একইভাবে মাথা নাড়লেন।
রহিমার মা চিৎকার করে বলল, চোর কি কখনো চুরি কইরা স্বীকার যায়? আমি হের ব্যাগ লইয়া আইছি। খুললেই সব বোঝা যাইব!
হুইল চেয়ারে বসে ফয়সাল নিশ্চুপ দর্শক! আজ আর কিছু বলার ভাষা সে খুঁজে পাচ্ছে না।
যেই রহিমার মা ব্যাগটা খুলতে যাবে অমনি বৃদ্ধা এক ঝটকায় রহিমার মার হাত থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিলেন।
রহিমার মা ক্ষেপে গেল।
-দেখছেন খালাম্মা?
মিলার কাছে বিষয়টা ভালো লাগল না। সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো।
-ব্যাগটা আমার কাছে দিন।
বৃদ্ধা ব্যাগটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।
মিলা এবারে চিৎকার করে বলে উঠল, দিন বলছি!
বৃদ্ধা আর না করতে পারল না।
রহিমার মা বৃদ্ধার হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিল। ঝটপট ব্যাগটা খুলে ফেলল।
ব্যাগ খোলার পর মিলা আর ফয়সাল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
ব্যাগের ভেতর থেকে পরনের কিছু কাপড়ের নিচ থেকে বেরিয়ে এল বাবুনের কিছু খেলনা, একটি গেঞ্জি আর একটি প্যান্ট।
প্রচণ্ড আক্রোশে মিলার ঠোঁট দুটো কাঁপছে! এ মহিলা সত্যি চোর!
-চাঁদের বুড়ি...তুমি?
ফয়সালের বিশ্বাস হচ্ছে না। কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে?
রহিমার মা এবার গর্বের সঙ্গে বলতে লাগল, দ্যাখছেন...কাঙ্গালির কথা বাসী হইলেও ফলে...হে একটা চোর...।
মিলা এবার জিজ্ঞেস করল, আংটিটা কোথায়?
বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি নেই নাই!
রহিমার মা এবারে দৌড়ে এসে বৃদ্ধাকে এক ধাক্কা মারল।
-চোর কোথাকার!
রহিমার মার ধাক্কাটা এত জোরে ছিল যে বৃদ্ধা নিজেকে আর সামলাতে পারেননি। ছিটকে টেবিলের ওপর পড়ে গেলেন।
ফসয়ালের সেই মুহূর্তে কি যে হলো, ফয়সাল নিজেও জানে না। মনে হলো, নিজের জীবন দিয়ে হলেও বৃদ্ধাকে ধরতে হবে। তা না হলে কাচের টেবিলে উনি অনেক বড় আঘাত পাবেন। ফয়সাল নিজের অজান্তেই এক ঝটকায় হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। দৌড়ে গিয়ে মহিলাকে পেছন থেকে ধরে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। বৃদ্ধার কপাল ফেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।
মিলা যেন ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল!
সমস্ত ক্রোধ মুহূর্তে পানি হয়ে গেল। মিলার চোখে বিস্ময় আর আনন্দ অশ্রু। যে ফয়সাল এত দিন ধরে হাঁটতে পারছে না, সে আজ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েছে?
-ফয়সাল, তুমি হাঁটতে পারছ?
ফয়সাল বৃদ্ধাকে টেনে তুলে দাঁড়াল। বৃদ্ধার চোখের জল আর রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় এসে পড়ছে ফয়সালের হাতের ওপরে। তবুও বৃদ্ধা এক মুহূর্তের জন্য নিজের ঘোমটা সরাননি।
ফয়সাল মহিলাকে কি বলবে বুঝতে পারছে না। একজন পর্দাশীল নারীকে সে ঘোমটার আড়ালে আনতে পারে না। রেগে গিয়ে রহিমার মাকে বলল, তোমার এত বড় সাহস, আমি সামনে থাকতে তুমি একজন বুড়ো মহিলাকে এভাবে ধাক্কা মারলে?
রহিমার মা কাঁপতে কাঁপতে বলল, হে তো চোর!
ফয়সাল এবার আরও উত্তেজিত হয়ে গেল।
-চুপ, একদম চুপ, সে কি নিয়েছে? লাখ লাখ টাকা? বাচ্চার দুটো খেলনা আর একটা করে জামা-প্যান্ট। হয়তো তার নাতির জন্য নিয়েছে! আমার কি টাকার অভাব?
মিলা শান্ত স্বরে বৃদ্ধাকে বলল, আপনার এগুলো লাগলে আমাকে বলতেন, আমি আপনাকে আরও দিতাম। কাউকে কিছু না বলে নেওয়া চুরির পর্যায়ে পড়ে। যাই হোক, আজকের ঘটনার জন্য আমার স্বামী তার পঙ্গুত্ব জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাই আপনাকে আমি ক্ষমা করলাম। আর আংটিটা যদি আপনি নিয়ে থাকেন, সেটা আপনার কাছেই রেখে দেন। আমি অনেক মূল্যবান সম্পদ ফিরে পেয়েছি।
ফয়সাল রহিমার মাকে বলল, ওনাকে নিচে ডিসপেনসারি নিয়ে যাও। ব্যান্ডেজ করে আনো।
এতসব ঘটনার কিছুই টের পায়নি বাবুন। অঘোরে ঘুমাচ্ছিলো সে। কিন্তু এ পর্যায়ে এত হইচইয়ে সে উঠে এসেছে।
চোখ কচলাতে কচলাতে ফয়সালকে দেখে এক চিৎকার-বাবা? তুমি দাঁড়াতে পারছ?
ফয়সালের দুই চোখ বেয়ে টপ করে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। দুই হাত বাড়িয়ে দিল বাবুনের দিকে। বাবুন দৌড়ে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মিলাও ফয়সালকে জড়িয়ে ধরল। এ যে অনেক আনন্দের দিন...ফিরে পাওয়ার দিন।
ভোরের আলোয় ঝলমল করছে ফয়সালদের বারান্দা। ফয়সালের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে মিলা।
-মিলা আজ যে আমার কি ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি।
মিলা ফয়সালের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, আমারও ভীষণ ভালো লাগছে।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল।
মিলা এক পা এগোতেই ফয়সাল থামিয়ে দিল।
-আমি খুলছি!
দরজা খুলতেই দেখে দারোয়ান বশির দাঁড়িয়ে।
-কি বশির গ্রাম থেকে চলে এসেছ?
বশির কোনো কথার উত্তর দিল না। এমনকি ফয়সাল যে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাতেও সে অবাক হলো না। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, রহিমার মা কই?
মিলার সঙ্গে সঙ্গে রহিমার মা এসে দাঁড়াল।
বশির রাগে কটমট করতে করতে রহিমার মাকে বলল, তুই যদি আমার বড় না হইতি, তাইলে তোরে চড়ায় দাঁত ফালায় দিতাম।
ফয়সাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি বলছ এসব?
বশির এবার ফয়সালের হাতে একটা চিঠি আর ছোট একটা বাক্স দিয়ে বলল, ছোট মুখে একটা বড় কথা কই স্যার? আপনে কি মায়ের প্যাটে হন নাই? আমরা তো এক শ হাত দূরে থাকলেও মায়ের গন্ধ ট্যার পাই! আপনাগো মতো বড়লোকদের মনে হয় নাকে গন্ধও নাই।
চোখ মুছতে মুছতে বশির চলে গেল।
বশির কি বলল? ফয়সালের হাত কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলল...
খোকা,
আমি তোর হতভাগী মা! বিশ্বাস কর খোকা আমি তোর বউয়ের আংটি চুরি করিনি। আমি চোর না। সেই পাঁচ বছর আগে তোরা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলি। আমি না হয় রাগ করেই তোকে কসম দিয়েছিলাম, আর কোনো দিন আমার মুখ দেখতে আসবি না! তাই বলে সত্যিই তুই মার ওপর অভিমান করে বসে থাকবি? প্রতি মাসে আমার নামে টাকা পাঠাতি কিন্তু একবারের জন্য আমার খোঁজ নিতি না। একটি বার দেখাও করতি না। বৃদ্ধাশ্রমে আমার দমবন্ধ হয়ে আসত। শুধু তোর কথা মনে পড়তরে খোকা! তোকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম অনেক বড় বিদ্বান হতে। কিন্তু একবারো ভাবিনি তোর মতো এত বড় বিদ্বানের বাড়িতে আমার একটু ঠাঁই হবে না!
বউমার যখন ছেলে হলো, বশির আমাকে ফোনে জানাল। জানিস খোকা! কী যে খুশি হয়েছিলাম! বৃদ্ধাশ্রমের সবাইকে পায়েস রান্না করে খাইয়েছি। কত স্বপ্ন ছিল নাতিটাকে কোলে নেব, ওর সঙ্গে খেলব কিন্তু তা আর হলো কই? কিছুদিন আগে তোর বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম। তোর বাবা ভীষণ একারে খোকা! আমাকে স্বপ্নে বলল, ‘ফয়সালের মা আমার আর একা একা ভালো লাগে না, "তুমি চলে আসো।’ বিশ্বাস কর বাবা! আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। আমি আর পারছিলাম না তোদের থেকে দূরে থাকতে। কত রাত যে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি! যেদিন বশির ফোন করে জানাল তুই অ্যাক্সিডেন্ট করেছিস, হাঁটতে পারছিস না। তখন আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। বশিরের সাথে যোগাযোগ করে বৃদ্ধাশ্রম থেকে পালিয়ে চলে আসি। ওর কাছেই জানতে পারি, তোর বাসায় রান্নার বুয়া খুঁজছিস। তোর ছোট্ট সুখের সংসার দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার নাতি সোনাকে দুই চোখ ভরে দেখেছি। ওকে গল্প শোনাতে পেরেছি। তুই যখন দুপুরবেলা ঘুমাতি তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোকে দেখতাম। প্রতিদিন নামাজের বিছানায় বসে কাঁদতাম, আল্লাহ যেন তোকে ভালো করে দেন। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। তোর ছেলের কিছু খেলনা আর জামা-প্যান্ট লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি যখন তোদের থেকে অনেক দূরে চলে যাব, তখন আমার ছোট্ট সোনার কিছু স্মৃতি যেন আমাকে আগের মতো নিঃসঙ্গ করতে না পারে! আর খোকা, তোদেরকে না জানিয়ে আর একটা জিনিস আমি নিয়েছি। ড্রয়িংরুমে রাখা তোর, বাবুন আর বউ মার ছবিটা!
ভেজা চোখে ফয়সাল সোফার পাশে ছোট্ট টেবিলে রাখা ছবিশূন্য ফ্রেমটা দেখতে পেল।
‘বউ মা বলেছে, না জানিয়ে কিছু নিলে চুরি হয়। আমি বাবা তোদের স্মৃতিটা চুরি করে নিয়ে গেলাম। পারিস তো আমায় ক্ষমা করে দিস! আমি তোদের সংসার দেখতে এসেছিলাম। দুচোখ ভরে দেখে গেলাম! তোকে কথা দিলাম, আর কোনো দিন তোদের জ্বালাতে আসব না! বাবুন সোনা যদি এই হতভাগী চাঁদের বুড়ির খোঁজ করে, বলিস, চাঁদের বুড়ি চাঁদের দেশে চলে গেছে। বাক্সটার মধ্যে আমার কিছু গয়না আছে, বউ মাকে দিস। তোরা ভালো থাকিস! আমি জানিরে খোকা, তুই এখন কাঁদছিস! কাঁদিস না বাবা! আমি দূর থেকে তোদের জন্য দোয়া করব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোদের ছবিটা বুকের মধ্যে নিয়েই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। আর লিখতে পারছি না রে...ভালো থাকিস।
ইতি,
চাঁদের বুড়ি’
চিঠিটা হাতে নিয়েই ফয়সাল ফ্লোরে বসে পড়ল। এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে মিলাও চিঠিটা পড়েছে। কিছু বলার ভাষা নেই মিলার কাছে। ফয়সাল চিৎকার করে কেঁদে উঠল, মা আমি তোমার কেমন অধম ছেলে? এত কাছে পেয়েও তোমাকে চিনতে পারলাম না! যে মায়ের রান্না খেয়ে এত বড় হয়েছি, সেই চিরচেনা স্বাদ পেয়েও বুঝলাম না, আমার মমতাময়ী মা আমার জন্য রান্না করেছে। মা আমাকে ক্ষমা করো! বিশ্বাস করো মা, তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার পর একটি রাতও আমি শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি। অনুশোচনা আমায় তিলে তিলে দগ্ধ করেছে! আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েছি মা। সৃষ্টিকর্তা আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছিলেন। তুমি সেই পাপীর জন্য দোয়া করে আবার তার পাগুলো ফিরিয়ে দিলে?
মিলা কাঁদতে কাঁদতে ফয়সালের কাঁধে হাত রেখে বলল, ফয়সাল আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে একটা বিষয় গোপন করেছিলাম। সেদিন তুমি যখন জানতে চেয়েছিলে কে ফোন করেছে? আমি তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। আসলে তোমাকে টেনশনে ফেলতে চাইনি। আমি সব সময় বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের খোঁজ নিতাম। মা হওয়ার পর আমি বুঝতে পেরেছি মাতৃত্ব কি? নিজের বিবেকের কাছে একেবারে ছোট হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু লজ্জায় মার মুখোমুখি হতে পারিনি। আমি ওনাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন হঠাৎ বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন এল। ওরা জানাল মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। খবরটা শুনে মাথাটাই নষ্ট হয়ে গেল। তুমি এমনিতেই অসুস্থ তার ওপর যদি মায়ের নিখোঁজ হওয়ার খবরটা জানাই, তুমি আরও ভেঙে পড়বে। এ কদিন পাগলের মতো মাকে খুঁজেছি। মা যে আমাদেরই মাঝে ছিল, ঘুণাক্ষরেও টের পেলাম না! মা আমাকে ক্ষমা করে দিন!
গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ফয়সাল কাঁদছে, মা এখন আমি তোমাকে কোথায় খুঁজব?
হঠাৎ রহিমার মা ফয়সালের দু পা জড়িয়ে ধরল-খালুজান আমারে মাফ কইরা দেন। আংটিটা আমি লুকাইছিলাম। আমি কোনো দিন আপনাগো বাসার কিছু চুরি করি নাই। আপনারা সবাই যখন চাঁদের বুড়ির এত সুনাম করতেন, আমার সহ্য হইত না! আমি হিংসা করতাম হেরে। আমি কি জানতাম হে আপনার মা? আমি তো হেরে তাড়ানোর জন্য এত মিথ্যা নাটক সাজাইছি। আমারে মাফ কইরা দেন!
মিলা রাগে, ক্ষোভে নিজেকে আর সামলাতে পারল না। কোষে একটা চড় মেরে বসাল রহিমার মার গালে! যখন তুমি ওই বৃদ্ধাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলে, চড়টা তখনই তোমাকে মারা উচিত ছিল। এই মুহূর্তে আমার বাসা ছেড়ে চলে যাও। আর কোনো দিন যেন তোমাকে এ তল্লাটে না দেখি।
মায়ের চিঠিটা বুকে নিয়ে ফয়সাল পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। দুই চোখ ভরা জল। বাবুন কাছে এসে বসল।
-বাবা কাঁদছ কেন?
ফয়সাল বাবুনকে জড়িয়ে ধরল।
-বাবা চাঁদের বুড়ি হারিয়ে গেছে, আর কোনো দিন আসবে না।
বাবুন ফয়সালের দুই চোখ মুছে দিল।
-কোথায় হারিয়ে গেছে বাবা?
-জানি না...।
-চলো আমরা চাঁদের বুড়িকে খুঁজে আনি।
বাবুনের কথায় ফয়সাল হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, বাবুনের হাত শক্ত করে ধরে বলল, চল বাবা, বিধাতা যখন আমার মায়ের দোয়ায় আমার হারানো পা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমাকে আবারও হাঁটার ক্ষমতা দিয়েছেন, আমি মাকে খুঁজব! আমার অভিমানী মা যেখানেই থাকুক না কেন আমি খুঁজে বের করবই। চল।
ফয়সাল বাবুনকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
পেছন থেকে মিলা ওদের থামাল, দাঁড়াও ফয়সাল! আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেবে না? আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। মা কে খুঁজব।
ফয়সাল মিলার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
-চলো...।
শাহীন আক্তার: কানাগাওয়া কেন, জাপান।