চলো যাই বঙ্গোপসাগরের বুকে সন্দ্বীপে
চলো যাই, বঙ্গোপসাগরের বুকের উত্তাল এক দ্বীপ—সন্দ্বীপ। যেখানে নারঙ্গি নারকেলরা নির্বিবাদে বাঁচতে পারে। মেঘনার উত্তাল গর্জনের সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া অনাদিকালের অব্যক্ত ভাষা যেখানে জুঁই-চামেলি-মালতীর পাতায় বাতাসের মধুর গুঞ্জন ছড়ায়। যেখানে প্রতিদিন সুখের প্লাবন ওঠে দিঘির সবুজ জলে ছলাৎ ছল। যেখানে সন্ধ্যা নামার পরেই নির্জন রাত আসে সুপ্ত গাছের খামে। যেখানে ঘুমন্ত গাছেরা সব নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে নিঝুম আয়োজনে।
চলো যাই, সেই শূন্য দ্বীপে, যেখানে রাত নামলেই ডাব গাছে উঠে শৌখিন চোর। যেখানে সন্ধ্যা নামলেই বসে জোনাকির হাট। যেখানে সকাল হলেই শিউলিতলায় ফুল কুড়াতে নামে শৈল্পিক কোনো ভুবন। চলো যাই সেই স্বর্ণ দ্বীপে, যেখানে জানালার আড়ালে মুগ্ধতা নিয়ে তোমাকেই দেখে অপেক্ষাক্রান্ত ব্যাকুল কোনো চোখ। চলো যাই, সাগরের বুকের সেই স্যান্ডহীপ, যেখানে হঠাৎ ইচ্ছে হলে পাশের মানুষটাকে বলা যায় আসো জলে নামি। যেখানে জল মানে জীবন। জল মানে আকর্ষিক জলোচ্ছ্বাসে হারানো ভিটেমাটি ঠিকানা।
চলো যাই বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত সেই দ্বীপে। যার নাম সন্দ্বীপ। এই নাম নিয়ে সন্দ্বীপের মানুষের মুখ থেকে শোনা যায় নানা গল্প। কেউ বলেন মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, বেসামাল বঙ্গোপসাগরের বুকে এই সুন্দরী জলকন্যা সর্বপ্রথম ছিল জনমানুষহীন। তাই সর্বপ্রথম এর নাম ছিল শূন্যদ্বীপ। কেউ বলেন চন্দ্রদেবতা সোমের নাম অনুসারে দ্বীপ রানি হয়েছে সোম দ্বীপ। কেউবা বলেন দ্বীপের মাটির উর্বরতার দিক বিবেচনা করে আদর করে নাম দিয়েছি স্বর্ণদ্বীপ। অন্যদিকে এই কথাও তুমুল প্রচলিত পাশ্চাত্য ইউরোপীয় জাতিরা বাংলাদেশে আসবার সময় দূর থেকে এই দ্বীপের বালির স্তূপ দেখে আনমনে উচ্চারণ করেছিল আহা ওই দূরে জলের বুকে কে এই বালি দিয়ে আবৃত শ্যামা সুন্দরী? ওর নাম দিলাম স্যান্ড-হীপ! ভাষার বিবর্তনে পড়ে সব নাম পেরিয়ে আজ সে সন্দ্বীপ। বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটা দ্বীপ। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সন্দ্বীপের বুকে মানুষের বসবাস।
সন্দ্বীপের মানুষের সেই বসবাসের কাব্যে ছিল ভুবন জয় করা জাহাজ শিল্প। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় রপ্তানি করা হতো জাহাজ। তখনকার সময়ে কম খরচে পৃথিবীবিখ্যাত সুন্দর ও মজবুত জাহাজ নির্মাণ হতো সন্দ্বীপেই। তাই তুরস্কের সুলতান সন্দ্বীপের তৈরি জাহাজের প্রেমে পড়ে সন্দ্বীপ থেকেই কিনে নিয়েছিলেন জাহাজ। তা ছাড়াও নোনা জল থেকে আহরণ করা লবণ শিল্পের জন্য একটা সময় সন্দ্বীপ ছিল বিখ্যাত। শস্য সম্পদে সন্দ্বীপ ছিল আপন প্রাচুর্যে পূর্ণ। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধিশালী বন্দর হিসেবেও সন্দ্বীপ ছিল সমাদৃত। এই সব এখন অতীত স্মৃতি বিধুরতা। ক্রমান্বয়ে নদী ভাঙন তাদের সব নিঃশেষ করে দেয়, দিচ্ছে একবার, দুবার বারবার। এতই সে উত্তাল আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি কালকে কূল ভেঙে যায় তার। যে কারণে আমার দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ আজ অতিথি পাখি। ভিনদেশি।
দ্বীপের সঙ্গে তাদের বুঝি জলের আড়ি!
তবু কোনো এক কাক ডাকা ভোর সে টানে। জড়িয়ে রাখে মায়ার কুহকে। দূর থেকে শোনা যায় তার ভেতরে সাইকেলের টুংটাং। দেখা দেয় বিকেল জুড়ে শৈশব। ছুট ছুট কলমিতলার তলে লুকানো ওই ফুটবল। সে দ্বীপে সেগুন কাঠে দোলে অরণ্য সুখ। টিনের চালে নামে ঝুমঝুম বৃষ্টি। কান বেয়ে হেলেদুলে উঠোনে আসে কই শৈল!
তপ্ত দুপুরে তালপুকুরের ঘাটে শেওলাজমা ডুব। পাশের বাড়ির মেয়েটির বোন বোন মাখা মুখ। এই জন্যই বুঝি তারা ফিরে ফিরে আসে বহুদূর থেকে। ফিরতে যে তাদের হয়ই। একটা রক্ত গাঁদা ফুল, একটা নিজের আকাশ কিংবা একটা টিপের মায়ার জন্য।
ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের জন্য সন্দ্বীপ এক হাতছানিও বটে। নিজের দেশের রূপ চুপচাপ দেখার আহ্বান আছে সে স্বর্ণদ্বীপে। যদি কারও জীবন কখনো কিছুদিনের জন্য কোনো নির্জন সুখে হারিয়ে যেতে মন চায় তাদের জন্য পালানোর ঠিকানা এটাই!
জাহান রিমা: ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।