ঘর ছেড়ে বহু দূরে
রেসিডেন্সাল ট্রিপের মতো আনন্দের সময় বছরে মাত্র একবারই আসে। খুব কম সময়ের জন্য হলেও এটা আমাদের স্কুল জীবনের একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। আমি ব্রাসেলসের একটা ব্রিটিশ স্কুল—বেপস-এ পড়ি। প্রতি গ্রীষ্মে আমরা শহরের বাইরে যাই এক সপ্তাহের জন্য। বাবা-মার শাসনের বাইরে। অবশ্য ক্লাস টিচার মাঝে মধ্যে একটু আধটু শাসন করেন। এবার আমরা সুন্দর একটা পাহাড়ি এলাকা ওয়ারিকেনে গিয়েছিলাম। ব্রাসেলস থেকে ওয়ারিকেন প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে।
সকাল ৯টায় স্কুল থেকে বাস ছাড়ল। দুপুরবেলায় আমরা পৌঁছালাম একটা বিশাল জঙ্গলের ধারে। এখানে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা ধরে হাঁটলাম। এ জঙ্গলে অনেক জীবজন্তু ও পাখি রয়েছে বলে শোনা যায়। যেমন; হরিণ ও বন্য শূকর। টানা চার ঘণ্টা বাসে বসে থাকার পর বনের ভেতরে হাঁটতে আমাদের বেশ ভালোই লাগল। ট্যুর গাইড বললেন, এখানে চুপিসারে হেঁটে গেলে মাঝে মাঝে হরিণ দেখা যায়। আবার সাবধানেও থাকতে হয় বন্য শূকরের ভয়ে। বন্য শূকরের সামনে পড়লে ভয়ানক বিপদ। এরা ভীষণ রাগী, আচমকা তেড়ে এসে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। বনের ভেতর বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমাদের বাস আবার চলতে শুরু করল ওয়ারিকেনের পথে। বিকেল পাঁচটায় আমরা সেখানে পৌঁছালাম।
আমরা গন্তব্যে পৌঁছেই ঘরের চাবি নিলাম। অনেক ছোট ছোট ঘর ওখানে। এই ঘরগুলোকে শ্যালে (Chalet) বলে। ঘরগুলো দেখতে অনেকটা ত্রিভুজের মতো। ব্রাসেলসে এ ধরনের ঘর খুব একটা চোখে পড়ে না। পরে শুনলাম এ ধরনের ছোট ছোট ঘরের ধারণা এসেছে সুইজারল্যান্ড থেকে। আমাদের শ্যালেগুলো দোতলা। নিচতলায় দুটি আর দোতলায় পাঁচটি বড় বড় ঘর আছে। ঘরের ভেতরে বাঙ্কবেড (দোতলা খাট)। রুমটাও সুন্দর করে সাজানো।
শ্যালের সামনের জিমে টেনিস কোট, হকি খেলার জায়গা ও বাস্কেটবল কোট ছিল। আবার সুইমিং পুলও ছিল একটা। আমরা সারা দিন জিমেই থেকেছি। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা করেছি। যেমন; ব্যাডমিন্টন, হকি, ট্রামপুলিন ইত্যাদি। মাঝখানে শুধু দুপুরের খাবারের বিরতি। তাই ওয়ারিকেন মজার জায়গা হলেও পরিশ্রমও করতে হয়েছে অনেক। আমরা অনেক নতুন নতুন খেলাও শিখেছি সেখানে। যেমন; পুল বল ও কিন বল। আমার পছন্দের খেলা ছিল ব্যাডমিন্টন আর ট্রামপুলিন। ট্রামপুলিনের ওপর মানুষ লাফায়। আমরা এর ওপর বল খেলেছি, ডিগবাজিও দিয়েছি। আমাদের জিম ইনস্ট্রাক্টর একটু কড়া। কিন্তু মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গে মজাও করতেন, খেলতে শেখাতেন, কোনো অসুবিধা হলে সাহায্যও করতেন। আমরা একদিন হকি খেলছিলাম। একজন ঠিকমতো লাঠি ধরেনি বলে আমাদের ইনস্ট্রাক্টর নেকড়ের মতো আওয়াজ করা শুরু করলেণ। আমরা সবাই অবাক হয়ে হাসতে শুরু করলাম। ট্রামপুলিনে আমরা একে একে লাফাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ক্লেমেন্স লাফাতে গিয়ে বারবার দেয়ালে ধাক্কা খেতে লাগল। আমরা সবাই হাসতে থাকলাম। পুরো সময়টাই আমরা খুব মজা করেছি।
ওয়ারিকেনে যাওয়ার আগেই শুনেছিলাম, ওখানকার খাবার খুব ভালো। বিশেষ করে এখানকার বার্গার, পাস্তা, ফ্রেঞ্চফ্রাই এর সুনাম আছে। এ ছাড়া এখানে ছিল মজার মজার ডেজার্টও। এর মধ্যে একদিন কায়াকিং করার কথা ছিল। আমি কখনো কায়াকিং করিনি। তাই খুব আগ্রহ নিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু লেকে গিয়ে দেখলাম বৃষ্টি পড়ছে, আর কায়াকিং করা হলো না।
দেখতে দেখতে আমাদের আনন্দের সময় ফুরিয়ে এল। সময় হলো ফিরে আসার। আরও কয়েকটি অ্যাক্টিভিটি করে আমরা তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের ব্যাগ আনতে গেলাম। ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠলাম। বাস চলা শুরু করল। পেছনে পড়ে রইল ওয়ারিকেনের মধুর স্মৃতি। আমি অনেক সুন্দর জায়গায় গিয়েছি। এখন পর্যন্ত আমার কাছে ওয়ারিকেনই সেরা। যা হোক আমার বন্ধু অ্যানাবেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে স্কুলে পৌঁছালাম বিকেল ৪টায়। বাবা এসেছিল আমাকে নিতে। স্কুলের কাছেই বাসা। খুব দ্রুত পৌঁছালাম বাসায়, বাবা-মার কাছে। ফিরে গেলাম আমার অভ্যস্ত জীবনে।
*শেখ তাসনিমা মাহবুব কাবেরী : শিক্ষার্থী।