ক বি তা র এ ক পা তা
‘অ্যা ডিফেন্স অফ পোয়েট্রি’–এর লেখক শেলি কবিতা থেকে আমাদের প্রাপ্তির বিষয়ে বলেছেন, ‘কবিতা আমাদের চিত্তকে জাগিয়ে তোলে ও তার প্রসার ঘটায়। পৃথিবীর গোপন সৌন্দর্যকে সে অনবগুণ্ঠিত করে দেখায় এবং এমনভাবে দেখায়, যে বস্তুজগৎকে আমরা চিনি, তাকেও যেন অচেনা ঠেকতে থাকে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কবিচিত্তে যে অনুভূতি গভীর, ভাষায় সুন্দর রূপ নিয়ে সে আপন নিত্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।’
ছয়জন কবির কবিতা নিয়ে এবার কবিতার এক পাতার আয়োজন। কবিদের প্রতি আমাদের অনিঃশেষ শ্রদ্ধা ও অফুরাণ শুভেচ্ছা, আপনাদের জন্য
আমাদের অবিরাম ভালোবাসা—ফারুক ফয়সল।

ইকবাল হাসানের দুটি কবিতা
হারানোর গল্প
প্রেম কেন শুধু যৌনতা হবে
কে বলেছে কবে যৌনতা শুধু প্রেম?
প্রেমময় শুধু যৌনতা আর
যৌনতাময় প্রেম
এ দুয়ের মাঝে হাঁটাহাঁটি করে
কত কী যে হারালেম!
বৃষ্টির কালোজল
বৃষ্টির পোশাক পরে কালরাতে এসেছিল হাওয়া
সে কথা জানাতে খুব এলোমেলো হলো
জানালার পর্দা আর বিছানা-বালিশগুলো
নিভু নিভু মোমবাতি শেষতক নিভে গেল অন্তিমে এসে
সাঁতার কেটেছি আমি কালোজলে, বৃষ্টির রাত ভালোবেসে।

চম্পাসাক প্রাসাদে
মঈনুস সুলতান
দিনের শেষে আমরা এসে পৌঁছি চম্পাসাকে
পেনিনসুলায় তৈরি হয়েছে
তিনটি গোলমোহরের ত্রিবেণি রেখায় একটি ত্রিভুজ,
আমাদের নাওখানি বাঁধা খানিক দূরে নদীর বাঁকে,
উপবনে হাঁটি–ঝরা বকুলে ঢাকা উঁইঢিবিতে
পেয়ে যাই ঈপ্সিত সৌরভের খোঁজ।
বাগিচায় কাঠের সেতু
পাড়ি দিতে গিয়ে আমরা সেরে নেই দিনযাপনের কথা,
ভাবি-চম্পাসাকে এলাম কী হেতু
জানি না তো রাজবাটিতে বসবাসের প্রচলিত প্রথা,
সিরামিকের জোড়া হাতির পাহারায়
চিত্রিত টাইলসের সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাই
নির্বাসিত কুমারের রাজপ্রাসাদে,
পোষা রোহিতের সঞ্চালনে সচকিত হয় গড়খাই,
আমাদের যুগল খোয়াব আটকা পড়ে পুরির ফাঁদে।
ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি-পাহাড়ি নদী
পেঁচিয়ে ধরেছে শিলা পাহাড়ের কোমর,
আধডোবা পাথর ছুঁয়ে বয়ে যায় গোধূলি মাখা জলাধি
অপ্রত্যাশিত অন্তরঙ্গতায় আমার পাললিক ভূমি হয় উর্বর।
জলজ গুল্ম জড়ানো ঘাসের আড়ালে শুভ্রতা ছড়ায়
খেয়ালি গ্রীবা তুলে অন্যমনস্ক এক বৃদ্ধ বক,
অঙ্গীকার শব্দটি চলকে আমার ভাবনার পরিখায়
বেভুল ভবঘুরে-হব না তো ফের বিশ্বাসঘাতক?

রঞ্জিত পুণ্যের ওপারে
ফারুক ফয়সল
শিশির ফোঁটার মতো টুপ করে খসে পড়ে কোনো জীবন
জীবনের জোয়ারে উজান সাঁতার তখনো কত মানুষের।
কোনো এক বিষাদ সময়ে বৃন্ত থেকে
খসে পড়ে হলুদ বিবর্ণ পাতারা,
সেই নিথর দিনে পৃথিবীর উল্টো পিঠে
নতুন পাতারা হেসে ওঠে আরেক অরণ্যে।
সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেবে বলে পথে নেমেছিল যে পথিক
পথের বাঁকে হারিয়ে গেছে সে, পান্থকুঞ্জে জিরিয়ে ক্ষণিক।
সুবর্ণ বন্দরের হাতছানি, আর রাতপরীর রহস্যভরা আহ্বান
কেড়ে নেয় নাবিকের সংসারী সত্তা, ঘরহীন, নেশাখোর সস্তা শ্রমিক।
উল্কাপাতের মতো আচমকা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে কত বিশ্বাসের ঘর
রেলগাড়ির চাকায় প্রাণ পিষ্টের মতো পিষে যায় বেবুশ্যে বিবেক।
ফুলের নিষ্পাপ শুভ্রতা কসাইয়ের চাকুতলে রক্তে রঞ্জিত
পাপ পুণ্যের নিক্তিতে তখনো একচোখা মাপ। নিয়তি থাকেন অন্ধ।
সম্পর্ক শেকড় উৎসের সন্ধান
হোসাইন কবির
কোথাও জল নেমে গেলে দেখতে পাব–
আমাদের পূর্বপুরুষের
যাযাবর পায়ের প্রাচীন ছাপচিত্র আর
শোকার্ত জলজ পাতার মর্মরে
শুনব সমুদ্রের বিলাপ।
সমুদ্রের জল নেমে গেলে
আবারও সমুদ্রে যাবে হে-
খুঁজব বিভাজিত পদচিহ্নে
সম্পর্ক শেকড় উৎসের সন্ধান।
হয়তো তখন
দূরবর্তী জাহাজে বাজবে
সঙ্গম-শোকের সংগীত
উচ্চারিত হবে
ইভ আর লিলিথের মিথিক্যাল বয়ানে
মানুষের কল্পিত আদি পিতার
অবয়ব
জলের শরীর কখনো ধারণ করেনি।

পিঙ্গল পরিচ্ছেদ
রওশন হাসান
আগমনী সন্ধ্যার ঈষৎ আলো নামল
মেঘমানবীর ভ্রুপল্লবে
দীর্ঘ সব, মুহূর্ত মন্থর; ক্ষেপণকাল
বৃষ্টিহীন ছায়ারাত্রির বিস্মৃত শিঙার শ্লোক
শূন্য হতে হতে কল্প মৈথুনে ডুবে বিরুদ্ধ পথে যাত্রা।
ওপরে জরা আকাশ প্রবল বিস্ময়ে আছে চেয়ে
নিম্নে হাতছানিতে অরক্ষিত সমুদ্র ভাঙন জোয়ার
আকাশ আর সমুদ্র মিলে বেগুনি ঘোর
কত উদ্ধত অতলে তুমি আমি ছিটকে পড়েছি ছিঁড়ে।
দ্বিখণ্ডিত কোলাজে চোখে পিঙ্গল প্রদাহ
এ চোখে নেই দাহ, শীতলপ্রবাহ
বোঝেনি খোলা দিগন্ত দেয়ালের হাহাকার
বোঝোনি কি নিদারুণ অপেক্ষাসমগ্র নিয়ে জেনেছি পথের পরিচয়
ঝরাপাতাদের কাছে জেনেছি বিসর্জনের সাক্ষর
কাঁপছে জন্ম-মৃত্যু, বিভীষিকা, ভাঙাচোরা সুখ
সিন্ধু গর্ভে অমৃতাভিলাষী শুষ্ক মৃত পীত
ঘন চুম্বনে শুষে নেব তোমার ‘তুমি’কে যদি পথবান্ধব হও শতাব্দীর।
পরাধীন
মনিজা রহমান
আমি কখনো সেভাবে পরাধীন ছিলাম না
ভোলগা নদীর ধারে নিশা-দিবার মতো,
অতটা স্বাধীনও ছিলাম না
ওদের হিংস্র ইচ্ছের কাছে কাঁপত পুরুষকূল!
আমার ইচ্ছেতে নড়েনি কোনো শুকনো পাতা
আমার ইচ্ছাগুলো ছিল খুব রেখেঢেকে
মাপা মাপা, গজ ফিতা দিয়ে নির্দিষ্ট করে রাখা!
সামাজিক বৃত্তায়নে যতটুকু দরকার
স্বাধীনতা পেয়েছিলাম সেইটুকুই!
আমি কখনো সেভাবে পরাধীন ছিলাম না।
যে জীবন চেয়েছিলাম,
যেটা পাওয়ার মতো স্বাধীনতা কেবল ছিল না!
জন্মান্তরের শেকল বেঁধে রেখেছিল ঘরের চৌকাঠে
উদাসভাবে করে গেছি গার্হস্থ্য পাঠ,
দিন শেষে আরেক জীবনের কথা ভেবে
তলিয়ে গেছি ঘুমের রাজ্যে।
আমি আসলে সেভাবে পরাধীন ছিলাম না,
ধুলিঝড়ের পরে বৃষ্টি এলে একটা অদ্ভুত গন্ধ হয়
আমের মুকুল ঝরে পড়বার টুপটাপ শব্দ
জনমানবহীন পৃথিবীর এক কোণে
একা দাঁড়িয়ে অনুভব করতে চেয়েছিলাম’
আমার কেবল সেই অনুভবের স্বাধীনতা ছিল না।