বোলপুর শান্তিনিকেতনে বসন্তের আগমনে প্রকৃতির রূপমুগ্ধ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। বসন্তের এই রূপ সারা বাংলার। আজকের ভুবন বাংলায় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির মনে এই আনন্দের রং। সব বাঙালির কবিতা প্রেমকে স্বাগত জানিয়ে আমন্ত্রণ ‘কবিতার এক পাতা’ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়।
২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের আরেক গৌরবোজ্জ্বল দিন। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় প্রতিষ্ঠিত করার দিন। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যাঁদের প্রাণ উৎসর্গের বিনিময়ে এই অর্জন, তাঁদের উদ্দেশ্যে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। বাংলা কবিতা ধারণ করে আছে আমাদের এই গৌরবকে।
বাঙালি ও বাংলা ভাষা চিরজীবী হোক! বাংলা কবিতার জয় হোক! আপনাদের সবার জন্য আমাদের এক বুক ভালোবাসা!—ফারুক ফয়সল
বদিউজ্জামান নাসিম
কোলাজ
১
তোমার নিবিড় বৃক্ষছায়ায়
কাটিয়ে এলেম রৌদ্রময় রাত্রি।
টের পেলে?
২
দুরুদুরু এই দুষ্কালে
বন্ধ করো তালি
সাবানধোয়া শূন্য হাতে
জমছে ধুলোবালি।
৩
এ-ও বুঝি এক বিমূর্ত প্রতিদান
হান, আঘাতের পর আঘাত হান!
৪
‘নয়ন সমুখে তুমি নাই’
ফেসবুক বক্ষে তুমি
নিয়াছ যে ঠাঁই!
তাপস গায়েন
রূপকথা আর অ, আ, ক, খ…
নক্ষত্রের সন্তান আমরা, তবু
পরিযায়ী মানুষের মতো রাতজুড়ে
আমার ক্রন্দন,
আর যারা চলে গেছে দৃশ্যান্তরে, তারা
এখনো দৃশ্যমান, এবং বহমান নদীর মতো
গর্জনশীল, সুন্দর!
আমার সকল পরিভ্রমণতায়
জেগে থাকে প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর,
আর পথিকের পথ গান।
তারাভরা রাতের আকাশ আর শান্ত জলস্রোত,
কে যে কার দর্পণ, আজও রয়ে গেল অজানায়
তোমার মুখচ্ছবির মতো, রাতজুড়ে
স্বপ্নে চিত্রিত হতে থাকে–
নদী ও রাজপথ,
পৃথিবীর সব রূপকথা আর
অ, আ, ক, খ…
শিউল মনজুর
জিরাফ সুন্দরী ও অলৌকিক মোহরদানা
সবাই জিততে চায়, জিতুক
সবাই হাসতে চায়, হাসুক—
আমি জিরাফ সুন্দরীদের সাথে ভাগ করে নিয়েছি
যাযাবর দিনের বিষণ্নতা
কখনো পানকৌড়ি কখনো মাছরাঙাদের সাথে
বদল করে নিয়েছি কুঁড়েঘরের তাজমহল
সবাই জিততে চায় জিতুক-
জিততে জিততে সবাই হাসুক
ক্যালেন্ডার বানিয়ে তামাম বিশ্বকে
বগলের থাবায় রাখুক...
আমি দূরের পথে খুঁজে নেব তোমাকেই
অলৌকিক মোহরদানা আছে, যাযাবর পকেটেই
শিহাব শাহরিয়ার
সলতের রং মধ্যরাতের গালির মতো
একটি উদ্যোগ ছিল
তোমাকে ফিরিয়ে আনার
মৌনতা এসে বাধা দিল
যন্ত্রণা নিঃসংকোচে চলে গেল
বলল: আমার চোখে চাহনি, চৌকাঠ ও চৌহদ্দি নেই
বলল: আমার চোখে চিমনি, চাঁদ ও চড়ুই পাখি আছে
সুতরাং বক্তা তৃতীয় লিঙ্গের হলেই ভালো হয়?
কোনো কোনো জিজ্ঞাস্য আইলবিহীন খেতের মতো
একদিন একটি ধুতরা ফুল ফুটেছিল
একদিন সলতের রং মধ্যরাতের গালির মতো ছিল
সুতরাং নাক-সমান সলতে ভিজিয়ে রাখো
ভোরবেলা কাক এসে কড়া নাড়তে পারে।
ফারহানা ইলিয়াস তুলি
ভাদ্রের অদূরে জমে থাকে যে বিদ্যুৎ
শ্রাবণ পেরিয়ে এলেই আমরা দেখা পাই শরতের
যৌবনের পরতে পরতে জমা থাকে যে শুভ্র উল্লাস
শান্তির আহ্বানে তা একদিন শিউলিমালা হয়েই
শোভা পায় কিশোরীর বেণিতে। একগুচ্ছ জুঁই
হাতে নিয়ে কবি দাঁড়িয়ে থাকেন তার অপেক্ষায়-
যে একদিন এগিয়ে নিয়ে যাবে এই কালের কলম।
জমে থাকা বিদ্যুতের অদূরেই বেড়ে উঠে ভাদ্রের
বসতি। কেউ সেই বসতির পাশেই বানায় ঘর-
বিগত বর্ষায় যাদের ঘর ভেঙে গিয়েছিল ঝড়ে,
তারা অন্যের ছাউনির দিকে তাকিয়ে বাঁচার আশ্রয়
খোঁজে। ঋতুর বুক থেকেই মানুষ ধার করে কিছু উষ্ণতা।
রুদ্রশংকর
বাবার জন্ম
অবশেষে অভাব মেটানোর জন্য গ্রামের পুরোহিত এলেন শহরে,
নিজের অভাবের পাশে একসঙ্গে এতগুলো অভাব তিনি কখনো দেখেননি
খাবারের জন্য অভাব, শান্তির জন্য অভাব, আনন্দের জন্য অভাব...
যেন সংসারের সমস্ত অভাব নগ্ন হয়ে হাঁটছে শহরে।
ক্রমে দিন বদল হয়, রাত্রি বদলে যায়;
জুতো বদলের মতো শহরে বদল হয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাপকাঠি।
ক্রমে গ্রামের অভাবী, অসুস্থ পুরোহিতকে
‘সতেরো বাবা, অসতের বাবা’ বলে ডাকতে শুরু করে ভীরু মানুষের মহল্লা,
টুকরো টুকরো গল্প জুড়ে তৈরি হয় সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া প্রতিষ্ঠান।
সেই থেকে নতুন রূপকথার জন্ম হয় মাটিতে,
মেঘে মেঘে ধর্ম বেঁচে থাকলেও আইন-আদালতে ভিড় কমেনি মানুষের;
নিঃস্ব গলিতে বেড়েছে পুলিশের ক্লান্ত চোখের উল্লাস।
সেই থেকে শহরের সমস্ত ঘরে আমি মদ ছুঁয়ে যতবার সত্য বলেছি
ঠিক ততবার ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে মিথ্যে বলেছে মানুষ।
অপরাহ্ণ সুসমিতো
পরাজিত নই তবু
যত বন্দী রেণু উড়ে গেল আজ মন্ট্রিয়েল শহরে, রান্নার প্রহরে কারফিউ শহরে
কী কী স্বপ্ন থেমে গেল বুঝি থমকে একটু তুষার জানুয়ারি?
বাড়ির উষ্ণতা নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র খুলে নেয় নিস্পৃহ মেকানিক, ভয় চোখের ভাইরাস
ঢুকে পড়ে কংক্রিট সুরম্য বাড়িখানায়।
এত জমানো কষ্টের টুপটাপ নিচে নেমে গেল বলে
আজও মন খারাপের কিছু নেই। সমাপ্তি বলে কিছু নেই বলে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়।
পরো, সানগ্লাস পরো। কান্না ঢেকে ফেলো ও সুন্দর
আজ যদি বাতাসে উড়ে যায় জমানো স্বপ্নের আলো আলোয়ান, আমি তবু স্বপ্ন দেখি
সে সুস্থ ফিরে আসবে, যার কারণে আমি দেশছাড়া।
দেখো কাল আবার নতুন এক টুকরো সমৃদ্ধ সূর্য দেবে হিরের টুকরো হো হো হাসি,
আরও সুন্দরম দেবে অভিবাসন
শোনো, এসো মন ভালো করে রাখি যৌথ প্রণয়ে।
রওশন হাসান
এই সব আবহকাল
দিনের শুরু তুষার পতন অসংগতির জানালায়
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জরুরি অবস্থা ঘোষণা
জানুয়ারি খসে পড়ে হতাশায়, কফিনে কফিনে
হৃৎপিণ্ড স্পন্দন থেমে যাওয়া স্তব্ধতার স্বর
নিভে যাওয়া সবুজে মৃত বৃক্ষে শাদাচিহ্নে নগরের দীর্ঘশ্বাস
দেয়ালের পাহারায় আসবাব, পুস্তক, মানুষ
গরম জলে ঠোঁট। জীবাণুমাতাল অবসন্ন পৃথিবী।
আয়ুর সিঁড়িতে বসে গুনি প্রত্যহের ভার
জেগেছে রাত, মৌসুম ভ্রান্তি—বোঝেনি অনাকার চোখ।
দূরাগত চাঁদ গুণে উইন্ড-চাইম কানফুলের মুক্তো।
গলন্ত আঁধারে ঠান্ডা স্পর্শের বিরুদ্ধকাল।
কাঁপছে পেন্ডুলাম। হাত ফসকে পড়ে থালা ঝনঝন টুকরো টুকরো শব্দে
ছিন্ন চকিত ছিটকে যাই কোথাও মৃত্যুর ভগ্নাংশে
তীব্র আলোকতরঙ্গের প্রবাহে ব্লিজার্ড ফাঁদ
ধূসর বাষ্পে তুমুল শুভ্রের অবিচ্ছিন্ন পতনে
মাটি সরে সরে তৈরি হচ্ছে নৈরাশ্যের ইমারত
ভাঙছে লুপ্ত বোধ, নিরাশ্রয়ী পাখির পালকে।