ক্ষণিকের আনন্দের গভীরতা

ঈদ মানে মানুষের মেলা

ঈদ মানে খাওয়া আর খাওয়ানোর ছলাকলা

ঈদ মানে এ ঘরে ও ঘরে ঘোরাঘুরি

ঈদ মানে সালাম আর কদমবুচি

ঈদ মানে বুকে জড়িয়ে কোলাকুলি

ঈদ মানে পকেট ভরা ঈদের সালামি।

এসবের কিছুই মোবারকের কপালে জোটেনি। তবে আজ সে মন খারাপ করতে করতেও সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে মোবারক খুশি অন্য কারণে। কারণ হলো, ফেসবুকের হোম পেজের যে দিকে স্ক্রল করে ওপরে-নিচে সবখানে তার নাম মোবারক আর মোবারক। শুধু সঙ্গে ঈদ লাগানো। এত দিনে সে তার নামের সার্থকতা পুরোপুরি অনুভব করতে পারছে। নিজেকে সে অনেকটা সেলিব্রেটিদের মতো মনে করছে। তার প্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিমের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কয়েক হাজার কমেন্ট পড়ছে ঈদ মোবারক বলে। তার মনে হচ্ছে, সেগুলোর মালিক সে নিজেই। ভেতরে কেমন উত্তেজনা অনুভব করছে এবং সব কমেন্টে লাভ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।

মোশাররফ করিমের রোমান্টিক নাটক দেখে সে প্রায়ই রোমাঞ্চ অনুভব করে—এটা ভাবতেই মনটা সকিনার জন্য মোচড় দিয়ে ওঠে। তার বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। সে সৌদি আরবে এসেছে রোজগারের আশায়। সকিনা তার ভালোবাসা। নিজেরে সে দুঃখী ভাবতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের লেখক আপার কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সে জ্ঞানের সঙ্গে বাঁচতে চায়। এই প্রথম সে হাসি মুখে মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা শেষ করছে। এই প্রথম সে কান্নাকাটি করেনি। সে বলছে গরু গোশত, সেমাই সব তারা রুমমেটরা মিলে রান্না করছে। মা এতেই খুশি। মায়ের খুশি, তারও খুশি।

মনকে কীভাবে বশে রাখতে হয় মোবারকের সে বিষয়ে অনেক জ্ঞান হয়েছে। মোশাররফ করিমের নাটকেও এমনটা দেখেছে। এখন কী আর সেই আগের যুগ আছে যে এক পার্বতীর জন্য দেবদাস হয়ে জীবন শেষ করে দেবে। সকিনা যখন বলে, তার বাবা বিয়ে ঠিক করতেছে, তখন মোবারকের মনে হয় সে যেন শেষ। সকিনা তার চাচাতো বোন। দশম শ্রেণিতে পড়ে। এসএসসি পরীক্ষার অজুহাত দিয়ে বিয়ে আটকে রেখেছে।

এই দুনিয়া যা দেয় তা সহজভাবে গ্রহণ করা শিখেছে মোবারক। আগে ইচ্ছা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হলুদ ট্যাক্সি চালাবে। কিন্তু না, তার কপালে জুটেছে মুরগির বিষ্ঠা পরিষ্কারের কাজ। তার এখন এই কাজটাও সুখের মনে হয়। কাজ যাই হোক, শ্রদ্ধা করতে হবে। এই কাজ না থাকলে সে দেশে টাকা পাঠাতে পারত না। রাতের খাবার শেষ করে ফেসবুকে নিজের নাম দেখতে দেখতে মোবারক ঘুমিয়ে পড়ল এবং ঘুমের ভেতর মোশাররফ করিমের নাটক দেখতে লাগল।

২.

গত বছর ঈদে আপনজনদের সঙ্গে অনেকের দেখা হয়নি। পোশাক কেনা হয়নি। কেনা হলেও বেড়ানো হয়নি। এবার ষোলো আনা উশুল সবাই করে নিচ্ছে। পোশাক অনলাইনে কেনার সুবিধা সবাইকে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে নিয়ে এসেছে। আবার ঈদের মার্কেট তো আছে। ঈদ আমাদের মনকে প্রফুল্ল করে। তাই মহামারি বাড়লেও গত বছরের মতো মনে কারও ডর নেই।

বড় কথা টিকা নেওয়া আছে। সবাই মাস্ক ব্যবহার করছে। এই যুক্তির নিচে অসুখ ভীতি ভাটা পড়েছে এবং ঈদের আনন্দ বাঙালি সমাজে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে ঈদের আগের রাত ছিল নাকি দেখার মতো। এ যেন অন্যরকম ঈদ। দেশ থেকে আমার ভাইপো জানাল, এবার একটু বেশি ঈদ হচ্ছে। সবাই দাওয়াত দিতে এবং নিতে ব্যস্ত। এত এত দুঃখের মধ্যে এ যেন এক অন্য রকম আনন্দ।

এই আনন্দের মাঝে দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বজন হারানোর বেদনা। আত্মীয়স্বজন অনেকের মা-বাবা শূন্য বা সদ্য মৃত ব্যক্তিকে হারানোর শোক। তাদের চোখে প্রিয়জনের স্মৃতির জল গড়িয়ে পড়ছে। কেউ নিজেকে অপরাধী ভাবছেন—কবে কোন শাড়ি বা পোশাক পছন্দ হয়নি বলে খুশি মনে নেননি। উল্টো আরও অর্থ খরচের জন্য কথা শুনিয়েছেন। আজ সে মানুষ নেই। সেই অবাঞ্ছিত শাড়ি কেউ বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।

তাদের কাছে ঈদ মানে কবরের পাশে বসে ফেলে আসা দুই বিন্দু জল। সেই কেবল জানে, প্রিয়জন যার হারিয়েছে। এর মধ্যেই প্রাধান্য দিতে হবে যারা বেঁচে আছে তাদের। আনন্দ হোক বা না হোক মন শান্ত রাখতে হবে।

৩.

আনন্দ-সুখ-দুঃখ সবকিছু আমাদের মনের তৈরি করা অংশ। যখন চিন্তা দিয়ে তুলনা করি কোনো এক কালে মা বাবা ছিলেন, কোনো এক কালে ভাইবোন সব এক সঙ্গে ছিলাম। গত বছর এমন দিন এ ছিল সঙ্গে, ও ছিল সঙ্গে, এই খেয়েছি, সেই খেয়েছি, এই পরছি কিন্তু হায় আজ তো কেউ নেই। কিছু নাই, কেউ কোনো গিফটও দিল না, কিছুই কিনতে পারলাম না। এই ভাবনাকে বলছি ভালোবাসা। যে ভালোবাসা সবার আছে, আঘাত দেয় নিজের আত্মাকে। তারপর অন্যরা যদি দুঃখী না হয় তাও তাদের দুঃখী করে তুলছি। কিন্তু আধ্যাত্মবাদ একে আবেগীয় দুর্বলতা হিসেবে দেখে। আমি নিজে দুঃখী হয়ে যাদের যাদের কথা ভাবব, তারা কেউ মনে ভালো বোধ করবে না। সুখে থাকলেও বলবে কেন যেন কিছুই ভালো লাগছে না। মন খারাপ লাগছে, কিন্তু কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমরা মনে করি সবাইকে মনে করে কান্না করা মানে ভালোবাসা। এটা ভুল।

পক্ষান্তরে, মন যদি বলে সমস্যা না। আজকে আমি যা আছে তাই নিয়ে খুশি থাকব, তাহলে মন তাতেই আনন্দ পাবে। মনে তখন কোনো ভার থাকবে না। এ জন্য প্রয়োজন মনকে একটা লাইন শেখানো, I accept the people/world/situations as it is . মানে মনকে শেখানো, এ পৃথিবী যেমন তেমন ভাবে গ্রহণ করতে হবে। মন যখন শিখে ফেলবে তখন আর কোনো প্রশ্ন করবে না। প্রশ্ন যখন বন্ধ তখন দুঃখী হওয়ার প্রশ্ন আসবে না।

বিনা চাহিদায় যখন কিছু পাওয়া যায় তা যে আনন্দ দেয় আর কিছুতে সে আনন্দ পাওয়া যায় না। এ জন্য চাহিদা কমাতে হবে। আমার এ চাহিদাহীন জীবনে নিউইয়র্কে ছেলেবেলার বন্ধু নেলীর আগমন এ রকম কিছু। অপরিসীম ভালোবাসা আর আনন্দের স্পর্শ। মনে পড়ে গেল স্কুল জীবনে একজন আরেকজনের বাসায় বেড়ানোর কথা। এই বন্ধুত্ব এমন যে, এখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, কোনো হিংসা বিদ্বেষ নেই। খারাপ লাগলে কিছু আমরা নির্দ্বিধায় বলে দিই। এতে মান অভিমানও নাই। আমরা জল তরঙ্গের ঢেউ তুলে সেই ছেলেবেলার মতো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি। কখনো গভীর কোনো বিষয়ে আলোচনা। না চাওয়ার মাঝে এ পাওয়া যেন অন্য রকম। এ আনন্দ ক্ষণিকের কিন্তু এর গভীরতা অনেক।