কে বলে মরুভূমির দেশ?

রাবাত শহরের একটি দৃশ্য
রাবাত শহরের একটি দৃশ্য

অতলান্তিক মহাসাগরের পাড়ে মরক্কোর রাজধানী রাবাত। শূন্য থেকে আমাদের উড়োজাহাজটি যখন ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছিল রানওয়ে লক্ষ্য করে, তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলাম বিমানবন্দরের চারদিকে সবুজে সবুজে গাছ। অথচ মরুভূমির দেশ মরক্কো। ‘সাহারা’ বলতে আমাদের চোখের সামনে যে দেশটি ভাসে তা হলো মরক্কো। যদিও বিশাল সাহারা মরুভূমি কেবল মরক্কোর একার নয়। সাহারা মরুভূমি ছড়িয়ে আছে আলজেরিয়া, মিসর ও মৌরিতানিয়াতেও। এই ধু-ধু মরুভূমির আয়তন গোটা চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের সমান। প্রায় নয় মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার।

রাবাত শহরের একটি দৃশ্য
রাবাত শহরের একটি দৃশ্য

মরক্কোর রাজধানী রাবাতে পৌঁছার আগে ভেবেছিলাম শহরের ভেতরেও দেখব সাহারার প্রভাব। কম গাছ-গাছালি, বন জঙ্গল নেই। কিন্তু শূন্য থেকে ধীর গতিতে মাটির দিকে নামতে গিয়ে প্লেনের ছোট জানালার ভেতর দিয়ে বাইরে যত দূর দৃষ্টি যায়, দেখলাম চারদিকে, এমনকি বিমানবন্দরের চারপাশ গাছগাছালিতে ভরা, যেন বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানবন্দর।
মুহূর্তে মনে পড়ে বাংলাদেশ। আমার সবুজ বাংলাদেশ। জন্মসূত্রে আমরা যেমন বাংলাদেশি বা বাঙালি ঠিক তেমনি বাংলাদেশও জন্মসূত্রে সবুজ। এখানে জন্মাতে হয় না, আপনাতেই জন্ম নেয় চারা, চারা বেড়ে রূপ নেয় বৃক্ষে, মহীরূহে। কোনো যত্ন করতে হয় না। বাংলাদেশের মাটি এমনই উর্বর। এরা বেড়ে ওঠে চরম অবহেলা আর অযত্নে। ঠিক যেমন রাস্তার ধারের শিশুটি। অথচ এই সবুজ বাংলাদেশকে আমরা সাহারা বানাতে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছি। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে, স্থানীয় মাস্তান, টাউট, রাজনীতিবিদ কারও কোনো পরোয়া নেই। সামান্য অছিলায় নেমে পড়ি বৃক্ষকর্তনে। কী নির্লজ্জভাবে। সম্প্রতি দেখেছিলাম যশোর রোডের ঐতিহাসিক বৃক্ষগুলো কাটার হীন প্রচেষ্টা। সে উদ্যোগ যে থেমে গেছে তা নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যদি সোচ্চার না হতো তাহলে এত দিনে বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়ানো স্মৃতি জড়ানো এই দৃষ্টিনন্দন গাছগুলো অনেক আগেই কাটা হয়ে যেত। অথচ মরক্কো! মরুভূমিকে কী করে এরা সবুজ করে রেখেছে। ভাবতে অবাক লাগে।
ছোটখাটো এই বিমানবন্দর। বেরিয়ে একটু হেঁটে যেতে হয় গাড়ির জন্য। নিরাপত্তার কারণে গাড়ি বিমানবন্দরের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো নিষেধ। চমৎকার রৌদ্রস্নাত দিন। মরক্কোয় এই প্রথম আসা। এক সময় ফরাসি ও স্পেনীয়রা এই দেশটি তাদের দখলে নিয়েছিল, ভাগাভাগি করে। ফরাসিরা এই দেশটি দখলে নেয় ১৯১১ সালে যখন মরক্কোর সেনাবাহিনী ফরাসি-অধিকৃত ফেজ নগরী দখল করে। মরক্কোর সুলতান আবদেল হাফিজ ১৯১২ সালের ৩০ মার্চ এক চুক্তি সই করতে বাধ্য হন। মরক্কো তখন পরিণত হয় ফরাসি ও প্রতিবেশী দেশ স্পেনের শাসনাধীন রাজ্যে। এই দুই ইউরোপীয় দেশ ভাগাভাগি করে নেয় আফ্রিকার এই মুসলিম দেশটাকে, যার শতকরা ৯৮ শতাংশ জনগণ মুসলিম। প্রায় ৪৪ বছর পর ১৯৫৬ সালে ফরাসি শাসনের অবসান ঘটে মরক্কোর স্বাধীনতা লাভের মধ্যে দিয়ে এবং এর কিছুদিন পর ফিরে পায় স্পেন-অধিকৃত অংশ। এই স্বাধীন দেশের রাজধানী রাবাত থেকে ঘুরে এলাম কিছুদিন আগে। আফ্রিকা তার শত দৈন্যর মাঝেও ইউরোপীয়দের কাছে টানে। আফ্রিকার যে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রকৃতি তা টানে এই ভূখণ্ডের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে।

মাইগ্রেশন লেবোরেটরির আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা
মাইগ্রেশন লেবোরেটরির আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা

মরক্কো আসার আগে দেশটি, পাশাপাশি এর জনগণ সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা ছিল। তার পেছনে কারণও আছে বৈকি। হল্যান্ডে মরক্কোর বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস, প্রায় তিন লাখের মতো। এ দেশে অর্থাৎ হল্যান্ডে যাদের বসবাস তাদের বেশির ভাগ আসা মরক্কোর অনুন্নত এলাকা থেকে। এদের প্রথম জেনারেশন হল্যান্ডে এসেছিল শ্রমিক হিসেবে। যাদের ডাচরা একটা সুন্দর নামে ডাকে। তা হলো ‘খাস্ট আরবাইদার্স’ অর্থাৎ অতিথি শ্রমিক, যদিও বা তাদের সঙ্গে অতিথি-সুলভ আচরণ করা হতো না। হল্যান্ডে মরক্কীয়দের সম্পর্কে সাধারণ ডাচ জনগণের খুব একটা ভালো ধারণা নেই। ব্যতিক্রম ছাড়া এই জনগোষ্ঠীর লোকজন বিশেষ করে তরুণদের সম্পর্কে রয়েছে নেতিবাচক ধারণা। কোথাও কোনো গন্ডগোল, মারপিট, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, চুরি, ছিনতাই, গাড়ি ভাঙচুর, দেখা যায় মরক্কীয় তরুণেরা জড়িত। এদের আচরণে ত্যক্ত-বিরক্ত সাধারণ জনগণ। বছর কয়েক আগে এদের বাড়াবাড়ির কারণে ডাচ প্রধানমন্ত্রী রুতে বলেছিলেন, ‘তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাও’। কথাটা তিনি আরও কর্কশ ভাষায় বলেছিলেন। অবশ্য সে কারণে তিনি অনেকের সমালোচনার মুখেও পড়েছিলেন। কেননা হাজার হলেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এই জাতীয় শব্দাবলি উচ্চারণ করতে পারেন না এবং কতিপয় দুষ্টের জন্য গোটা মরক্কীয় জনগোষ্ঠীকে ঢালাওভাবে দোষারূপ করতে পারেন না। তারও আগে কট্টর বিদেশি-বিরোধী ডাচ ডান নেতা বিলডার্স বলেছিলেন, ‘মিনদার মরক্কান’, যা বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘আমরা আর মরক্কান চাই না এ দেশে।’

রাবাত বিমানবন্দর
রাবাত বিমানবন্দর

এমন নেতিবাচক ধারণা নিয়ে রাবাত এলাম। মরক্কো এসে দিন কয়েক থেকে সে ধারণা বদলেছে কিনা সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পর। তার আগে বলে নেই কেন আফ্রিকার এই দেশে আসা। জার্মান ফেডারেল সরকার ও জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেডের উদ্যোগে বিশ্বের ১৮ দেশের ৩৩ সদস্য নিয়ে গঠিত মাইগ্রেশন লেবোরেটরির অন্যতম সদস্য হিসেবে আমার আসা। অভিবাসন কী করে সবার কাজে আসতে পারে এই বিষয়ে চার দিনের ইনটেনসিভ আলোচনার মূল লক্ষ্য। আমস্টারডামের শিফল বিমানবন্দর থেকে প্যারিসের দ্য গল এয়ারপোর্ট হয়ে যেতে হবে রাবাত। মাঝে বিমান বদলের সময় এক ঘণ্টার সামান্য বেশি। কপালে দুঃখ আছে ধরে নিয়ে বসে আছি প্লেনের ভেতর। এক টার্মিনাল থেকে আর এক টার্মিনাল যেতে আবার ট্রেন ধরো। তারপর যত দ্রুত সম্ভব অনেকটা দৌড়ে নির্দিষ্ট টার্মিনালে পৌঁছা। প্লেনে উঠে দেখা আরও জনাকয়েক সহযোদ্ধার, যারা আমার মতো ‘মাইগ্রেশন লেবোরেটরির’ সদস্য। তাদের কেউ ইকুয়েডর থেকে আসা, কেউ জার্মানি থেকে, দুই নারী ইন্দোনেশিয়া থেকে, আর একজন আফ্রিকায় এসেছেন সুইডেন থেকে। সবাই এক হয়েছেন প্যারিসে এসে। লেবোরেটরির এটি দ্বিতীয় মিটিং। প্রথমটি হয়েছিল মাস কয়েক আগে বার্লিনে।
রাবাত বিমানবন্দরের সামনে অপেক্ষা করছিল বড়সড় মাইক্রোবাস। বিমানবন্দর থেকে হোটেল। কোথাও কোনো ভিড় পেলাম না। রাস্তাগুলো বেশ ভালো। ইউরোপের মতো না হলেও কাছাকাছি, পরিষ্কার। লক্ষণীয় যা তা হলো, গাড়িগুলো নিয়ম মেনে এগিয়ে চলেছে। মনের কোনায় আবারও বাংলাদেশ! কোনো নিয়মের বালাই নেই আমাদের সোনার বাংলায়। ভাবি মরক্কোয় যদি সম্ভব, বাংলাদেশে কেন না? এর কোনো সমাধান দূর-অদূর ভবিষ্যতে দেখি না। ফিরে আসি বর্তমানে। রাস্তার দুই ধারে, কাছে-দূরে সবুজে-ঢাকা গাছগাছালি। গাড়ি এগিয়ে চলে কখনো বা সমতল, কখনো বা উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা কংক্রিটের রাস্তা ধরে। যাওয়ার পথে পড়ে মরক্কোর রাজার অনেকগুলো প্রাসাদের একটি। প্রাসাদের যে সীমানা প্রাচীর তার রং অনেকটা মরুভূমির লালচে বালুর রঙের মতো। লক্ষ্য করি গোটা রাবাতে এই রঙের প্রাধান্য। কেবল এই রংই বা বলি কেন, রাবাতের সর্বত্রই দেখলাম নানা রঙের ছড়াছড়ি। আরবিয় শিল্প, কারুকাজ বিভিন্ন ভবনে, হোটেলের সামনে, ইন্টেরিয়রে, সর্বত্র। যে হোটেলে আমাদের পাঁচ দিনের থাকার ব্যবস্থা, ঢুকেই মনে হলো যেন কোনো রাজপ্রাসাদে এলাম। এর দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক কাজ—দেয়াল, দরজার প্রবেশ মুখে, এমনকি ওপরের দিকে উঠে যাওয়া সিঁড়ির হাতলগুলিও। চোখ ধাঁধায়। মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন আর্কিটেকচারের সঙ্গে মিশেছে আধুনিক ডিজাইন। এখানকার পুরোনো দিনের বাড়িগুলোর কাজও দেখার মতো। সাধারণত বাইরের দিকে কোনো জানালা নেই, এটি মূলত প্রাইভেসি রক্ষা করার জন্য। সব দরজার মুখগুলো একটি খোলা বারান্দার দিকে, বারান্দার ওপর দিকটা খোলা, আলোর জন্য।

মেদিনা মার্কেট
মেদিনা মার্কেট

বেশ বড়সড় লবি হোটেলের। বিদেশে হোটেলে এলে (ইউরোপে নয়) অনেক ক্ষেত্রে ওয়েলকাম ড্রিংকস দেওয়া হয়। বাংলাদেশ, ফিলিপাইনস, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে এমনটি ঘটে। রাবাতের এই হোটেলে তেমন কোনো ওয়েলকাম ড্রিংকস সার্ভ করা হলো না বটে, তবে দেখি রিসেপশন ডেস্কের সামনে বড় একটি পাত্রে পাকা খেজুরের স্তূপ। ফলের দেশ মরক্কো। ফল পাবেন সর্বত্র, সব সময়, লাঞ্চে, ব্রেকফাস্টে, ডিনারে। হরেক রকমের ফল। মরক্কো কৃষি-নির্ভর দেশ। কৃষি ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কাজ করে। দেশের উত্তর-পশ্চিমে গম, বার্লি উৎপাদন হয়। অতলান্তিক মহাসাগরের পাড়ে জন্মে অলিভ, আঙুর। যা জানা ছিল না তা হলো এই মুসলিম দেশটিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাদক, ‘হাসিস’ উৎপাদন হয়ে থাকে। চেক ইন শেষে ব্যাগটি আমার হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে যায় হোটেলের ‘ওয়েল ড্রেসড’ বয়টি। লিফট বেয়ে নির্দিষ্ট রুমের দরজা খুলে এসি অন করে সে বিদায় নেয়। বিশাল ডাবল বেডের কামরা। একদিকে সোফা, টি টেবিল, বেডের দুই পাশে দুটো টেবিল ল্যাম্প, একদিকে বড়সড় ওয়ার্ডরোব, চমৎকার শাওয়ার, মিনি বার, তাতে বিয়ার থেকে শুরু করে সফট ড্রিংকস, পানি, ইত্যাদি। টি টেবিলের ওপর একটি বড় কাচের প্লেটে বেশ কটি তাজা ফল-কলা, আপেল, কমলালেবু আর একটি নাম না জানা ফল। নিয়ম মাফিক এগিয়ে যাই জানালার ধারে। কিছুটা হতাশ হওয়া, বাইরের কিছুই চোখে পড়ল না, কেবল সামনের অনেকগুলো জানালা, হোটেলের, তবে মাঝখানে অনেকটা খালি জায়গা, ওপর থেকে আলোর জন্য বোধকরি। প্রোগ্রাম অনুযায়ী সন্ধ্যার সময় ওয়েলকাম ডিনার। অনেকে এখনো এসে পৌঁছেনি। কয়েক'জন আসবে আগামীকাল। হাতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময়। মনে মনে ঠিক করি লাঞ্চ আর করব না, খিদে নেই, শাওয়ার নিয়ে কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন। কাল থেকে শুরু হবে চার দিনব্যাপী ইনটেনসিভ আলোচনা, অনেকটা স্কুলের মতো। স্নান সেরে এগিয়ে যাই বেডের দিকে। দুটো ডাবল বেড, কোনটিতে শোব? জানালার ধারেরটা বেছে নেই। ততক্ষণে অনেকটা নির্ঘুম, ক্লান্তিতে শরীর প্রায় অবসন্ন। জানালার ভারী পর্দা দুটো টেনে দিই, রুমের বাতিগুলো নিভিয়ে দিনের বেলায় ঘরটাকে অন্ধকার করে লেপের ভেতর শরীর ঢুকিয়ে দিই।

মেদিনা মার্কেটের ভেতরে রেস্তোরাঁয় শিল্পীদের পরিবেশনা
মেদিনা মার্কেটের ভেতরে রেস্তোরাঁয় শিল্পীদের পরিবেশনা

মিটিং চলতে থাকে যথামাফিক। রাবাত অবস্থানের তৃতীয় দিনে ঠিক হলো আমরা তিন দলে ভাগ হয়ে তিনটি ভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে হাতে-কলমে পরিচিত হওয়ার লক্ষ্যে তিনটি পৃথক জায়গায় যাব। আমি বেছে নিলাম হাইস্কিলড মরক্কীয়রা স্বদেশে ফিরে এসে যে গবেষণা কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছে সেখানে যাব। তারা কী করে এই অনেকটা অসাধ্যসাধন করলেন, দেশে ফিরে আসার জন্য কী তাদের অনুপ্রেরণা জোগাল কিংবা নিজ দেশের সরকার তাদের এই উদ্যোগে কী পরিমাণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানার কৌতূহল, আগ্রহ থেকে ঠিক করলাম এখানেই যাব। আমি যে দলে তার লক্ষ্যস্থল মরোক্কান ফাউন্ডেশন ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মরক্কো। সেদিন মরক্কোর আবহাওয়া ছিল চমৎকার। কিছুটা ঠান্ডা হলেও সহনীয়। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বিধায় সেন্টারে ছাত্র-ছাত্রী কিংবা শিক্ষকদের পদচারণা অনুপস্থিত। এই সেন্টারের লক্ষ্য, দেশের শিল্প বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন ধারণা ও টেকনোলজি উদ্ভাবন করা। সেটি নতুন কোনো ব্যাপার নয়। নতুন যা তা হলো, এই সেন্টারটি টার্গেট করেছে বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, সৌদি আরব, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাইস্কিলড মরক্কীয়দের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা এবং সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করা। একই ভবনে আছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব রাবাত। বাইরেও আছে ফ্যাকাল্টি। প্রফেসর নুরুদ্দিন মুজাদ্দিব, দীর্ঘ ২০ বছর ফ্রান্সে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা শেষে দেশে ফিরে এসে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলেন।
নাদুসনুদুস শরীরের এক ভদ্রলোক বসেছিলেন ঠিক আমার মুখোমুখি। মাথাভর্তি চুল, গায়ের রং ফরসা, পরনে স্যুট টাই। টাইয়ের নটটি একটু ঢিলে, বোধকরি শরীরের সাইজের কারণে ঠিকমতো লাগেনি। হাতে দামি ঘড়ি। নাম প্রফেসর জাওহির সেককাত। তিনিও প্রায় বিশ বছর ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে ফিরে এসে এখানে যোগ দিয়েছেন। দেখতে অনেকটা জাপানি সামুরাইদের মতো। কথাটা তাকে ঘণ্টা কয়েক পর চা-কফি ব্রেকে বলেছিলাম। মৃদু হেসে বলেন, অনেকে তাই বলে। প্রফেসর জাওহিরের ডাইনে-বায়ে বসা জনাকয়েক তার সহকর্মী। গুনে দেখলাম মোট সাতজন। সবাই মরক্কীয় এবং এদের কেউ বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষক, কেউ শিক্ষক। লক্ষণীয় যা তা হলো উচ্চশিক্ষিত এদের কেউ কেউ উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে, বেশ কয়েক বছর সে দেশে বসবাস করে ফিরে এসেছেন স্বদেশে, নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়েছেন নিজ দেশের উন্নয়নে। উপস্থিত ছিলেন এক তরুণ মরক্কীয় শিক্ষিকা। জানালেন, তিনি ফিরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বললেন, ‘পিএইচডি করার পর যখন সিদ্ধান্ত নেই দেশে ফিরে আসব, তখন আমাকে অনেকেই বলেছিল, ইউ আর ক্রেজি, দেশে কেন ফিরে যাচ্ছ? কিন্তু আমি ফিরে এসেছি এবং আমেরিকায় যে সুযোগ-সুবিধা পেতাম তার চাইতে অনেক কম সুবিধা ও কম বেতন সত্ত্বেও আমি চলে এসেছি। ভেবেছি দেশকে আমার কিছু দেওয়া কর্তব্য।’ আমার মুগ্ধ হওয়ার পালা, তার সৌন্দর্যে নয়, তার কথায় ও দেশপ্রেমে।
রিসার্চ সেন্টার সম্পর্কে বলতে গিয়ে উপস্থিত এক গবেষক পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে বলেন, আমরা এখানে ন্যানো টেকনোলজি, বায়ো-টেকনোলজি, মাইক্রো-ইলেকট্রনিক নিয়ে কাজ করছি। প্রফেসর জাওহির বললেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি মরক্কো সফরে এলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসা করেন। যার কারণে মরক্কোর সরকার আরও উৎসাহী হয় এবং জায়গা দান করে। স্বদেশ প্রত্যাগত প্রবাসীদের নিয়ে শুরু হওয়া এই প্রজেক্টের আওতায় বর্তমানে তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। আমাদের টার্গেট হলো পাঁচ হাজার, জানালেন উপস্থিত শিক্ষকদের একজন। বললেন, অনেকেই এখন দেশে ফিরে আসছে। তার দুটি কারণ, এক. ইউরোপের আর্থিক দশা আগের মতো নেই; দুই. মরক্কোর অর্থনীতির উন্নয়ন শতকরা চার শতাংশ, যা ইউরোপের চাইতেও বেশি। সেই জন্যে অনেকে কাজের সন্ধানে ইউরোপ ছেড়ে চলে আসছে মরক্কোয়। এমনকি অনেক ইউরোপীয়ও এখন কাজের সন্ধানে আফ্রিকার দিকে ছুটে আসছে। কফি-ব্রেকে কথা হচ্ছিল আরেক স্বদেশ প্রত্যাগত মরক্কীয়র সঙ্গে। টানা ২০ বছর বেলজিয়াম থাকার পর তিনি স্ত্রী, দুই সন্তানসহ ফিরে এসেছেন নিজ দেশে। ফ্লেমিশ বলতে পারেন বিধায় আমার সঙ্গে তিনি অনেকটা সহজ হলেন। বললেন, ‘'ইউরোপ আর আগের মতো নেই, এখন তার আগের যৌবন নেই। আমার ছেলেমেয়েরা ভালো আছে এ দেশে, মানিয়ে নিয়েছে। স্ত্রী বেলজিয়ান, সে কারণে এখন মাঝে মধ্যে বেলজিয়াম যাই, খুব একটা দূর তো নয়, তাই সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার কোনো মানে হয় না’। তিনিও যোগ দিয়েছেন এই সেন্টারে। তা ছাড়া আমাদের দেশ এখন অনেক উন্নত, অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে, সাধারণের আয় বেড়েছে।

লেখক
লেখক

ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। মরক্কোর ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রাস্তাঘাট, যানবাহন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইউরোপের মতো না হলেও অনেকটা কাছাকাছি। রাস্তাঘাটে গাড়ি চলে ট্রাফিক আইন মেনে, অহেতুক গাড়ির হর্ন নেই, কে কার আগে যাবে চালকদের মাঝে এই প্রবণতা নেই। অনেক রাতে আমরা জনাকয়েক বিদেশি রেস্টুরেন্ট থেকে হেঁটে ফিরেছি হোটেলে, সমস্যাহীন। ছিনতাইয়ের ভয় ছিল না। দেখে ভালো লাগে। আবার খারাপ লাগে, নিজেকে বড় দৈন্য মনে হয় নিজের কাছে, দেশের কথা ভেবে। কোথায় পড়ে আছি আমরা! যখনই বিদেশ-সফরে যাই, এদিক-ওদিক তাকাই, কেবলই মনে হয়, আমরা কবে সভ্য হব, আমরা কবে নিয়ম মেনে চলতে শিখব। নিম্নআয়ের দেশ থেকে মধ্যমআয়ের দেশে উন্নত হলাম দাবি করে আমরা গলা ফেটে ফেলি, কত কিছুই না বলে বেড়াই, করি বড়াই। অথচ কী মেকি, ঠুনকো সে সমস্ত কথা। ঘর থেকে বাইরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ সমস্যা জোঁকের মতো ঘিরে ধরে। ট্রাফিক জ্যাম, হাঁটার জন্য নেই ফুটপাত, কেননা সে ফুটপাত অনেক আগেই বেদখলে গেছে হকারদের, কী করে—সে সবার জানা, ধুলোবালি ইত্যাদি ইত্যাদি। রাস্তায় চলে বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি, জনগণের বারোটা বাজিয়ে। রাতভর চলে কোথাও না কোথায় উচ্চস্বরে মাইক, রোগী, অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা, কিংবা সাধারণ জনগণের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা তার প্রতি বিন্দুমাত্র খেয়াল ও শ্রদ্ধা না রেখে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশের প্রচলিত আইনের কোনো তোয়াক্কা নেই কারও। দেশ থেকে ফিরে আসার দিন কয়ে আগে গুলশানে ডাচ দূতাবাসে মিটিং সেরে মিরপুর হয়ে নিউমার্কেট পৌঁছাতে গাড়িতে বসে থাকতে হয়েছে হয়েছে পাক্কা চার ঘণ্টা। ভাবা যায়! এই চার ঘণ্টায় হল্যান্ড থেকে ফ্রান্স পৌঁছা যায়, হেগ-ব্রাসেলস দুবার আসা-যাওয়া করা যায়। মরক্কো এসে নতুন করে এই কথাগুলোই কথাগুলো মনে এল।
যা হোক, রাবাত থেকে ফিরে আসার আগের দিন খাবার টেবিলে অনেকেই বলেন, রাবাত এসে যদি মেদিনা (মদিনা) মার্কেট ঘুরে না যাও তাহলে তোমার রাবাত দেখা হলো না। ইতিমধ্যে আমাদের অনেকে, বিশেষ করে নারীরা মেদিনা মার্কেট ঘুরে এসেছেন। তার একটি বিশেষ কারণও আছে, তা পরে জানতে পারি। আমার পাশে ছিলেন দুই নারী—একজন ইন্দোনেশীয়, অন্যজন ফিলিপাইনের। তারা ইতিমধ্যে মেদিনা মার্কেটে একবার গেছেন। আবারও যাবেন। উদ্দেশ্য এক ধরনের মরক্কীয় লোশন ও সুগন্ধি সাবান পাওয়া যায়, যা আপনার ত্বককে সতেজ ও সুন্দর রাখবে, তা কেনা। এই দুই নারীর সঙ্গী হলাম। হোটেল থেকে হাঁটার দূরত্বে এই প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মেদিনা মার্কেট। চারদিকে লালচে দেয়াল দিয়ে ঘেরা বিশাল এলাকা। ছোট্ট একটি গেট পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলি। পথের দুই ধারে মাটিতে পসরা সাজিয়ে বসেছেন অনেকে—খেলনা থেকে শুরু করে পরনের কাপড়, ঘরের নিত্য ব্যবহারিক জিনিসপত্র। কদ্দুর এগোতেই দুই পাশে সারিবদ্ধ দোকান। এগিয়ে গেছে সামনের দিকে, কখনো ডানে-বায়ে।
দর্শক-খদ্দরের ভিড়। দেশি-বিদেশি অনেকেই ভিড় করেন এই বাজারে। অনেকে আসেন কেবল দেখতে। এটিকে কেবল বাজার বললে ভুল বলা হবে। এর আকর্ষণই আলাদা। কথায় তাকে বর্ণনা করা যাবে না। চামড়ার ব্যাগ থেকে শুরু করে হরেক রকমের জুতা, মরক্কীয় কার্পেট, সুভেনিয়র, খাবারের দোকান, এক কথায় বলা চলে কী নেই, সবই মেলে এখানে। আমার সঙ্গে যে দুই নারী, বয়সের ভারে যাদের মুখের চামড়ায় ইতিমধ্যে ভাঁজ পড়েছে, হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন সেই বিশেষ স্কীন লোশন বা তেলের দোকান। তাদের কাছ থেকে জানলাম এই লোশনটি একমাত্র মরক্কোয় পাওয়া যায়। একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে অবশেষে মিলল তাদের কাঙ্ক্ষিত দোকান। চোখ ধাঁধানো এক সুন্দরী নারী দোকানে বসে। চমৎকার ইংরেজি বলেন। আনিস ও মাইকে (ইন্দোনেশীয় ও ফিলিপিনো সঙ্গী দুজন) একটি বোতল দেখিয়ে বলেন, এটি ব্যবহার করলে চামড়া সতেজ থাকবে, ভাঁজ পড়বে না। আনিস ও মাই উৎসাহিত হয়, ব্যাগে হাত দেয়। মনে মনে বলি, চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে? বলি বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমিও হাতে নেই ছোট্ট একটি শিশি, ঘরের-জনের জন্য। ছোট্ট শিশি এই কারণে আমার কেবল হ্যান্ড ব্যাগ আর ল্যাপটপ, পেছনের কোনো লাগেজ নেই, আর হ্যান্ড ব্যাগে ১০০ মিলি লিটারের বেশি তরল জাতীয় পদার্থ বহন করা নিষেধ। মনে মনে হাসি আর সঙ্গী দুই নারীর সে কী হাসি, যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে এল। (২৪ এপ্রিল ২০১৮)

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া: নেদারল্যান্ডস।