কেমন ছিল এনভার হোক্সার কমিউনিজমের দেশ আলবেনিয়া
‘আলবেনিয়া’ শব্দটি শুনলে আমাদের চোখের সামনে সবার প্রথমে যে নামটি ভেসে আসে, সেটি হলো এনভার হোক্সা। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আলবেনিয়া এবং এনভার হোক্সা—এ দুটি শব্দ ছিল একে অন্যের পরিপূরক। কেননা, তিনি দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়াভাবে দেশটির রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪১ সাল থেকে শুরু করে ১৯৮৫ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত এনভার হোক্সা আলবেনিয়ার তদন্তাধীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পার্টি অব লেবার বা পিএলএর ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি ১৯৪৪ থেকে শুরু করে ১৯৮৫ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কাছে ‘আইজেক’ নামটি অপরিচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে আইজেক হচ্ছে একটি আইজেক গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং অর্গানাইজেশন। আইজেক দাবি করে, তারা যুবসমাজে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে নেতৃত্ব গঠনের গুণাবলি বিকাশে কাজ করে থাকে। ১৯৪৮ সালে আইজেক প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১২৮টি দেশে আইজেক সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফার্স্ট সেমিস্টারের ফাইনাল শেষে দেড় মাসের ছুটিতে আইজেকের অধীনে গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাই, যার পরিপ্রেক্ষিতে আলবেনিয়াতে যাওয়া।
গ্লোবাল ভলান্টিয়ার প্রজেক্টের অংশ হিসেবে আমি দেশটির রাজধানী তিরানার উপকণ্ঠে রুয়া জর্দান মিসইয়ার নামের স্থানে একটি স্কুলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্কুলটি মূলত অস্ট্রিয়াভিত্তিক চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশনের অর্থায়নে নির্মিত। অর্থনৈতিক দিক থেকে আলবেনিয়া ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ দেশগুলোর একটি। দেশটির জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ তাই আজও নিম্নবিত্ত জীবন যাপন করে। দেশটিতে এমন অনেক মা কিংবা বাবা আছেন, তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্যটুকু নেই। স্কুলটি সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে।
তরুণ প্রজন্ম ছাড়া আলবেনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ ইংরেজিতে তেমন একটা পারদর্শী নয়। আলবেনিয়াতে অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, যদিও রাজধানী তিরানা কিংবা দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর দুরেসে আমাকে সে অর্থে ভাষাগত কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। তবে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রসারের কারণে দেশটিতে ইতালিয়ান সিনেমা বা টেলিভিশন সিরিয়াল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং এ কারণে দেশটির বেশির ভাগ মানুষ ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে—সেটা হোক ৭০ বছরের কোনো বয়োবৃদ্ধ কিংবা ৬ বছরের কোনো বাচ্চা।
রুয়া মিসইয়ার স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কিছুটা আলবেনিয়ান ভাষা শিখেছিলাম। বাচ্চাদের মধ্যে কেউই ইংরেজি জানত না সেভাবে। আমার কাজ ছিল স্কুলে কাজ করা শিক্ষকদের সহায়তা করা। পাশাপাশি অনেক সময় এসব বাচ্চার শিক্ষক হিসেবেও আমি কাজ করেছি। কখনো তাদের আমি ইংরেজি শিখাতাম। কখনো তাদের নিয়ে খেলতে যেতাম। কখনো তাদের সঙ্গে নিয়ে ড্রয়িংয়ে বসতাম, কখনো আবার বিজ্ঞানভিত্তিক মজাদার বিষয় নিয়েও তাদের সঙ্গে আলোচনা করতাম।
ইংরেজিতে সবকিছু বলার চেষ্টা করতাম এবং তাদের এক শিক্ষক সেটা নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে দিতেন। এ ছাড়া সপ্তাহে এক দিন স্থানীয় অধিবাসীদের বাসা পরিদর্শনে যেতাম ও তাদের জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতাম।
শেনজেনভুক্ত কোনো রাষ্ট্রের ভিসা কিংবা টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে কোনো ধরনের ভিসা ছাড়া আলবেনিয়ায় যাওয়া যায়। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারের পক্ষ থেকে পাসপোর্টে কেবল একটা অ্যারাইভাল সিল দেওয়া হয়।
দীর্ঘ দেড় মাসের মতো আলবেনিয়াতে অতিবাহিত করার সুযোগ হয়েছে। ফলে দেশটির সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে ভালোমতো পরখ করার সুযোগ হয়েছে।
আলবেনিয়াতে আসার পর এনভার হোক্সার প্রতি আমার আলাদা আগ্রহের সৃষ্টি হয়। সরেজমিন দেশটির সাধারণ মানুষের থেকেও এনভার হোক্সা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। এনভার হোক্সার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল তিনি বিশ্বের বুকে আলবেনিয়াকে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করেছেন। আলবেনিয়ানরা জাতিগতভাবে ইলিরীয় নামের এক লুপ্তপ্রায় জাতিগোষ্ঠীর বংশধর। বলকান উপদ্বীপে আড্রিয়াটিক সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে ইলিরিয়ানদের বসতি সেই প্রাচীনকাল থেকে, যদিও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ইলিরিয়ানদের সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য এখনো বের করতে পারেননি। আলবেনিয়ার সাধারণ মানুষের ভাষার আলবেনিয়ান। আলবেনিয়ান ও গ্রিক—এ দুটি ভাষা দক্ষিণ ইউরোপ তো বটে, গোটা ইউরোপের অন্যান্য ভাষা থেকে একেবারে আলাদা। গ্রিকদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলেও আলবেনিয়ানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তেমন একটা সমৃদ্ধ নয়। সুদীর্ঘকাল আলবেনিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল, যার প্রভাবে দেশটির সিংহভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। দেশটির সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অটোমানদের প্রভাব লক্ষণীয়।
১৯১২ সালে অটোমানদের থেকে আলাদা হয়ে আলবেনিয়া পৃথকভাবে নিজেদের স্বাধীনতার ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষে আলবেনিয়ার স্বাধীনতা ছিল বলকান যুদ্ধের একটি পরোক্ষ ফলাফল। ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, গ্রিস ও মন্টেনিগ্রো সম্মিলিতভাবে বলকান লিগ গঠনের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইতিহাসে একে প্রথম বলকান যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯১৩ সালের মে মাস পর্যন্ত এ যুদ্ধ স্থায়ী হয়। এ যুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হয়।
আজকের দিনে আমরা পৃথিবীতে যে আলবেনিয়ার মানচিত্র দেখি, সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম বলকান যুদ্ধের মাধ্যমে। তবে আলবেনিয়ার বাইরে পার্শ্ববর্তী দেশ কসোভোর শতকরা ৯০ ভাগের বেশি মানুষ আলবেনিয়ান ভাষায় কথা বলে এবং তারাও জাতিগতভাবে আলবেনিয়ান। অন্যদিকে উত্তর মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো ও গ্রিসেও একটি বড় অংশের মানুষের ভাষা আলবেনিয়ান। আলবেনিয়ানদের দাবি অনুযায়ী, প্রথম বলকান যুদ্ধের পর মূল আলবেনিয়ার সঙ্গে কসোভো এবং মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো ও গ্রিসের অংশবিশেষ নিয়ে একটি বৃহৎ আলবেনিয়া রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল, যার নাম গ্রেটার আলবেনিয়া। প্রথম বলকান যুদ্ধের পর কসোভো সার্বিয়ার দখলে চলে যায়। এ ছাড়া আলবেনিয়ানদের দাবি অনুযায়ী, গ্রেটার আলবেনিয়া নামের যে রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার কথা ছিল, সে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ এ সময় মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো ও গ্রিসের অধীনে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য বুলগেরিয়া মেসিডোনিয়ার অধিকার নিয়ে সার্বিয়া ও গ্রিসকে আক্রমণ করে। এভাবে শুরু হয় দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ, যদিও সার্বিয়া ও গ্রিসের সম্মিলিত সেনাবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে বুলগেরিয়ান সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সুযোগে রোমানিয়া বুলগেরিয়ার থেকে কিছু অংশ দখল করে নেয়। বুলগেরিয়ার মতো আলবেনিয়ার হাতে সংগঠিত কোনো সেনাবাহিনী ছিল না, যারা সরাসরি সার্বিয়া কিংবা গ্রিস অথবা মন্টিনিগ্রোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম।
সার্বিয়ানরা আলবেনিয়ানদের সব সময় যাযাবরের সঙ্গে তুলনা করত এবং তারা মনে করে, আলবেনিয়ানরা ইউরোপে এসেছে এশিয়ার কোনো দেশ থেকে। তারা আলবেনিয়ানদের বহিরাগত হিসেবে দেখে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে সার্বিয়ার নেতৃত্বে ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, স্লোভেনিয়া ও মেসিডোনিয়া সম্মিলিতভাবে যুগোস্লাভিয়া গঠন করে। এনভার হোক্সা আলবেনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্শাল টিটোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তবে কসোভোকে কেন্দ্র করে মার্শাল টিটোর সঙ্গে এনভার হোক্সার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কসোভোর বেশির ভাগ মানুষ জাতিগতভাবে আলবেনিয়ান, এ জন্য এনভার হোক্সা কসোভোকে আলবেনিয়ার সঙ্গে এক করে আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। তবে মার্শাল টিটো কখনো কসোভোকে আলবেনিয়ানদের অংশ হিসেবে স্বীকার করতে চাননি, তিনি কসোভোকে সার্বিয়ার অধীনস্থ একটি অঞ্চল হিসেবে দেখতেন।
স্বাধীনতার পর থেকে আলেবিয়ানদের মধ্যে আইডেনটিটি ক্রাইসিস নামের একটি বিষয় মুখ্যভাবে কাজ করত। এনভার হোক্সা আলবেনিয়ার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। প্রতিবেশী দুই দেশ যুগোস্লাভিয়া ও গ্রিসের সঙ্গে আলবেনিয়ার সুসম্পর্ক ছিল না। অন্যদিকে এনভার হোক্সা বাইরের দেশগুলো থেকে কোনো ধরনের সাহায্য গ্রহণ করতেন না। এ কারণে অর্থনৈতিকভাবে আলবেনিয়া খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। তবে হোক্সা দেশটির শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করেছেন। পাশাপাশি দেশটির চিকিৎসাসেবার মানকে আধুনিকায়নে ব্যাপক কাজ করেছেন। হোক্সা ছিলেন শিল্প-সাহিত্য ও চিত্রকলার সমঝদার। তাই আলবেনিয়ার শিল্প-সাহিত্য ও চিত্রকলাকে তিনি ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। এ কারণে একবিংশ শতাব্দীতে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় চলচ্চিত্র অঙ্গনে আলবেনিয়া ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
এটা ঠিক যে আলবেনিয়ার তরুণ প্রজন্মের অনেকে এনভার হোক্সকে সেভাবে পছন্দ করেন না। ব্যক্তিগতভাবে হোক্সা ছিলেন কার্ল মার্ক্স ও লেলিনের আদর্শের পৃষ্ঠপোষক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাই এনভার হোক্সার আলবেনিয়ার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান স্তালিনের মৃত্যুর পর একটা পর্যায়ে এসে দেশটির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু পদক্ষেপ, বিশেষত প্রতিবেশী যুগোস্লাভিয়ার ওপর থেকে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা ও শিল্পায়ন বাদ দিয়ে কৃষিকাজের প্রতি মস্কোর অতিরিক্ত উৎসাহ প্রদানকে হোক্সা ভালোভাবে নেননি। এ টানাপোড়েনের মধ্যে ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার সংস্কারবাদী বামপন্থী নেতা আলেক্সান্ডার ডুবেক ‘মানবিক সমাজতন্ত্র’ স্লোগান সামনে রেখে দেশটির শাসনব্যবস্থায় উদারপন্থী সংস্কার শুরু করেন। ডুবেকের প্রস্তাবিত সংস্কারে জনগণের ওপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করাসহ এমন কিছু কার্যক্রম ছিল, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। সে বছরের আগস্টে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মিত্রদেশগুলোর সম্মিলিত সেনাবাহিনী তাই ডুবেককে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। এ আগ্রাসনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ওয়ারশ প্যাক্টে স্বাক্ষর করা অনেক দেশের সমর্থন ছিল না। যদিও তারা কেউই সোভিয়েত বলয় ত্যাগ করেনি।
কিন্তু এনভার হোক্সা ওয়ারশ প্যাক্ট থেকে আলবেনিয়ার নাম প্রত্যাহার করে নেন। আলবেনিয়া সোভিয়েত ব্লক থেকে বেরিয়ে যায়। চীনের সঙ্গে এনভার হোক্সার প্রশাসনের সুসম্পর্ক থাকলেও একটা পর্যায়ে সে সম্পর্কে ভাটা পড়ে। অন্যদিকে আদর্শগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গেও তিনি সখ্য গড়ে তুলতে পারেননি। তাই তাঁর মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করত, যেকোনো সময় আলবেনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা চীন কিংবা ন্যাটোর সামরিক অভিযানের সম্মুখীন হতে পারে। এ কারণে বহিঃশক্তির আগ্রাসন, বিশেষ করে পারমাণবিক ও রাসায়নিক হামলা থেকে আলবেনিয়াকে রক্ষা করতে তিনি আলবেনিয়ার বিভিন্ন স্থানে বাঙ্কার নির্মাণ করেন। আলবেনিয়া তাই বাঙ্কারের দেশ হিসেবেও পরিচিত।
যাঁরা এনভার হোক্সাকে পছন্দ করেন না তাঁদের মতে, এনভার হোক্সার শাসনামলে আলবেনিয়া ছিল আজকের দিনের উত্তর কোরিয়ার মতো গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রনায়ক কিম জং–উনের মতো একচেটিয়াভাবে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে আলবেনিয়া শাসন করেছেন বলে তাঁরা উল্লেখ করেন। ভিয়েতনাম ছাড়া কোনো দেশের সঙ্গে আলবেনিয়ার শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছিল না। অবশ্য ইতালিসহ বেশ কিছু দেশের সঙ্গে এনভার হোক্সা তখনো সম্পর্ক রেখেছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল কেবল বাণিজ্যিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। সে সময় বাক্স্বাধীনতার বিষয়টিও আলবেনিয়াতে অনেকটা উপেক্ষিত ছিল বলে তাঁরা দাবি করেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, সর্বক্ষণ তিনি গুপ্তবাহিনী দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর নজর রাখতেন। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে সে সময় আলবেনিয়ার বাইরে অন্য কোনো দেশ ভ্রমণ করতে পারার বিষয়টি ছিল এক অবাস্তব কল্পনার মতো। বিদেশি নাগরিকদেরও সহজে আলবেনিয়া ভ্রমণে অনুমতি মিলত না।
এনভার হোক্সার জন্ম হয়েছিল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এবং তাঁরা মা–বাবা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু এনভার হোক্সা আলবেনিয়া থেকে সব ধরনের ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করছিলেন। মসজিদ, গির্জাসহ ধর্মের স্বাক্ষর বহন করে এমন সব প্রতিষ্ঠানকে তিনি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে দীর্ঘদিন দেশটির সাধারণ মানুষ ধর্মচর্চার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আলবেনিয়ার বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে তাই সেভাবে ধর্ম সম্পর্কে ধারণা নেই বললে চলে। এনভার হোক্সা ছিলেন অকাট্যভাবে ধর্মবিদ্বেষী। বর্তমানে অবশ্য দেশটিতে ধীরে ধীরে ধর্মের প্রসার ঘটছে এবং অনেকেই নিজ নিজ ধর্মে ফিরে আসছে। তুরস্ক, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ আলবেনিয়াতে বিনিয়োগ করছে এবং দেশটিতে নতুনভাবে মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া ইসলাম ধর্মের পুনর্জাগরণের জন্য আলবেনিয়াতে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি খ্রিষ্টান মিশনারি সংস্থাগুলোও বসে নেই। দেশটিতে বসবাসরত জনসাধারণকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য তারাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৮৫ সালের ১১ এপ্রিল এনভার হোক্সার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর ৫ বছর পর আলবেনিয়া থেকে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পশ্চিমা দেশগুলোসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলবেনিয়ার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। দেশটির সাধারণ মানুষ আজ যেকোনো দেশে যাতায়াত করতে পারে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক আলবেনিয়াতে বেড়াতে আসেন। তবে আজও আলবেনিয়া অর্থনৈতিক দুর্দশা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া