আমি মার্ক। একজন আমেরিকান সাংবাদিক। থাকি আমেরিকার সান ডিয়াগো শহরে। পাহাড় সমুদ্রের কোলে অপূর্ব এক শহর। নীল আকাশটা মিশে যায় ওই দূরে সাগরের সঙ্গে। পৃথিবীর বুকে একটুকরো স্বর্গ। পেশার জন্য কত দেশ ঘুরেছি, কিন্তু সব সময়ই মনে হয়েছে ফিরে আসি এখানেই। এখন এই ৫০ ছুঁই ছুঁই বয়সেও আমি একা। কেন একা, এ তথ্যটুকু কারও জানা নেই। হয়তো কখনোই জানাতাম না। কিন্তু আজকে মনটা আমার উদাস। সাগরের পারে বসে আছি উথাল–পাতাল জোছনায়। হাত–ধরাধরি করে কত কত জুটি দৌড়ে যাচ্ছে পানির দিকে, ছোট ছোট জটলা করে বারবিকিউ করে গান গেয়ে আনন্দময় করে রাখছে বিচ কত মানুষ। কেন যেন বহুদিন পর মনে হচ্ছে, কারও হাত ধরে আমিও হাঁটি বালুচরে। সে গান গাইছে ঢেউয়ের সুরে সুর মিলিয়ে।
কারণটা অদ্ভুত। ডিনার খেতে গিয়েছিলাম ক্রোরান নামে একটা রেস্তোরাঁতে।
নামডাক শুনেছি রেস্তোরাঁটার অনেক, কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি। একটা রিপোর্ট নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিলাম গত কয়েক দিন। তাই স্পেশাল ট্রিট দিতে গেলাম নিজেকে, বন্ধুর সঙ্গে মজার কিছু খেতে। কেমন যেন ঘরোয়া পরিবেশের রেস্তোরাঁটা, ঢুকে ধাক্কা খেলাম উইঘুর মুসলিম ছেলেদের বিয়ের টুপি দিয়ে সাজানো দেয়াল দেখে, অন্য পাশে আছে মেয়েদের টুপিও। বাদ্যযন্ত্রগুলো দেখে মনে হচ্ছে, এক্ষুনি বাজাতে পারব। বসে আছি বন্ধুসহ টেবিলে, খাবারের অর্ডার দেব। এমন সময় হেঁটে এল যেন নূর। সেই চোখ, সেই হাসি, সেই প্রাণচাঞ্চল্য। আমি অপলকে তাকিয়ে আছি দেখে সে বলল, স্যার, কোনো ড্রিংকস অর্ডার দেবে? আমি ঘোরের মধ্যে বললাম, ডালিম ফ্লেভারের লাচ্ছি আছে? নূরের মতো মেয়েটা হেসে বলল, এই না তোমার বন্ধু বলল তোমরা প্রথম এসেছ খেতে আমাদের রেস্তোরাতে? জানলে কীভাবে আমাদের স্পেশাল ড্রিংক সম্পর্কে? একটু হাসলাম, তুর্কি বংশোদ্ভূত উইঘুর মুসলিমদের ওপর একটা রিপোর্ট আমি করেছিলাম। তখন ছিলাম চীনে কিছুদিন। বন্ধু হেসে বলল সার্ভার মেয়েটাকে, বন্ধু আমার সাংবাদিক। সে জন্যই জানে সে। ছিলে তুমি চীনে? জানো আমাদের কথা? নূরের মতো মেয়েটার বিস্ময় আর কমে না। বুকে পাথর সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটাকে, তোমার মায়ের নাম কী? মেয়েটা বলল, গুলজাবীন ওরফে নূর। আমার পুরো পৃথিবী দুলে উঠল।
ফিরে গেলাম ২৬ বছর আগের কোনো একটা সময়ে। উইঘুর মুসলমানদের ওপর রিপোর্ট করতে গিয়েছি তখন আমি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে। উঠতি সম্ভাবনাময় সাংবাদিক। সাহসিকতাপূর্ণ রিপোর্টের জন্য প্রশংসা পাচ্ছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে পৃথিবী পাল্টে ফেলব। জীবনের নতুন নতুন মানে খুঁজছি নিজে ভালো থাকার আর পৃথিবীকে ভালো রাখার। সুন্দর একটা অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছি। রোজ যাই উইঘুর মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলতে, ওনাদের পাওয়া না পাওয়ার কথা জানতে। শুনলাম, বিশাল দেয়ালঘেরা কারেকশন সেন্টার আছে শহরের কাছে। ওদিকে গেলে তেমন কেউ ফিরে আসে না। তবে এর বেশি কিছু কেউ বলতে চায় না। এমন সময় একদিন এক দোকানে খেতে বসেছি, আমারই বয়সী এক মেয়ে, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা, খাবার দিচ্ছিল আর গলা নামিয়ে বলছিল, মার্ক না তোমার নাম? সাংবাদিক না? নিয়ে যেতে পারবে আমাদের সুস্থ কোনো পৃথিবীতে? যেখানে ইচ্ছেমতো হাসতে পারব ভয়ের পাথর বুক থেকে সরিয়ে? মাথা নাড়লাম আমি, অবশ্যই পারব।
নূরের সঙ্গে সেই থেকে পরিচয়। পরবর্তী কয়েকটা মাস নূর আমাকে ওদের পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, ওদের সংস্কৃতি শেখাল, রোজ সন্ধ্যার পর গান শুনতে যেতাম আমি ওদের। বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখলাম। নূরের মামার বিয়েতে নেচে সবচেয়ে ভালো নাচিয়ে হিসেবে হাতে তৈরি কারুকাজ করা টুপি পেলাম। জানলাম, বিয়ের সময় এই টুপিতেই লম্বা এক্সটেনশনসহ থাকে। ওদের বঞ্চনার কিছু কিছু কথা রিপোর্ট আকারে লিখে পাঠাতে থাকলাম।
এক বিকেলে নূর আমাকে নিয়ে গেল ওর এক খালার কাছে। ওর খালাকে সংশোধনী ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল মাস কয়েক। ইন্টারভিউ নিলাম ওনার, তীব্র শারীরিক অত্যাচারে মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন তিনি। সব গুছিয়ে লিখতে হবে, ওনার বাসা থেকে বের হতে বেশ রাত হয়েছিল সেদিন। নূর আমার সঙ্গেই ছিল। হঠাৎ অনুমতি নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী তরুণীর হাতটা ধরলাম। বললাম, চলো নূর, স্বর্গের কাছাকাছি পাহাড়–সমুদ্রের দেশে। শুরু করি নতুন জীবন। বিয়ে করবে আমাকে? চাঁদের আলোয় আলোকিত নূর বলেছিল, অবশ্যই।
পরদিন খুব ভোরে নূরের ছোট ভাই এল আমার অ্যাপার্টমেন্টে কাঁদতে কাঁদতে। নূরকে ধরে নিয়ে গেছে কারেকশন ক্যাম্পে। বহু ছোটাছুটি করলাম, কিন্তু নূরকে আর কোনো দিন দেখতে পাইনি। ওরা ডিপ্লোম্যাট হিসেবেও নূরের কোনো হদিস দেয়নি আমাকে। বেঁচে ছিলাম কিছুদিন জীবন–মৃত্যুর মাঝামাঝি। কীভাবে আমার পরিবার আমাকে সান ডিয়াগো এনেছে, আমি জানি না। কীভাবে মনকে শক্ত করে সাংবাদিকতা করে মানবসেবা করে যাচ্ছি গত ২৫ বছর, আমি জানি না।
হঠাৎ নূর যেন পাশে এসে বসল আমার। বলল, আঙ্কেল মার্ক, আমি আন্টি নূরের ছোট ভাইয়ের মেয়ে, আমার মায়ের নামও নূর, কিন্তু ফুফুর সম্মানে আমার নামও রাখা হয়েছে নূর। আমি নাকি ওনার মতো দেখতে। তোমার কথা আমরা অনেক শুনেছি বাবার কাছে আর শহরের সবার কাছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সান ডিয়াগো শহরে এসেছি আমরা, গড়েছি পারিবারিক রেস্তোরাঁ। একটা টুপি বোধ হয় তোমার ছিল বাবার কাছে সযত্নে রাখা। নেবে? ঝাপসা চোখে হাত বাড়িয়ে টুপিটা নিলাম। তারপর চলে যেতে দেখলাম আমার নূরকে দূরে, চাঁদের দেশে, আমার চুলে রুপালি আভাস, কিন্তু এ সেই আগের উচ্ছ্বল নূর।
মেয়েটাকে বললাম, মামণি, ধন্যবাদ তোমাকে।