কেন এ শঙ্কা

করোনার কারণে প্রায় দুই বছর পর দেশে গিয়েছিলাম বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। দেশের সবকিছু অতি আপন। এসে দুদিন পর ছুটলাম ফুচকা খেতে গুলশান-২-এর প্রিমিয়ামে। আজন্ম বেড়ে ওঠা প্রিয় দেশ, খাবারের স্বাদ, মা ও মাটির গন্ধ। ফুচকা খেয়ে নিচে নামতেই একটা গলা শুনলাম, ‘আপু ভয় পাবেন না। একটু সাহায্য করবেন? দোয়া করব অনেক।’ তাকিয়ে দেখলাম, তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ। শান্ত-ভদ্র, স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি দূরে দাঁড়িয়ে। খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভয় পাব কেন?’ আমার মতোই একজন মানুষ, জন্মের সময় বা পরে  হরমোনের জটিলতার কারণে যিনি পুরোপুরি নারী বা পুরুষ হতে পারেননি, কিন্তু স্রষ্টার অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীর অংশ তিনি। কৌতূহলবশত বলে বসলাম, ‘একটু কথা বলা যাবে আপনার সঙ্গে?’ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন তিনি।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে বুদ্ধি আছে। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে চলছেন কেন?’ তিনি বললেন, খুব ছোট্ট বেলায় তাঁকে তাঁর মা-বাবা কোনো একটা তৃতীয় লিঙ্গ পরিবারে দান করে গিয়েছিলেন। মানুষ হয়েছেন পথে। পড়াশোনা শিখেছেন কিছুটা নিজের ঐকান্তিক চেষ্টা আর গুরুর সহায়তায়, কিন্তু ভালো কোনো চাকরি জোটাতে পারেননি। তাই মানুষ হয়েও ভালো কিছুতে অংশ নিতে পারছেন না।
অনেক এগিয়েছে সমাজসহ এখন পুরো বিশ্বে, হাসপাতালের বাথরুমগুলোতে নারী বা পুরুষ বদলে অ্যানি জেন্ডার সাইন আসতে শুরু করেছে এ দেশে, পাশাপাশি চাকরি করছি তাঁদের সঙ্গে। তাঁদের মানুষ হিসেবে মেনে নিয়ে নাগরিকত্বের সব সুবিধা দিয়ে সমান অধিকারের দাবি রাখছি আমার মাতৃভূমিতেও। যাতে বুদ্ধিতে ঝলমল করা একজন লিঙ্গপ্রতিবন্ধী মানুষের চোখে চোখ রেখে বলতে পারি, আপনিও এ সার্বিক উন্নয়নের অংশ, সাহায্যপ্রার্থী না।

প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলছি আপাতত। করোনাকালে আমার এক অতি আপনজন রাস্তাঘাটে কুকুরদের খাওয়ানোর প্রজেক্ট হাতে নিলেন। মানুষের সহায়তায় পাশাপাশি অল্প হলুদ চাল আর মাংস দিয়ে খাবার রান্না করে খুব ভোরে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় কুকুরদের খাইয়ে বাসায় ফিরতেন তিনি। করোনাকালে সব হোটেল বন্ধ থাকাতে সারমেয় সন্তানেরা নাকি মরতে বসেছে। বিড়াল, কাকের খাবার কর্মসূচির পর এখন কুকুরের সেবা। তাঁর যুক্তি, পৃথিবীটা সবার, শুধু মানুষের না। একটা কুকুর নিচে এখন তাঁর গ্যারেজে থাকে। আমি ছোটবেলা থেকেই ভয় নিয়ে মানুষ হয়েছি কুকুর-বিড়ালের প্রতি। কিন্তু ‘লালি’কে দেখলাম। শান্ত, নিজের বাসাকে রক্ষা করতে ব্যস্ত এবং কী প্রচণ্ড বন্ধুসুলভ। ভালোবাসার কাঙাল, থাকে নিচে গ্যারেজে। যাঁদের সামর্থ্য আছে, গ্যারেজের কোনায় একটু আশ্রয় বা রাস্তায় একটু খাবার কি এদের দেওয়া সম্ভব? পালতে হলে বিদেশি ব্রিড লাগবে কেন? দেশি কুকুর ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কম দিতে জানে না।

পরিশেষে লোকালয়ে কারখানা করা নিয়ে তীব্র আপত্তি নিয়ে শেষ করছি। মিরপুরে আমাদের বাসা। প্রতিবার গিয়ে নতুন হালে চমকে যাই। গত কয়েক বছর বাসার এক পাশে দেখলাম কাঠের ফার্নিচার তৈরির কারখানা, অতি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিকট শব্দ। এবার গিয়ে দেখি, দুই দিকে কাঠের কারখানা, মধ্যে ম্যাট্রেস তৈরির কারখানা। রাত-দিন তীব্র শব্দ সঙ্গে বিড়ির গন্ধ, কাঠের গুঁড়া আর ম্যাট্রেসের বর্জ্যের কারণে বায়ুদূষণে শ্বাস নেওয়া দায়। সঙ্গে উৎকট গান। সবাই বিশাল দালান বানিয়ে ফ্ল্যাটের উঠে টাকার গন্ধ শুঁকে সুখী হতে পারে না। আমাদের মতো মাটির গন্ধ খোঁজার লোকের অভাব নেই। যেখানে মানুষ থাকবে, সেখানে কারখানা করার অনুমতি এরা পায় কোথায়?