কিশোর অপরাধ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাংলাদেশে বর্তমানে অপরাধের ধরন পাল্টে গেছে। অপরাধ শব্দটির মধ্যে একধরনের অপরাধী গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে শব্দটির কোনো দোষ নেই। আমরা এই শব্দকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করি। পৃথিবীতে কোনো মানুষই অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণেই মানুষ অপরাধের বেড়াজালে আটকে পড়ে।

অনেক ছোট থাকতে আমরা লুকিয়ে বাঁশ বাগানের ভেতরে গিয়ে পয়সা খেলতাম। বড় ভাই অথবা বাবার চোখে পড়লে রক্ষা নেই, এমনকি পাড়ার মুরুব্বিদের দৃষ্টিগোচর হলেও শাস্তি অবধারিত ছিল। আশির দশকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কিশোরদের পয়সা খেলা ছিল এক ধরনের অপরাধের। আর এখন কিশোরেরা বাবা-মার জানা মতে ড্রাগ নিচ্ছে! আমি একটি পরিবারকে চিনি, বাবার অজান্তে মা ছেলের ড্রাগের পয়সার জোগান দিচ্ছেন। মা নিরুপায় হয়ে ছেলেকে ড্রাগের টাকা দেন, নয়তো সে আরও বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে! এখন আমাদের সমাজে কিশোরদের অপরাধ চোখে পড়ার মতো। মহল্লার গলির কোনায় কোনায় জমজমাট আড্ডা বড়দের হরহামেশা বিব্রত করছে। তাদের আড্ডার পাশ দিয়ে পাড়ার মুরুব্বিরা খুব সংকুচিত মন নিয়ে দ্রুত হেঁটে যেতে বাধ্য হন, তা না হলে, তাদের অপমানিত হওয়ার ভয় থাকে। অপরাধের রকমফের আজ আমাদের সমাজের অবকাঠামোকে বিগড়ে দিচ্ছে।

আমাদের সময় এক পাড়ার ছেলেদের অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলা নিয়ে মারপিট করতে দেখা যেত। লাঠিসোঁটা নিয়ে একে অন্যকে দৌড়ানি দেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল মারপিটের ধরনগুলো। মূলত তখন মানুষের হৃদয়ে রহম ছিল। বেদমভাবে একে অন্যকে মারতে তখন দেখা যেত না। মারপিট হলেও খুব বেশি জখম হতে কখনো দেখিনি। বর্তমানে গ্যাং কালচার বিস্তারের কারণে এক গ্রুপের ছেলেদের অন্য গ্রুপের ছেলেদের রামদা দিয়ে কোপাতে দেখা যায়। এমনকি অস্ত্র দিয়ে হত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না। রহম ও আদব-কায়দার ব্যাপারটি মনে শিশু-কিশোরদের অন্তর থেকে ক্রমশ কমে যাচ্ছে। আমাদের সময় পাড়ার মুরুব্বিদের ভয়ে কিশোররা সবসময় ইতস্তত থাকত। আর আজকাল পাড়ার মুরুব্বিরা কিশোরদের ভয়ে এলাকায় মাথা নত করে চলেন।

লেখক
লেখক

লন্ডনে আসার আগে এলাকায় চলাচল করতে প্রায় ইতস্তত অনুভব করতাম। পাড়ার অল্প বয়সী ছেলেদের আড্ডা ও কার্যকলাপ আমাকে ব্যথিত করত। রাজনৈতিক ছত্রছায়া নিয়ে তারা শক্তিশালী হতো। কেউ তাদের অন্যায় কাজে বাধা দিতে পারত না। বাংলাদেশে আমার পেশা ছিল শিক্ষকতা। শিক্ষক হওয়ার কারণে এমন বখে যাওয়া কিশোরদের অশালীন কার্যকলাপ আমাকে অন্যদের তুলনায় খানিক বেশিই কষ্ট দিত বৈকি।

লন্ডনে আসার পর এখানকার কিশোরদের গ্যাং কালচার দেখে আমাদের এলাকার কথা মনে পড়ে যায়। তবে বাংলাদেশে যে হারে কিশোর অপরাধ বাড়ছে তার তুলনায় এখানে তা কিছুই না। তবুও বর্তমানে কিশোরদের নাইফক্রাইম ব্রিটেনের প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই নাইফক্রাইমের মূল কারণ কিশোরদের মাঝে গ্যাং কালচারের বিস্তার। লন্ডনে বিভিন্ন এলাকার রাস্তাগুলোতে গাড়ি চালাতে গিয়ে আমি প্রায়ই একটি সমস্যার মুখোমুখি হই, তা হলো কিশোরদের দলবেঁধে সাইকেল চালানো। তারা ইচ্ছে করেই গাড়ির সামনে এসে সাইকেল দিয়ে ভেলকি মেরে ভয় লাগিয়ে দেয়। ভয় লাগানোর পর চালকের দিকে বাঁকা চোখে তাকায় আর অসম্ভব খারাপ ভঙ্গি করে। গাড়ি চালকের কিছুই করার থাকে না। এমন পরিস্থিতে আমার খুব রাগ হয়।

পৃথিবীতে কোনো কিশোরই অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না। পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাকে অপরাধী করে তোলে। আর অপরাধী হওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ সময় হলো কিশোর বয়স। আজকাল আমাদের দেশে কিশোর অপরাধ খুব বেড়ে গেছে এবং কিশোর অপরাধ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। এই অপরাধ দমনের জন্য পারিবারিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। পারিবারিক কলহ কিশোর মনকে বেশি প্রভাবিত করে। পরিবার থেকে যদি শ্রদ্ধাবোধ না শেখে সে তো শ্রদ্ধাবোধ জিনিসটি শিখবে না। একজন শ্রদ্ধাবোধহীন বালকই সহজেই যেকোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কারণ তখন তার চোখের লজ্জার পর্দা সরে যায়।

কিশোররাই একটি দেশের ভবিষ্যৎ। তাই তাদের প্রতি যত্ন নেওয়া বেশি বেশি দরকার। একটি সুখী পরিবারই দেশকে উপহার দিতে পারে একটি সুচিন্তিত কিশোর, যে গড়বে একটি সুস্থ সমাজ তথা একটি দেশ।
মোহাম্মদ আবদুল মালেক: লন্ডন, যুক্তরাজ্য।