কানাডায় গার্মেন্টস শিল্পের আন্তর্জাতিক মেলায় বাংলাদেশ

মেলায় বাংলাদেশের বুথ
মেলায় বাংলাদেশের বুথ

কানাডার টরন্টোয় অনুষ্ঠিত হলো দ্য অ্যাপারেলস টেক্সটাইল সোর্সিং কানাডা (ATSC) এক্সপো (২০১৬) শীর্ষক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। তিন দিনব্যাপী এ মেলা ২২-২৪ আগস্ট টরন্টোর পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ মেলায় বাংলাদেশ ১৪টি বুথ নিয়ে অংশগ্রহণ করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএর সমন্বয়ে গঠিত ৩২ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব প্রাণেশ রঞ্জন সূত্রধর। কানাডার বাংলাদেশ হাইকমিশন এ বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় করে।

কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজানুর রহমান বিশেষ অতিথি হিসেবে এই মেলায় যোগ দেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে আগত অংশগ্রহণকারী কোম্পানিসমূহের বুথগুলো ঘুরে দেখেন ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। মিজানুর রহমান কানাডায় পণ্য রপ্তানি ও নতুন বাজার সম্প্রসারণে হাইকমিশনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। রপ্তানিকারকেরা সামগ্রিক এ আয়োজনে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনের ভূমিকার প্রশংসা করেন ও মিজানুর রহমানকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশ দূতাবাসের বাণিজ্যিক উইংয়ের প্রথম সচিব দেওয়ান মাহমুদ ও বাংলাদেশ বিজনেস চেম্বার অব কানাডার সভাপতি সুবীর কুমার দে, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি জাফর ওসমান, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড রেসপনসিবল অ্যাক্রেডিটেশন প্রোডাকশনের (WRAP) প্রেসিডেন্ট ও সিইও অ্যাভেডিস সেফারেইন, মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ জেপি কমিউনিকেশনস ইনক্ ইউএসএ-র সিইও জেসন প্রেসকট ও মেলা পরিচালক জন ব্যাংকার এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

মেলায় বাংলাদেশের বুথ
মেলায় বাংলাদেশের বুথ

মেলার প্রথম দিনে লিড টাইম অপটিমাইজেশন, সোর্সিং, কাস্টমার এনগেজমেন্ট, সাপ্লাই চেইন ও রিটেইল বিজনেস সংক্রান্ত ছয়টি বিজনেস সেশন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও চীন থেকে আগত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা এ সেশনগুলোতে বক্তব্য ও বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। দুপুরে এক ফ্যাশন শোর মাধ্যমে কানাডীয় মডেলরা তুলে ধরেন মেলায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের রকমারি ডিজাইনের তৈরি পোশাক। পরে আয়োজক সংস্থা আয়োজিত এক নৈশভোজে যোগ দেন মিজানুর রহমান, প্রাণেশ রঞ্জন সূত্রধর ও দেওয়ান মাহমুদ। আয়োজক সংস্থার সিইও জেসন প্রেসকট, টরন্টোর মিসিসাগার সাবেক মেয়র হেজেল ম্যাককালিয়ন, চাইনিজ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শাখার পরিচালক চেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আমেরিকা ও বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্পোদ্যোক্তারা এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতা গ্রুপ ও মিডিয়ার প্রতিনিধিরাও এই নৈশভোজে যোগ দেন। এ সময় আয়োজক কর্তৃপক্ষ মেলায় বাংলাদেশের সফল অংশগ্রহণ ও দূতাবাস থেকে সার্বিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এ মেলা আয়োজন ও বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ইতিবাচক ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন আয়োজকেরা।

মেলায় বাংলাদেশের বুথ
মেলায় বাংলাদেশের বুথ

মেলার দ্বিতীয় দিনে অংশগ্রহণকারী রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রেতা কোম্পানিসমূহের ওয়ান-টু-ওয়ান ম্যাচমেকিং বৈঠকের আয়োজন করা হয়। ক্রেতা কোম্পানিসমূহ বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন ও স্পট অর্ডার প্লেস করেন। মোট ৪.৩৮ মিলিয়ন ডলারের স্পট অর্ডারের প্রতিশ্রুতি এবং ৩ লাখ ডলারের কনফার্ম অর্ডার পান বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা। এ দিন পর্যায়ক্রমে আটটি বিজনেস সেশন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ওপর অনুষ্ঠিত সেশনটির শিরোনাম ছিল 'Least Developed Countries-How Canadians Can Benefit'. এতে প্যানেল বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন কানাডার ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের সিইও স্টিভ টিপম্যান, মন্ট্রিয়েলের টেক্সটাইল এক্সপার্ট অ্যাবি লিপম্যান ও দেওয়ান মাহমুদ। প্যানেল বক্তারা কানাডায় এলডিসি রাষ্ট্রসমূহের কোটা ও ট্যারিফমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে দেওয়ান মাহমুদ বাংলাদেশের সর্বশেষ শ্রম পরিস্থিতি, রানা-প্লাজা পরবর্তী উদ্ধার, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের সরকারি কর্মযজ্ঞ, শ্রমিক অধিকার রক্ষায় বর্তমান সরকারের গৃহীত কার্যক্রম, সকল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ইন্সপেকশন, কর্মপরিবেশের মান উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী পদক্ষেপসমূহের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে (এসইজেড) প্রদত্ত সুবিধাদি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর রেয়াতের উদার নীতিমালার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য কানাডীয় ও মার্কিন উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানান।
মেলার তৃতীয় দিনে অনলাইন সোর্সিং, সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স, টার্কিশ ইকোনমি অ্যান্ড অ্যাপারেলস, কনজুমার ও ব্রান্ড সাসটেইনেবিলিটি, নাফটা চুক্তির প্রভাব, গ্লোবাল এথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং, ফ্যাশন এডুকেশন এবং মাল্টি চ্যানেল ও সেকেন্ডারি মার্কেট বিষয়ক আটটি পৃথক প্যানেল আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা এতে বক্তব্য ও অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্নের জবাব দেন।

অ্যাপারেল সোসিং বিজনেস সেশনে বক্তারা
অ্যাপারেল সোসিং বিজনেস সেশনে বক্তারা

রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার শিল্পের বৃহৎ পরিসরের সোর্সিং মেলা কানাডায় এই প্রথম আয়োজিত হলো। চীন, বাংলাদেশ, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, তাইওয়ান, পেরু, জর্ডান, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, আমেরিকা ও কানাডার ১৮৫টি রপ্তানিমুখী শিল্পোদ্যোক্তা, ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, ট্রেড ফ্যাসিলিটেটর এবং বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা এ মেলায় অংশগ্রহণ করেন। ব্যাপক বাণিজ্য সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি ও নতুন বাজার সম্প্রসারণের আশাবাদ নিয়ে শেষ হয় অ্যাপারেলস টেক্সটাইল সোর্সিং কানাডা এক্সপো ২০১৬। বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারী কোম্পানিসমূহের মধ্যে ছিল এ্যন্থনি ইয়াং গার্মেন্টস, আরএস সোয়ের্টাস, চরকা টেক্সটাইল, হবিগঞ্জ টেক্সটাইল, মারমেইড সোয়েটার্স, স্যাটকো বাংলাদেশ, ইউনাইটেড অ্যাপারেলস, মেট্রো নিটিং অ্যান্ড ডাইং মিলস, জাবন অ্যাপারেলস লি, রাজধানী অ্যাপারেলস, আইএল বাংলা, জ্যানটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ডাল নিটওয়্যার, আইএসটি ফ্যাশনস ও মার্লিন নিটওয়্যার। এই মেলা আগামী দুই বছরে বাংলাদেশের জন্য প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক রপ্তানি সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা।
মেলার শেষ দিনে প্রদর্শিত পোশাকসামগ্রীর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অনুদান হিসেবে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ব্র্যান্ডস ফর কানাডার নির্বাহী পরিচালক হেলেন হ্যারাকাসের কাছে হস্তান্তর করেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা, যা কানাডায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি উন্নয়নে ব্যাপক ইতিবাচকতার সঙ্গে আলোচিত হয়। উল্লেখ্য, আগামী বছরে একই সময়ে আবারও অনুষ্ঠিত হবে অ্যাপারেলস টেক্সটাইল সোর্সিং কানাডা শীর্ষক এই গার্মেন্টস রপ্তানি মেলা।