মা

‘কাইল সারা রাইত কেমন সুন্দর বৃষ্টি হইল! বৃষ্টি কেন হয়? বৃষ্টি দেখলেই মনডা কেমন জানি হইয়া যায়! ইচ্ছা করে সংসারের এই শিকল খুইলা কোথাও চইলা যাই। বিয়ার আগে কত ভিজছি বৃষ্টিতে। মা বাড়িত থাকত না ইচ্ছেমতো ভিজতাম। ব্যাপারীগো পুকুর ঘাটের পানিতে কী সুন্দর বৃষ্টির ফুল ফুটত!

শ্রাবণ মাসে বিয়া হইল, কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি! একবার মানুষটারে বলছিলাম, চলেন বৃষ্টিতে ভিইজা আসি?

তার পরদিনই দুইটা তাবিজ আইনা আমার হাতে বাইন্ধা দিছে!
কি, বড় বউ শুইয়া থাহে কেন সারা দিন? আমি কি তোমার ঘরের কাজের বেডি, আমারে কি তোমার জমিদার বউয়ের ফরমাশ করাইতে আনছ?

তোর হতিন রে তুই কইতে পারস না? সব কয়টা একই রহম হারামি, সারা দিন কামকাজ নাই, খালি খাওন আর ঘ্যানঘ্যান!

ওই উঠ, উঠ। অইছে কী তোর হে, কামের ডরে বং ধইরা শুইয়া থাকস দেহি সারা দিন?
চুল ছাড়েন, ছাড়েন ব্যথা লাগে।

আহা আমার ননির পুতুল, একটু ছুঁইলেই ব্যথা পায়! হতিনের লগে যাইয়া কাম কর, নাইলে লাথি দিয়া ঘরতে বাইর কইরা দিমু। আকামলার দল!

দুই দিন ধইরা না খাওয়া। কাল রাইতে যে কয়ডা ভাত আছিল ছোড বউ আর জামাই খাইয়া ফেলছে। শইলডা কয় দিন ধইরা এত খারাপ লাগে কেন?

বছর দেড়েক আগে বড় বইনের জামাইর বাড়ি আসছিলাম বেড়াইতে। আফায় বুড়া খলিল মিয়ার লগে বিয়া দিয়া দিল। অভাবের সংসার, বাপ নাই, মা করে মাইনষের বাড়ি ভিক্ষা, তাই ভাবলাম দুইডা ভাত তো জুটব। আর অহন হেই না খাইয়াই মরতে হয়। এর মধ্যে জামাই আবার বিয়া করছে। এমন বমি বমি লাগে কিয়ারে, আর মাথাডাও খালি ঘুরায়। ডলি, ও ডলি, বইন কই তুই?

হায় হায়! তুই এইডা কী করলি হ্যাঁ, তুই আমার ঘরে বমি করলি? যা অহন ঘরতে বাইর হইয়া যা, আইজকা থাইকা তুই গরুর ঘরে থাকবি।
শইলডা বালা না বইন, দুই দিন ধইরা খাইনা, কয়ডা ভাত দিবি ডলি?

কী কইলি তুই, দুই দিন ধইরা খাস না। খালি তো খাওন আর ঘুমের মধ্যেই আছত, কাম কাইজের তো খবর নাই। আর সব খাওন কি তাইলে আমি খাইয়া ফালাই। দাঁড়া, আসুক বুইড়া আইজকা। তোর লগে আমি সংসার করতে পারুম না, হয় তুই থাকবি, নাইলে আমি। আমি তোর বান্দিগিরি করতে পারুম না।

আমার মনে হয় বাচ্চা অইব, কেমন মাথা ঘুরায়, কাহিল লাগে।
কী!

না না, বড় বউয়ের যদি বাচ্চা হয় তাইলে বুইড়া আমারে ভাগাই দিব। বুইড়ায় এর আগে তিন বিয়া করছে, কিন্তু বাচ্চা হয় না, তাই সব বউ ভাগায় দিছে। এর পেটে বাচ্চা আইলো কেমনে। সবাই তো কইতো বুইড়াই বাজা!

আমার কিছু একটা করাই লাগব। বেডিরে খেদাইতে হইব আর আইজকা থেইকা আর এই ঘরে শুইতে দেওন যাইব না।

রোকেয়া, রোকেয়া, মরছে নাকি? এই ডলি, রোকেয়ায় কই? রাইত কি কম হইছে নাকি, ঘুমাইতে আসে না কেন ! দরজা বন্ধ কইরা দে, আইজকা বাইরেই থাকুক।

চিল্লাও ক্যারে, কাম কাইজ তো সব আমারই করন লাগে, শেষ কইরা আইতে সময় লাগে না? আর বড় বউরে খুঁজো কেন, হেয় অহন থেইক্কা গরুর ঘরে থাকব!
কি, এক ঘরে কি তোগো জায়গা হয় না? আমি কি জমিদার, তোগো লাইগা আলাদা আলাদা প্রাসাদ বানামু? শালিরা বইন্যা খাইতে পারে না!

সারা দিন খাইট্টা আসছো, আইজকা একটু শান্তিমতো ঘুমাও। বিয়া হইছে ছয় মাস হইল, একটা দিন তো ভালা কইরা চাইলা না আমারে। মাঝে একজন থাকলে কি মন ভইরা কিছু করন যায়। তোমার না হয় পুরান বিয়া, আমার তো পরথম। শখ, আল্লাদ নাই?
যা যা, সামনের থাইক্কা, হালার একটা বউ বাচ্চা দিতে পারল না, আর হেয় আইছে সোহাগ নিতে।

সোহাগ না করলে বাচ্চা আইবো কেমনে, আকাশ থেইক্কা? বউরে আদরের দম নাই বিয়ার দম আছে, বুইড়ার!

তালপাতার বেড়ার গরু ঘরে গরুরই জায়গা হয় না, অহন আবার মানুষ! অবশ্য ভালোই হইছে, জামাই বুড়া হোক আর যা-ই হোক, এক ঘরে নতুন বউ নিয়া জামাই চৌকিত আর নিচে আমার পাটির বিছানা থেইকা এই গরুর ঘরই আমার জন্য ভালো!
দুপুর হইলেই ঘুমে আর চোখে দেহি না। মায় কহন আসে, আইলেই না রান্ধন হইব।

খিদার জ্বালার চাইতে ঘুমান ভালা। মারে কমু নাকি, মতিন ভাই যে কয়দিন ধইরা মা না থাকলে বাড়ি আসে আর আমার লগে কী করে? নাহ, মায় আমারেই বকবো, বইনের ছেলের দোষ দেখব না। আর আমারও কেমন জানি ভালোই লাগে ! মতিন ভাইয়ের কথা ভাবতেই শরীরটা কেমন ঝিমঝিম কইরা ওঠে!

খাঁ খাঁ দুপুরে মানুষ সব ঘরের মধ্যে। এই সময় খালা বাড়ি থাকে না আর পুতুলও ঘুমাইয়া থাকে। মাইয়াডার এমন ঘুম, অবশ্য এটা আমার জন্য ভালোই। কাম সারতে সমস্যা হয় না। একটু-আধটু ছুঁইয়া দেখা, কিন্তু এইটুকুতে আর মন ভরে না। আবার ডরও লাগে।

অর্ধেক ভেজানো দরজায় উঁকি দিতেই মতিন আজকে চমকে উঠে। পুতুলের গায়ে ওড়না নাই। মতিনের নেশা নেশা লাগে। কী করবে বুঝতে পারে না। চলে যাবে কি না, ভেবেও সে আস্তে আস্তে পুতুলের দিকে এগিয়ে যায়। পুতুলকে হালকা ধাক্কা দিয়ে দেখে, না মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মতিন বুঝতে পারে আজকে একটা বড় অঘটন ঘটাতে যাচ্ছে কিন্তু তার নিজের ওপর তার যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই!

পুতুল ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে কিন্তু আর সে ভান করতে পারছে না। ভয় আর অন্য রকম এক ভালো লাগায় সে আতঙ্কিত হয়ে চোখ খুলে শুধু বলে, মতিন ভাই! মতিন ভয়ে কোনো রকমে ঘর থেকে দৌড়ে পালায়।

শালি হইছে কী তোর? ছোট বউ তো মিছা কয় না, তুই তো ঘরের কোনো কাম কাজে দেহি নাই। উঠ, গরুর লাথি না খাইতে চাইলে। বেলা দেখছোস কত হইছে? গরু বাইরে দিয়া আমার বাজারে যাওন লাগব। কয়টা পানি, পান্তা তো খাইতে দিবি।

গরু ঘরে মানুষের ঘুম! সকালবেলাই চোখটা লাইগা আইলো। শরীরটা ভালা নাই। বুমি বুমি লাগে, মাথা ঘোরে!

কাম করতে না পারলে ক আমারে, বাপের বাড়ি পাঠাই দেই। ঘরে বসায় বসায় খাওয়ানের জমিদারি আমার নাই।

আমার মনে হয় বাচ্চা হইবো!
কস কী, বাচ্চা হইব!
হু, মনে হয়!
সত্যি কইতাছস?

তুই আমারে আগে কস নাই ক্যারে? আয়, উঠ ঘরে আয়। গরু ঘরে আমার পোলা লইয়া তুই থাকবি! তুই আইজকা থেইক্কা কোনো কামকাজ করবি না। ছোট বউ করব। তোর যা লাগে আমারে কইবি। আয়, আমারে ধর, আস্তে আস্তে আয়। (রোকেয়া অনুভব করে এই প্রথম খলিল রোকেয়াকে মমতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে যায়, আনন্দে রোকেয়ার চোখে পানি চলে আসে)।

চোখে পানি খলিল মিয়ারও। প্রথম বউটার কথা মনে পড়ে খলিল মিয়ার।
প্রথম বউটা অনেক সুন্দর আর ভালো ছিল। হিসাবি মানুষ হইলেও ভালোবাসাতে কৃপণতা ছিল না। কিন্তু বিয়ের ৪/৫ বছর হইয়া গেলেও বাচ্চা হইল না। মায় দিনরাত এই নিয়ে কথা শোনাইত আর বউরে তালাক দিয়া আবার বিয়ার কথা বলত। পরথম পরথম না শুনলেও প্রত্যেক দিন একই কথা শুইনা আর মানুষের মশকরায় বিরক্ত হইয়া রাগের মাথায় বউরে দিলাম তালাক! বউ সইতে না পাইরা মইরা গেল! তারপর থেইকা বিয়া করন আর ছাড়ন! বউয়ের অভিশাপে যেন একটা বাচ্চা কেউ দিতে পারল না!

রোকেয়া, ও রোকেয়া কই গেলা? কে দুলাভাই? আসেন ঘরে আসেন। আছো কেমন শালি? তুমি তো দেহি মরা গাছে ফুল ফুটাইলা ! বুড়ার তিন নাম্বার বউ হইয়া পেটে বাচ্চা নিয়া সম্পত্তির মালিক হইয়া গেলা। আমরা তো জানতাম বুইড়ারই দোষ, তাই তার ঘরে বাচ্চা হয় না। সত্যি কইরা বলো তো, বাচ্চাডা কি খলিল মিয়ার নাকি অন্য কেউর?
ছিঃ ছিঃ, কী বলেন দুলাভাই?

না না এমনি মশকরা করলাম। তোমার লগে তো আমার মশকরার সম্পর্ক!
বড় বউয়ের ঘরে বাচ্চা হইলে হয় আমারে তাড়ায়া দিব, না হয় দুইটা ভাতের বিনিময়ে সারা জীবন ফরমায়েশ খাইটা কোনোভাবে পইরা থাকতে হইব। বুইড়ার সম্পদের লোভে মা আমারে এই সংসারে বিয়া দিল। সত্যি যদি বাচ্চা হয়, তাইলে তো সব হাতছাড়া। কিন্তু রোকেয়ার দুলাভাই কেন বলল বাচ্চা অন্য কারও কি না? রোকেয়া তো মানুষ ভালা! তবে সত্যি হোক বা মিথ্যা, এই কথাটাই কাজে লাগাইতে হইব!

রোকেয়া, কইগো...দেন কলাগুলা আমার হাতে দেন। তুই আইছস ক্যান, আমি কি তোরে ডাকছি? আমার পোলার মারে ডাক, যা।

হু, পোলার মা মা? দেইখা তো মনে হয় মাইয়া হইব! আপনের রোকেয়া তার দুলাভাইয়ের লগে পিরিত করতাছে।

ওহ, বশির আসছে, তা কখন আসছে, খাওন দিছোনি?
সেই দিনের পর থেকে মতিন ভাই আর আসে না। পুতুলের খুব অস্থির লাগে। মনে মনে নিজেকে দোষ দেয়।

সেদিন মতিন খুব ভয় পেয়ে যায়। আগে থেকে ভেবে রাখা কোন কথাই সে বলতে পারে না। একবার ভাবে, খালাকে নিশ্চয়ই পুতুল সব বলে দিয়েছে। আবার ভাবে, ৮-১০ দিন হয়ে গেল কিন্তু খালা তো আসলো না। তাইলে বলে নাই। মতিন আজকে একবার যাবে ভাবে। তখনই দেখে পুতুল তাদের বাড়ি। পাশাপাশি বাড়ি, পুতুল এসেই এদিক-সেদিক তাকিয়ে মতিনের ঘরের দিকে আসতে থাকে। মতিন ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে।

মতিনের খালি গা দেখে পুতুলের শরীর আবার ঝিমঝিম করতে থাকে। ভয়ে ভয়ে সে মতিনের ঘরে ঢুকে, মনে হতে থাকে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, পুতুল দৌড়ে পালায়।
পুতুল চলে যাওয়ার পরই মতিন পুতুলদের বাড়ির দিকে রওনা হয়। হঠাৎ তার সাহস বেড়ে যায়। যেকোনো কৌশলেই হোক পুতুলকে রাজি করাতেই হবে।

রোকেয়ার অনুরোধে এক রুমের ছোট্ট ঘরটার মাঝে একটা পার্টিশন দিয়েছে খলিল মিয়া। এতে করে আগের মতো দুই বউ নিয়া অস্বস্তিতে থাকতে হয় না। আজকে অনেক দিন পর ডলির ডাক পড়েছে খলিল মিয়ার সাথে থাকার। ডলি মনে মনে সব গুছিয়ে রেখেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে দাসি হয়েই থাকতে হবে।
ডলি খুব সুন্দর করে সেজেছে, কিন্তু খলিল মিয়ার সে দিকে নজর নাই। ডলি হঠাৎ কেঁদে ওঠাতে তার মন একটু নরম হয়।

আপনে কি জানেন এই বাচ্ছা আপনের না?

আবার একই কথা, এর লাইগা তুই আমার লগে এমন ছলাকলা করছিস? নিজে কিছু দিতে পারস নাই তাই জ্বলে তোর না?

বিশ্বাস করেন, আমি নিজের কানে শুনছি, বড় বউয়ের দুলাভাই বলছে। আর দেখেন না, কেমন ঘন ঘন আসে এই লোক? আর হেয় কেমন গইল্যা গিয়া ভালা খাওনটা দুলাভাইয়ের পাতে তুইল্লা দেয়। জারজ বাচ্চা পেটে নিয়া আপনের সম্পত্তির লোভে এরা মিথ্যা নাটক করতাছে। আপনে যা-ই কন, আপনের আগের দুই বউ আপনেরে বাচ্চা দিতে পারে নাই, সে দিল কেমনে, একবার ভাইবা দেখছেন? সবাই তো কয় আপনেরই আসলে দোষ, আপনে আঁটকুড়া!

শালি, মুখ সামলাইয়া কথা ক, কপালে দুঃখ আনতে না চাইলে। আমার পোলার কথা শুইন্যা তোর মাথা নষ্ট হইয়া গেছে। কেউ দিতে পারে নাই, অহন আল্লাহর হুকুম হইছে, আল্লাহ দিছে। শয়তান মানুষের মুখে আল্লাহ কালি লেইপ্পা দিছে।

পোলা? পোলা হইবো কে কইল। এর তো মাইয়া হইব। আর হুনছি এর মায়েরও তো তিন মাইয়া, পোলা নাই। তয় হের হইব কেমনে?

শালি, তোর প্রতি মায়া দেহান আমার ভুল হইছে। তোর জায়গা মাটিতে, খাটে আমার লগে না। বউডা ঘুমাইয়া গেছে, না হয় অহন তোরে লাথি দিয়া জায়গামতো ফালাই দিতাম। আমার ঘরে পোলা হইব পোলা, মাইয়া না। আমার বংশের প্রদীপ, পোলা। আর যদি কোনো দিন তুই আমারে এসব কথা কস, তোরে আমি তালাক দিমু, তোর মতো বন্ধ্যা মাইয়া লোক আমার দরকার নাই।

শালি দিল মাথাডা নষ্ট কইরা। আচ্ছা, সত্যিই কি পোলা আমার না? অন্য কেউর বা বশিরের? ছোট বউ ঠিকই কইছে, প্রায় দিনই বশির আসে আর রোকেয়া তারে খুব যত্ন করে। প্রথম দুইডা বউ তো বাচ্চা দিতে পারল না। দুই নম্বর বউটার অন্য যেখানে বিয়া হইছে, শুনছি তিনটা বাচ্চা আছে অহন! আমার ঔরষে না হইলেও রোকেয়ার গর্ভে তো হইছে! আমার বংশ রক্ষা হোক! রোকেয়া তো আমার বিয়া করা বউ!

না না এই আমি কী ভাবতাছি? আর রোকেয়া তো অন্য রকম। আমার পরথম বউ নাজমার মতন! এত গালি দিই, মারি, তাও একটু শব্দ করে না। বাইরের কারও লগে মিশে না। নাহ, শালি হিংসায় আমারে ভুল বুঝাইতাছে। আর মাইয়া না পোলাই হইব, আমার বংশের বাত্তি।

পুতুল, আমি তোরে কিছু কইতে চাই। আমি, আমি আসলে তোরে বালোবাসি। হেই লাইগ্যাই বারবার তোর কাছে আসি। তুই আমারে ফিরাই দিলে আমি বিষ খামু।
মনির ভাই!

হু পুতুল, আমি তোরে অনেক বালোবাসি। এই দেখ তোর লইগ্যা আমি স্নো আর একটা সিটি গোল্ডের চেইন কিনছি, তোরে দেওনের লইগ্যা আমি প্রত্যেক দিন আসি কিন্তু সাহস করতে পারি না, যদি তুই ফিরায়ে দেস।

কিন্তু আপনে যে আমার গায়ে হাত দেন?
কই নাতো, কী কস?

হ, আমি জানি। আমি ইচ্ছা কইরাই ঘুমের ভান কইরা থাকতাম।
ওহ, এই যে কইলাম বালোবাসি, বালোবাসলে এসব করতে হয়!
কিন্তু আমার ডর লাগে।

কিসের ডর পুতুল? আমার ঘরের বউ হইবি তুই?
বউ, আপনের বউ মনির ভাই?
হ, আমি তো মারে বলমু বইল্লা ঠিক করছি যে আমি তোরে বিয়া করমু।
ছাড়েন মনির ভাই, আমার ডর লাগে।

তাইলে আমি গেলাম, তুই থাক। মায় যে মাইয়া ঠিক করছে তারেই বিয়া করমু কইয়া দেই।

না, না যাইয়েন না। আপনেরে ছাড়া আমিও বাঁচতাম না। আপনে আমার গায়ে হাত দিলে আমার ডর লাগলেও আবার ভালাও লাগতো! আইজকা যান গিয়া, মা আসনের সময় হইয়া গেছে।

না, খালা আইব না অহন। তুই আয় একটু আমার কাছে আয়।
পুতুল, কে মনির তুমি আইছ কহন? বইন আছে কেমন? আহারে আপন মার পেটের বইন আর একদিন একটু আসে না, খোঁজখবর নেয় না।

খালা মায়ই আমারে পাঠাইল আপনেরে দেখতে। কি নাকি খারাপ স্বপ্ন দেখছে তাই কইল বইনেরে যাইয়া দেইখা আয়। আপনের শইল কেমন খালা?

আর শইল। দুই বেলা বাত খাইতে পারি না। আর আইজকাল আগের মতো গেরাম করতে পারি না, মানুষও তেমন কিছু দেয় না। এই খাইয়া আর বাঁচন! এদিকে হুনছি রোকেয়ার বাচ্চা হইব, মাইয়াডার লইগ্যা মনডা কেমন করে। বিয়া দিছে নাছিমা। হুনছি জামাইর বয়স বেশি। তয় বাচ্চা হইব চিন্তা হয় লগে কেউ নাই।

খালা আপনে চাইলে আমি আপনেরে একবার লইয়া যামুনে। তয় আইজকা যাই, কাম আছে।

মাইয়া আর মনিররে যেইভাবে দেখলাম, মনে হয় কিছু চলতাছে। খালারে দেখতে আইব সেরম পোলা হে না। আগে রোকেয়া থাকতে আসত, তয় মাইয়ায় তারে পছন্দ করত না। কইত নজর খারাপ!

পুতুলরে কি সাবধান করমু? সাবধান কইরাই আর কী হইব? গরিবের ঘরে পুতুলের মতো সুন্দর মাইয়া হইছে দেইখা নাম রাখলাম পুতুল। কিন্তু ভালা ঘরে কি আর বিয়া দিতে পারমু? হেই রোকেয়ার মতোন হয়তো বুড়া আর বিয়াত্তা লোকের সাথে বিয়া দিতে হইব।

তার থেইকা যদি কোনোভাবে ফালাইয়া হইলেও বইনের পোলার লগে বিয়া দিতে পারি। বইন তো এমনে মানব না, যেই হিংসা আমার লগে। আমি ভিক্ষা করি আর হের পোলারা কামাই কইরা সংসার চালায়, ঘর করছে। পোলার নজর খারাপ এইডা কোনো দোষ না। যেই কামের পোলা, পুতুলের ভাত-কাপড়ের অভাব হইব না!

বশির মিয়া, আইছেন কহন? আপনে দেহি ইদানীং ঘন ঘন আসেন। বউরে পাঠাইলেই পারেন, বইনেরে দেইখা যাইত।

হ ভাই, আপনেগো এইখানে মোকাম করতে আসি। তাই শালির বইন কয় খোঁজ নিয়া যাইতে। নিজে তো আইতে পারে না, ইটভাটায় কাম করে। তয় আইব কইছে, বাচ্চা হইলে। বইনের জন্য অনেক চিন্তা করে, কান্দে।

হু, সময় তো বেশি বাকি নাই। পোলাডা আইব আইব কইয়া। বংশের বাত্তি! তয় দেহেনই তো আপনে আসলে বেশি দৌড়ঝাপ করে, তাই কই আরকি যহন তহন না আসলেই ভালো!

মনির ভাই, আমার ডর লাগে। এমনে আর ভালো লাগে না। খালারে কইয়া আমারে আপনের ঘরে নিয়া যান। মায় মনে হয় কিছু বুঝতে পারছে। আপনে আমারে বিয়া করবেন তো? এত কিছুর পর বিয়া না করলে আমার কিন্তু মরণ ছাড়া উপায় নাই!
তুই আমারে অবিশ্বাস করস পুতুল? আমার কথায় তোর বিশ্বাস হয় না? আরে বিয়া করতে টাকা লাগব না? আর তোরে রাখমু কই? কয়ডা দিন যাক, কিছু টাকা হইলে ঘর কইরা তোরে বিয়া করমু। আমি তো আর পালায় যামু না!

বুঝলি বউ, পোলা আমার ভাগ্য নিয়া জন্মাইব তা আমি বুঝতে পারতাছি। আমার বংশের পরথম বাত্তি বইল্যা কথা। দোকানের লগে লগে সুদের ব্যবসা ভালোই চলতাছে। পোলা বড় হইয়া কী কইরা খাইব, সেই নিয়া তার চিন্তা করা লাগব না। আমিই তার জন্যে সব ব্যবস্থা কইরা যামু।

পোলা পোলা করতাছেন আল্লাহ তো মাইয়াও দিতে পারে। এত বছর পর আল্লাহ আপনের ঘরে বাচ্চা দিতাছে হেই লাইগ্যা আল্লাহ পাকের দরবারে শুকরিয়া জানান। পোলা কী আর মাইয়া কী? আমার তো মাইয়াই পছন্দ। আর এসব হারাম কাম বাদ দেন। দোকান থেইকা যা আসব, তাতেই আমাগো চলব।

তুই আমারে জ্ঞান দিতে আসছস না? আর সাবধান বউ, যদি মাইয়া হয় তো তোরে আর তোর মাইয়া আমি জীবন্ত কবর দিমু। আমি আঁটকুড়া থাকমু কিন্তু মাইয়া পোলাপাইন আমার দরকার নাই। আর কোনো দিন যেন না শুনি, এই সাবধান কইরা দিলাম।
মনির ভাই, আপনে আইজকা চইলা যান। শরিরটা আজকা ভালো লাগতাছে না, মাথা কেমন ঘুরায়।

অহ, দুই দিনের শখ মিইটা গেছে? নাকি আমারে অহন আর ভালো লাগেনা?
ছিঃ কী কন এইগুলা? সকাল থেইকা কিছু খাই নাই আর খাইতেও ইচ্ছা করে না। তাই হয়তো একটু কাহিল লাগতাছে।

হু, কয়দিন ধইরা তো একই কথা কইতাছস?
মনির ভাই, আমার জানি কেমন কেমন লাগে! সময় তো পার হইয়া গেল! অন্য ব্যাপার মনে হইতাছে! আপনে খালারে কইয়া আমারে ঘরে তুইলা নেন। কিছু হইয়া গেলে মানুষ কী কইব?

মানে তুই কী কইতে চাইতাছস? অন্য কিছু কী? বিয়ার আগে কিন্তু এইসব শুনলে আমার মা তোরে কোনো দিন মাইনা নিব না। আর আমি কেমনে সমাজে মুখ দেখামু? সে রকম কিছু যদি হইয়া যায় তুই দূরে গিয়া ফালায় দিয়া আয়।

আপনে এখন এসব কী কন? কিছু যদি হয় তাইলে আমি যেমন মা আপনি তো বাপ, সে তো আপনেরই ! আপনে সমাজে মুখ না দেখাইতে পারলে আমি কেমনে দেখামু? আর বিয়া করলেই তো সব সমস্যার সমাধান। আমার ঘরবাড়ি লাগব না। আপনে আমারে বিয়া করেন।

অহ, তাইলে তুই ইচ্ছা কইরা আমারে ফাঁসাইতে এসব করছস? আমি এখন এইসব মাইনা নিমু না।

মনির এমন রাইগা চইলা গেল কেন? কি হুনলাম আমি! মনির যা কইল সব সত্যি? তোর পেটে মনিরের বাচ্চা?

আমি জানি না মা! অনেক দিন হয় না। আর শরীরটাও কেমন খারাপ লাগে!
সমাজে মুখ দেহাবি কেমনে? এই কথা কওনের আগে তুই মরলি না কেন?

বুইড়া রে কয়দিন ধইরা একটু কেমন কেমন লাগতাছে। মনে হয় আমার ঔষধে কাম হইতাছে। চোখে চোখে রাখতে হইব আর সময় সুযোগ বুইঝা আরেকটু খুঁচাইতে হইব। বুইড়ার জায়গা-সম্পদ কম না। রোকেয়া থাকলে আর তার ঘরে পোলা হইলে আমার এই বাড়ি ছাড়ন লাগব। তাই মাইয়া হইলে তো যা করণের তা বুইড়াই করব বইলা মনে হয়। আর পোলা হইলে পেটের থেইকা বাহির হইলেই নুন দিয়া মাইরা ফালান লাগবো!
চেয়ারম্যানরে ধইরা কিছু করতে পারলাম না। গেরামের পাঁচজন কিছু করল না।

গরিবের কথা কে হুনে? আর মনির কাইল রাইতে বিয়া কইরা ঘরে বউ তুলছে! তুই মর, তুই মর! সব লোক জাইনা ফালাইছে, গেরামে যাইতে পারি না, মানুষ ছি ছি করে।

আমার বাড়ি থেইকা বাহির হইয়া যা, আমি আর তোর পাপমুখ দেখতে চাই না। তোরে নিয়া আমি কী করমু? কে বিয়া করব তোরে? মাইয়াগো জামাইরা হুনলে ওগো সংসার ভাঙব, তুই মর, মর, মর!

মাগো, আমিও তো অহন একজন মা! আমি নাহয় মইরা গেলাম আমার বাচ্চা তো আমি মারতে পারুম না।

শুনছেন, শরীরটা ভালো লাগতাছে না। সময় মনে হয় চইলা আইছে। এই সময় আমার ছোট বইনটারে যদি আনতেন, কামে লাগত। অনেক দিন হয় দেহি না, দেখতে মন চায়।

হু, পুরা পরিবার লইয়া আয়। আমার ঘরে তো ভাত, চালের ছড়াছড়ি। তোরে খাওয়ামু আবার তোর মা-বইনেরেও খাওয়ামু।

এই বুড়ি, আপনে এইখানে কী করেন? আপনের মাইয়া পুতুল তো গলায় ফাঁস দিয়া আত্মহত্যা করছে!

এই মাইয়া, তুমি কী কও এইগুলা? তুমি আমার মাইয়ারে চিনো?
হু, সবাই তো জানে! আপনে জানেন না, কই আছিলেন? যান তাড়াতাড়ি বাড়িত যান!
পাপ, আমার লোভের পাপ!
রোকেয়া, রোকেয়া কই তুই?

কে, দুলাভাই? এত সকালে? আর আপনেরে এমন লাগতাছে কেন? বইনে ভালো আছেনি?
অস্থির হইছ না, তোর বইন ভালো আছে। পুতুল...
পুতুলের আবার কী হইছে? কথা কন না কেন?

মন শক্ত কর, তোর শরীর তো ভালো না। পুতুল নাকি কাইল গলায় ফাঁস দিয়া আত্মহত্যা করছে!

কী কন, না না আমি বিশ্বাস করি না। আমার ফুলের মতো অবুঝ বইন কেন এসব করব?

হুনলাম, তোর খালাতো ভাই মনিরের লগে সম্পর্ক কইরা পেটে বাচ্চা হইছে। আর মনির নাকি পুতুলরে অস্বীকার কইরা দুই দিন আগে আরেক জায়গায় বিয়া করছে।

মনির শয়তানের পাল্লায় আমার নিষ্পাপ বইন কেমনে পড়ল। আমার লগে না পাইরা আমার বইনের জীবন নষ্ট করল?

রোকেয়া কান্দে কেন ডলি, ব্যথা উঠছে নাকি? কামালের মা দাই রে ডাক দিছো।
কান্দে, বইনে ফাঁস নিছে!
ফাস নিছে? কে?

ছোট বইন, পুতুল না কী যেন নাম। খালাতো ভাইয়ের লগে ফষ্টিনষ্টি কইরা পেট বাঁধাইয়া ফাঁস নিছে। কইছিলাম না আপনেরে, এগো চরিত্র ভালো না। বিশ্বাস হইলো তো?

আপনের রোকেয়া ও আরেকজনের পেট লইয়া আপনের জায়গা-সম্পদ দখল করতে নাটক করতাছে। অহনও সময় আছে সাবধান হন। এই পাপ বাড়ি থেইকা বিদায় করেন।

পাপ! পাপ যদি মাইয়া হয় তো মা-মাইয়া দুইটারে জীবন্ত কবর দিমু!
আহারে, গরিবের ঘরে বিষও নাই, মাইয়াটা ফাঁস নিলো!
আহারে, ফাঁসের মরা জানাজা, কবর কিছু ই জুটল না!
অল্প বয়সে চরিত্র নষ্ট হইলে যা হয়!
আমার সন্তানরে আপনে বাঁচান দুলাভাই।

কাইল আসলাম তোমার বাড়ি আর আজকা আমারে এমন রাতের বেলা কেন খবর পাঠাইলা? আর কী বল এইগুলা?
হু, আমার সকাল থেইকা ব্যথা উঠছে।

সেই কথা বলতে আমারে কেন ডাকলা? তোমার স্বামীরে বল? আমি কী করব?
না, না আমি কাউরে কই নাই আর কমু না। আপনে আমারে এখান থেইকা নিয়া যান। এইখানে থাকলে আমি আর আমার সন্তান কেউ বাঁচতে পারমু না!
কী কও এসব আবোলতাবোল কথা?

হু, আমি শুনছি যদি মাইয়া হয় আমার স্বামী আমারে আর আমার মাইয়ারে জীবন্ত কবর দিব। আর পোলা হইলে আমার সতিন তারে মাইরা ফালাইব। আমাগো আপনে বাঁচান দুলাভাই।

তুমি সত্যি কইতাছো? কিন্তু আমি কেমনে বাঁচামু?
আমি জানি না, আমার হাতে সময় নাই। আপনে আমারে এইখান থেইকা নিয়া যান।
এত রাতে আমি এই অবস্থায় তোমারে নিয়া কই যামু?
ছায়াটা সরে যেতেই রোকেয়া চমকে উঠে!

উঠেন, কই আপনে নাক ডাইকা ঘুমাইতাছেন আর আপনের আদরের বউ রোকেয়া তার দুলাভাইয়ের সাথে পালায় গেছে!

আমি আর পারতাছি না, আপনি আমারে একটা হাসপাতালে নিয়া চলেন। যেই সন্তান বাঁচানোর জন্যে ঘর ছাড়ছি, সেই সন্তানের কিছু হইলে আল্লাহ আমারে মাফ করব না।
কিন্তু হাসপাতাল তোমারে কেমনে নিব, আমার কাছে তো টাকা নাই!

টাকা আমার কাছে আছে। আমার সন্তানরে আপনে বাঁচান দুলাভাই।

লোভ, লোভ আমার পুতলার মতো মাইয়ারে আমি নিজে মারছি। মাইয়ার সুন্দর ঘর, সংসারের লোভে সব দেইখা, শুইন্না মা হইয়া চোখ বন্ধ রাইখা আমি তারে ওই শয়তান পোলাডার ভোগের সামগ্রী বানাইছিলাম। যদি লোভ না করতাম, মেয়েরে সতর্ক করতাম, তাইলে আমার পুতুল আইজ আমার বুকে থাকত। আল্লাহ চাইলে এমন সুন্দর মাইয়া ভালো একটা বিয়াও দিতে পারতাম। পুতুল তুই আমারে ক্ষমা করিছ রে মা। আমি মা না, আমি রাক্ষুসী! মা হইয়া মেয়েরে খাইছি। আল্লাহ ভিক্ষুক কইরা কেন পাঠাইলা?

বুড়ি কি পাগল হইয়া গেল, সারা দিন খালি বিড়বিড় করে। আহারে, অমন পুতুলের মতো মাইয়া! শয়তানের পাল্লায় পইড়া জীবনটা দিল! বাঁইচা থাকলে সবাই মিলা মনিররে বুঝাইয়া বিয়া না হয় দেয়া যাইত। কেন যে মাইয়াডা মরতে গেল!

এই বয়সে বিয়ার আগে মজা লইতে গেছে, পেট বাঁধাইছে, মরণ ছাড়া উপায় কী! পোলার আর দোষ কী!

দুই শ তিন নম্বর রুমের রোগীর সঙ্গে কে আসছে, ভিতরে আসেন। রোগীর ছেলেসন্তান হয়েছে!

ছেলে হইছে, সত্যি কইতাছেন ডাক্তার আফা ?
রোকেয়া, তুই পালাবি কেন? তোর তো সোনার কপাল, পোলা হইছে!

নাহ, দুলাভাই আমি আর ওই ঘরে ফিরা যামু না। ছেলে নিয়া ফেরত গেলে সে হয়তো আমারে ফিরাই লইবো। কিন্তু আমি জানি, সারা জীবন তার মনে একটা সন্দেহ থাকব যে পোলা তার না অন্য কারও? জন্মদাতা পিতা হইয়াও সে নিজেরে বাপ মনে করতে পারে না, সেই বিশ্বাস তার নাই। তাই চাইলেও সে তার সন্তানরে আপন কইরা নিতে পারব না। এই অসম্মান থেইকা পোলা ভিক্ষুক মায়ের পরিচয়ে বাঁচব, সেইটা অনেক বড় সম্মানের! আপনে ফেরত যান, বলবেন রোকেয়া বাচ্চা জন্ম দিতে যাইয়া বাচ্চাসহ মারা গেছে!

*শারমিন আকতার, ইউনিভার্সিটি অব গিজেন, গিজেন, জার্মানি