করোনাকালের ঐতিহাসিক দলিল

রাতভর বৃষ্টি হলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ওপর টুপটাপ আওয়াজের অবিরাম বৃষ্টির ছন্দ শুনছিলাম। সকালের দিকে ব্যালকনিতে কুয়াশার মতো আবহ বিরাজ করছিল। এমন আবহাওয়াকে ঠিক বৃষ্টি কিংবা কুয়াশা বলা যাবে না। ভিজে স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ নাকে আসছিল। ব্যালকনির ইজি চেয়ারে বসে থাকার সময়ে এমন সোঁদা গন্ধ কখনো বিরক্তির উদ্রেক করে না। হাতের বইটি উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। গত কয়দিন ডুবেছিলাম যে বইয়ের গভীরে। বই নয়, আমি বলব, ডুবেছিলাম সময়ের গভীরে। যে সময় আমরা অতিক্রম করে এসেছি, এখনো যে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। স্তব্ধ সময়।

বলছি ‘মহামারি করোনা: ডেটলাইন নিউইয়র্ক’ বইটির কথা। লেখক প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী। পৃথিবীব্যাপী চলমান করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় নেমে এসেছিল নিউইয়র্কে। সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর শহর এটি। একজন সাংবাদিক হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখা এবং সংগ্রহ করা রিপোর্টের মাধ্যমে বিপন্ন সময়কে ধারণ করে লেখা গ্রন্থ ‘মহামারি করোনা: ডেটলাইন নিউইয়র্ক’।

ভয়াবহ, বিপর্যস্ত প্রথম তিনটি মাসের দিন, তারিখ, সময় উল্লেখ করে তথ্য সমৃদ্ধ লেখায় প্রতিটি ঘটনা, গণমাধ্যমের খবর, নিউইয়র্কের মেয়র, গভর্নরের বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য অংশ, প্রেসিডেন্টের বক্তব্য, পদক্ষেপ কিছুই বাদ যায়নি এই বইয়ে। আরও আছে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য সংবাদ। সময়কে ধরে রাখা দুর্লভ বেশ কিছু ছবিও যুক্ত করা হয়েছে বইটিতে। লেখা হয়েছে পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যাওয়া বাংলাদেশিদের নাম। বলা চলে এ এক ঐতিহাসিক দলিল। লেখকের সবচেয়ে বড় বিনয়, তিনি বইটি লেখার পেছনে একার কৃতিত্ব দাবি করেননি। যুক্ত করেছেন সংবাদ সংগ্রহে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলস কাজ করে যাওয়া প্রতিটি যোদ্ধার নাম।

হাসপাতালগুলোয় তিল ধরনের ঠাঁই নেই। গত বছরের ২৯ মার্চের বিবরণ লিখতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘আমরা মৃত্যুর সংবাদ লিখছি। হাত কাঁপছে। বুক কাঁপছে। চেনাজনের নাম আসছে মৃত্যুর তালিকায়। একজন সংবাদকর্মীর কাছে পরিচিতজনের মৃত্যু সংবাদ লেখার চেয়ে বড় বেদনার আর কিছু হতে পারে না।’

৪ এপ্রিল করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নিউইয়র্কের আতঙ্কিত মেয়র ব্লাজিও আকুতি জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে। বলেছেন, এখনো শান্তিকালীন অবস্থার মতো দেশ চলছে। অথচ আমার নগরীর জনগণ বিপন্ন। স্রষ্টার দোহাই দ্রুত ব্যবস্থা নিন।’ কেমন গা শিউরে ওঠা আকুতি। ৮৫ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে ৮ এপ্রিলের মধ্যে। সেদিন বাংলাদেশি আমেরিকান শাহানা তালুকদার আঁখির মৃত্যু সংবাদ লিখতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, কোনো কোনো ভোর রাতের চেয়েও অন্ধকার! ফিউনারেল হোম বুকিং না পাওয়া, একটি মৃত্যুর খবর শোনাতে গিয়ে আরেকটি মৃত্যুর খবর সামনে এসে হাজির হওয়া, মুহুর্মুহু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ, জনমানবহীন ভুতুড়ে পথঘাট, সব মিলিয়ে কী ভয়ানক সময় কেটেছে মৃত্যুপুরী নিউইয়র্ক শহরের প্রতিটি মানুষের, সে বর্ণনার পাশাপাশি আশার কথা শুনিয়েছেন রিপোর্টারদের কেউ কেউ। লিখেছেন, তবু মৃত্যুর মধ্যেও আমাদের জীবন একেবারে থেমে যায়নি। আমরা মানুষেরা অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছি বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার। মৃত্যুকে জয় করে আমাদের জীবনের জয়গান গাইতে হবে।

বইটি পড়ার পর ঝিম মেরে বসে আছি। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয়েছে, প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী আমি। যে বই পড়ার পরও দীর্ঘসময় পাঠক এক রকম ঘোরের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করে, আমি মনে করি এটিই লেখকের সার্থকতা। সময় ধরে ধরে প্রতিটি ঘটনা পাঠককে বলে যাওয়া এবং সেই সময়ের মধ্য দিয়ে পাঠককে ঘুরিয়ে আনা লেখকের এক রকম মুনশিয়ানা বলা চলে।

বইটি আরও বহুবার পড়ব। বহুদিন। বহু বছর পর ধুলো জমা সেলফ থেকে যত্নে ধুলো মুছে পুরু কাচের চশমার আড়াল থেকে বইটি নিয়ে ব্যালকনির ইজি চেয়ারে বসব কোনো হেমন্ত সকালে, নয়তো বসন্ত বিকেলে। ছুঁয়ে দেওয়া দূরত্বে বাতাসে তিরতির করে কেঁপে ওঠা ম্যাগনোলিয়ার পাপড়ির দিকে তাকিয়ে স্মরণ করব সেই সময়কে। বইয়ের প্রতিটি লাইনে চোখ বুলিয়ে নেব। ফিরব পেছনের কালে। আঁতকে উঠব, শিউরে উঠব। অনর্থক গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছব হাতের তালুতে। যেন অনন্তকাল ধরে চোখের গভীরে থাকা আকাশে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হচ্ছে।

এই যে একে একে চেনামুখের অনেকেই চলে গেল, চলে গেল নির্বাক সময়, চিরতরেই যে গেল! এই শহরে আমাদের হয়তো সবার সঙ্গে রোজ দেখা হয় না, আড্ডা হয় না। কিন্তু শেকড় ছেড়ে আসা আমরা একে অপরের কতটা আপন, কতটা কাছের আত্মার আত্মীয় হয়ে বেঁচে আছি, তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে মহামারি। অসহ্যকর হয়ে ওঠা জীবনে আমরা কত কী উপলব্ধি করছি। আমাদের মনে হচ্ছে যেন কোটি কোটি বছর আমাদের দেখা হয় না। আড্ডা হয় না। মহামারি শেষে যদি বেঁচে থাকা ভাগ্যবানদের একজন হই, তবে জ্যাকসন হাইটসে নয়তো প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার অফিসে সাপ্তাহিক আড্ডায় চায়ের কাপে উড়ে যাওয়া ধোঁয়ায় তুমুল গল্পের ঝড় বইয়ে দেব। গল্প হবে ‘মহামারি করোনা: ডেডলাইন নিউইয়র্ক’ বইটি নিয়ে। গল্প হবে এই শহরে আমাদের আপনজন বলতে যারা আছেন, সবাকে নিয়ে এক সঙ্গে এক টেবিলে।